• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

৩২ অপরাধী ও অভিযুক্ত এবার বিএনপির প্রার্থী

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮  

জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুল হাকিম। ছাত্রজীবনে ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে যুক্ত। পরে যোগ দেন আলবদর বাহিনীতে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে এবার নির্বাচন করছেন তিনি। মাওলানা শামীম বিন সাঈদী। তার বাবা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী। যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। শামীম নির্বাচন করছেন পিরোজপুর-১ আসনে। পিপিপির চেয়ারম্যান রিটা রহমান। তার স্বামী মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান জেল হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। রিটা রহমান রংপুর-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাহমিনা জামান শ্রাবণী। তার স্বামী বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। নেত্রকোনা-৪ আসনের প্রার্থী তাহমিনা। তারা প্রত্যেকেই বিএনপির প্রতীক ধানের শীষের হয়ে নির্বাচনী মাঠে লড়াইয়ে নেমেছেন। জানা গেছে, শুধু এরাই নন; বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন প্রায় ৩২ জন চিহ্নিত অপরাধী। যাদের সবাই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার। তাদের পরিবারের সদস্য, জেল হত্যা মামলা এবং একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলামামলার আসামিদের স্বজন ও পরিবারের সদস্য। এ ছাড়া নিবন্ধন হারানো জামায়াতের ২২ জন প্রার্থী ধানের শীষ পেয়েছেন। এর বাইরে দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আরো কয়েকজন নেতা। এ তালিকায় আছেন বিএনপি-জামায়াত আমলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মদদদাতা ও চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরাও। এদিকে চিহ্নিত অপরাধীদের মনোনয়ন দেয়ায় এবারো ব্যাপক সমালোচনায় পড়েছে বিএনপি। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিতে এরা অপরাধী। আন্তর্জাতিক মহলও এদের বর্জনের পক্ষে। তবুও এই অপরাধীদের মনোনয়ন দেয়ার বিষয়ে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনি বিএনপি। এ নিয়ে রাজনৈতিক ও সচেতন মহলে সৃষ্টি হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দুষ্টুচক্রের খেলায় অপরাধী হয়েও এরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছেন। যার খেসারত আগামী প্রজন্মকেই দিতে হবে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিএনপি সব জেনেও যাদের মনোনয়ন দিয়েছে তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কিত। তারা নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করবে- যা হতাশাব্যঞ্জক। এ ধরনের অপরাধীরা আইনসম্মতভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, এটাও দুঃখজনক। নির্বাচন কমিশনের বাঁধা দেয়া উচিত ছিল, এরা যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। তিনি বলেন, দেশবাসীর কাছে আমার প্রত্যাশা, তারা যেন ভোট দেয়ার সময়ে প্রার্থীর সততা, যোগ্যতা অবশ্যই বিবেচনায় নেন। প্রার্থী যুদ্ধাপরাধী, অপরাধী, দুর্নীতিবাজ কি না সেটাও বিবেচনায় নেবেন। তারপরও যদি রাজনৈতিক দুষ্টুচক্রের খেলায় নির্বাচনে এরা বিজয়ী হয়ে আসে, তাহলে জাতির জন্য হবে লজ্জাজনক। চিহ্নিত অপরাধীদের তালিকায় ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন এরকম আরো বেশ কয়েকজন আছেন। পাবনা-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন ডা. নজীবুর রহমান। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া আসামি মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে তিনি।

নিজামী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তার। ছিলেন আলবদর বাহিনীর নেতৃত্বে। তার নির্দেশেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। কক্সবাজার-২ আসনে নির্বাচনী মাঠে আছেন জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। বগুড়া-৩ আসনে নির্বাচন করছেন মাসুদা মোমিন তালুকদার। তার স্বামী মোমিন তালুকদার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বগুড়া এলাকায় রাজাকার-আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা এই রাজাকার লুটপাট, নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সাজাও হয়েছে তার। বর্তমানে বিদেশে পলাতক আছেন তিনি। খুলনা-৫ আসনে লড়ছেন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার। রাজাকার বাহিনীর এই সদস্য ২০০১ সালে নির্বাচনের পর জেহাদি পার্টি নামে একটা বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, এমনকি সাংবাদিক হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত ছিল। সাতক্ষীরা-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন চিহ্নিত রাজাকার গাজী নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম-৪ আসনে ধানের শীষে লড়ছেন মাওলানা ইসহাক চৌধুরী। তিনি বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর আপন ভাই। তিন বছর আগে ভারতে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন আসলাম। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত দ-প্রাপ্ত আসামি সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর আপন ছোট ভাই সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে নির্বাচন করছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী চিহ্নিত অপরাধীদের ভোট না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিএনপি যাদের মনোনয়ন দিয়েছে, তা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত। যে অপরাজনীতি আমাদের ও এর আগের প্রজন্মকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। বিএনপি সেই অপরাজনীতি তুলে দিচ্ছে অপরাধীদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এর ফলে আরেকটি নতুন রাজাকার প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান, ওদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের। তোমরা যদি সময়মতো সেটি করতে না পারো, তাহলে এরজন্য ভুক্তভোগী হবে তোমরা নিজেরাই। কাজেই এরা যেন আর কখনোই দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রতি জোরালো সমর্থন রাখতে হবে।

এবার নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সন্তানরা যেন অংশ নিতে না পারে, কিংবা তাদের যেন মনোনয়ন দেয়া না হয়, সেজন্য নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। গতকাল এ সংগঠনটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আমরা ইসি ও সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল ইসি এত নিরপেক্ষ হয়ে গেল। তথাকথিত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নামে সবাইকে নির্বাচন করার সুযোগ দিল। আমরা মনে করি, এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চরম অবমাননা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ^াস ঘাতকতা। গঠনতন্ত্রের যে ধারায় জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছে, ঠিক একই ধারায় নিষিদ্ধ দলের নেতারাও নির্বাচনে নিষিদ্ধ হবেন- এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখলাম উল্টোটা। নির্বাচনের পর উচ্চ আদালতে বিষয়টি নিয়ে রিট করবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা রিট করব। নির্বাচনে যদি অপরাধীরা বিজয়ীও হয়, তারপরও বিশ^াস আছে- আদালতের রায়ে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হবে। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশেই তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে।

২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর যাদের কারণে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের আবির্ভাব ঘটেছে তারাও ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছেন। এমন তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার আমিনুল হক রাজশাহী-১ আসনে, মিজানুর রহমান মিনু রাজশাহী-২, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু নাটোর-২, নাদিম মোস্তফা রাজশাহী-৫ এবং আলমগীর কবির নওগাঁ-৬ আসনে লড়াই করছেন। তাদের মদদেই মূলত বাংলাভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের উত্থান ঘটে। যা ওই সময় দেশব্যাপী আলোচিত হয়। এদিকে বিএনপি যাদের মনোনয়ন দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিহত করতে মাঠে থাকবে। তাদের কর্মকা-ও নজরে রাখবে। অপরাধীরা যেন আর কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতায় কিংবা বিজয়ী হতে না পারে, সে ব্যাপারে সাংগঠনিক তৎপরতাও চালাচ্ছে দলটি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পরিবারসহ বিভিন্ন অপরাধে ৩২ জন প্রার্থী ধানের শীষে নির্বাচন করছেন। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সচেতন করতে আমরা সাংগঠনিকভাবে মাঠে আছি। নির্বাচনের আগে আরো স্বোচ্চার হবো। কেন্দ্রীয়ভাবে সেগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটাররা যেন অপরাধীদের কোনোভাবেই ভোট না দেয়, তারা যেন নির্বাচিত হয়ে না আসতে পারে- সে জন্য তাদের চিহ্নিত করে আমরা ভোটারদের কাছে তুলে ধরব।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা