• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

হত্যা ও সন্ত্রাস দ্বারা শত্রুতার রাজনীতি করেছে বিএনপি-জামায়াত

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০১৯  

ঢাকায় একটি দৈনিকে একই দিনে দুটি খবর দেখলাম। একটি খবর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের অধিবেশন সম্পর্কে। তাতে বলা হয়েছে, এবার দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক নতুন মুখ আসছে। কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্বও আরো বাড়ানো হবে। আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, বিএনপি খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি লাভের ব্যাপারে হতাশ হয়ে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলন শুরু করার কথা ভাবছে। বিএনপির এক নেতা বলেছেন, তাঁর দলের নেতাকর্মীদের হতাশা এখন কেটে যাচ্ছে। তাঁরা আন্দোলনমুখী হয়েছেন।

দুটি খবরই আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দল। তাদের জাতীয় কাউন্সিলে নতুন মুখ আসছে এবং তারা সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেবে-এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা উপমহাদেশের জন্যই সুখবর। কারণ ভারতের কংগ্রেসের মতো বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ প্রাচীন ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। তারা শক্তিশালী হলে গোটা উপমহাদেশেই তার শুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
এক ভারতীয় সাংবাদিকই তাঁর কলামে লিখেছেন, ‘ভারতের কংগ্রেস এখন প্রায় পতিত বৃক্ষ। দেশটাকে গ্রাস করেছে ভয়ংকর হিন্দুত্ববাদ। বাংলাদেশেও পাল্টা ইসলামী জঙ্গিবাদ প্রায় দেশটাকে গ্রাস করতে চলেছিল। তা রুখে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ দলটিতেও নানা আগাছা জন্মেছে। এই আগাছা উপড়ে ফেলে দলটি যদি শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পুনর্গঠিত ও শক্তিশালী হয়, তার প্রভাব বর্তাবে সারা উপমহাদেশে। ভারতের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষও তাই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাফল্যের দিকে চেয়ে আছে।

আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহে কমিউনিস্ট পার্টি বা জামায়াতের মতো কোনো কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। দলটি ব্রডচার্চের মতো। তার নীতিমালায় সম্মতি আছে জানিয়ে যে কেউ দলটির সদস্য এবং কর্মকর্তাও হতে পারে। এর ফলে দলটির দরজা সবার জন্য খোলা। এই খোলা দরজা দিয়ে ভালো-মন্দ সব লোকই দলটিতে ঢুকেছে। দলটি একাদিক্রমে তিন টার্ম ক্ষমতায় রয়েছে। তাতে সুবিধাবাদীদের এই দলে ঢোকার আগ্রহ আরো বেশি এবং তারা ঢুকেছে। তাদের কর্মকান্ডের জন্যই দলটির এত দুর্নাম।

এই দুর্নাম থেকে দলটিকে রাতারাতি মুক্ত করার সুযোগ শেখ হাসিনার সামনে ছিল না। দলের নেতৃত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কখনো ড. কামাল হোসেন, কখনো আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ স্বদলের ক্ষমতালোভী নেতাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ও দন্ডদানের কাজে বিএনপির বাধাদান ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। সবচেয়ে জটিল একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের বিচার ও শাস্তিদানের কাজে শেখ হাসিনাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হয়েছে দীর্ঘকাল। এই লড়াই চালাতে গিয়ে তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে বারবার। এমনকি তাঁকে জীবনের ওপর গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ হামলার মোকাবেলা করতে হয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত বিরোধী দলে অবস্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের গণতান্ত্রিক বিরোধিতা করেনি। করেছে হত্যা ও সন্ত্রাস দ্বারা শত্রুতার রাজনীতি। এ সময় বিএনপির একমাত্র স্লোগান ছিল-‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার। ‘শেখ হাসিনা তোমারে/বাপের মতো পাঠাব যমের দুয়ারে। শুধু হিংসাত্মক স্লোগান দেওয়া নয়, মাসের পর মাস সরকার উত্খাতের লক্ষ্যে রাজপথে বাস, লরিতে বোমাবাজি করে, আগুনে জীবিত মানুষ পুড়িয়ে মেরে তারা উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চেয়েছে। আফগানিস্তান থেকে পলাতক সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানের সাহায্যে বাংলাদেশে এলে তাদের ধ্বংসাত্মক কাজে লাগিয়ে বিএনপি-জামায়াত স্বাধীন বাংলাদেশের যে সর্বনাশ করতে চেয়েছিল, হাসিনা জীবন বাজি রেখে তা ব্যর্থ করেছেন। দীর্ঘকাল লড়তে হয়েছে এ জন্য।

সবচেয়ে বড় যুদ্ধ তাঁকে করতে হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের শাস্তি দেওয়ার কাজে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচন্ড বিরোধিতা, মিথ্যা প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে যে শ্রম ও সময় শেখ হাসিনাকে ব্যয় করতে হয়েছে, বছরের পর বছর যে ধৈয্যের পরিচয় তাঁকে দিতে হয়েছে, তার কোনো তুলনা নেই। তার ওপর সাইক্লোন, বন্যা, খরা ও মঙ্গার সঙ্গেও তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তাঁর আমলেই খাদ্যঘাটতির দেশ হয়েছে উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশ। ঢাকা হয়েছে উড়াল সেতুর শহর। বিশ্বব্যাংকের প্রচন্ড অসহযোগিতা সত্তেও সম্ভব হয়েছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ।

পাকিস্তানের টেলিভিশনে সম্প্রতি এক টক শোতে এক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘পাকিস্তান যদি শেখ হাসিনার মতো একজন প্রধানমন্ত্রী পেত, তাহলে বহু আগে দেশটির অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কলকাতার একটি দৈনিকে এক কলামিস্ট লিখেছেন (লেখাটি আমার হাতের কাছে নেই), একটি দারিদ্র্যক্লিষ্ট অনুন্নত দেশকে কিভাবে ধীর ও মন্থরগতির গণতন্ত্র দ্বারা দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করা যায়, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

শেখ হাসিনা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন বটে; কিন্তু তা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রোগ, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বন্যা, খরা, সাইক্লোন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট সময় নয়। উন্নয়নের কাজে তাঁর দরকার ছিল গঠনমূলক সমালোচনার সঙ্গে বিরোধীদের সহযোগিতা। এই সহযোগিতার বদলে তিনি বিরোধিতা পেলেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে পেয়েছেন শত্রুতা। এই শত্রুতায় হাত মিলিয়েছে দেশের সুধীসমাজ নামধারী আঁতেল শ্রেণি এবং তাদের পোষা একটি মিডিয়া গ্রুপও।

যে বিরোধিতা, শত্রুতা, মিথ্যা প্রচার ও প্রপাগান্ডার ব্যূহ ভেদ করে, একে একে শক্তিশালী শত্রু দমন করে শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনা করতে হয়েছে এবং হুেছ, তা সম্ভবত রামায়ণের রাবণ বধের কাহিনীকে হার মানায়। শেখ হাসিনার মনস্তুষ্টি বা মোসাহেবির জন্য লিখছি না। এ কথাগুলো লিখছি নিজের বিস্ময়াপ্লুত মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য। আওয়ামী লীগের কোনো দোষত্রুটি নেই, এ কথা বলছি না। আওয়ামী লীগের অনেক দোষত্রুটি আছে। দুর্নীতি, অপশাসন আছে। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে মহা মহীরুহের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন শেখ হাসিনা। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের ছায়া পড়েছে। আওয়ামী লীগকে এ কথা বুঝতে হবে। শেখ হাসিনার ক্যারিসমেটিক নেতৃত্বের ছায়া আওয়ামী লীগের মাথার ওপর ছাতার মতো আছে। নইলে গোত্র দ্বন্দ্ব, লোভ, দুর্নীতিতে ভরপুর আওয়ামী লীগের বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে তাকেও বিএনপির মতো রাজনৈতিক অগস্ত্য যাত্রায় যেতে হতো।

দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলন সামনে নিয়ে আওয়ামী লীগের আত্মশোধনের এটাই শেষ সুযোগ ও সময়। হাসিনা তিন টার্ম ক্ষমতায় থেকে প্রায় গোটা সময়টাই সন্ত্রাস ও স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাটিয়েছেন। তার বিবরণ ওপরে দিয়েছি। এত দিনে তিনি দুর্নীতির মতো পরম শত্রু নিধনে মনোযোগ দিতে পেরেছেন, সময় দিতে পেরেছেন। স্বাধীনতার শত্রুদের মতো দলের ভেতরের-বাইরের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তিনি কঠোর ও আপসহীন। তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণে দয়াদাক্ষিণ্য দেখাননি।

এই শুদ্ধি অভিযান আইওয়াশ নয়। কেউ কেউ বলছেন, এই অভিযানে বড় বড় রাঘব বোয়ালকে এখনো ধরা হয়নি। তাদের বলি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। বাংলাদেশে জিয়া-এরশাদ-খালেদার কৃপায় কায়েমি স্বার্থের যে ঘাঁটি গড়ে উঠেছে, তার ভিত্তি অত্যন্ত শক্ত। রাতারাতি ভাঙা যাবে না। রাতারাতি ভাঙতে গেলে যিনি ভাঙতে যাবেন, তাঁকেই নিকেশ হতে হবে। ইতিহাস তা-ই বলে। হাসিনা কুশলী যোদ্ধা। কী করে দু-পা এগোনোর জন্য এক পা পেছাতে হয়, সে কৌশল তিনি জানেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের জন্য তিনি কি ধীরগতির কৌশল গ্রহণ করে জয়ী হননি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তাঁর কৌশল হবে ধীরগতির; কিন্তু অব্যর্থ লক্ষ্যে পৌঁছার।

শেখ হাসিনার এই শুদ্ধি অভিযান সফল করার জন্য তাঁর পেছনে একটি সুসংগঠিত, শক্তিশালী এবং দুর্নীতির কলঙ্কমুক্ত আওয়ামী লীগের অবস্থান দরকার। এবারের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের সম্মেলনে সেই আওয়ামী লীগ গড়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি অথর্ব, অকর্মণ্য, লোভী, দুর্নীতিবাজ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের তাড়িয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক নতুন মুখ আনতে চান। খবরে সে কথাই বলা হয়েছে। সম্ভাব্য নতুন মুখের মধ্যে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজনের নাম দেখে খুশি হয়েছি। এঁদের মতো লোক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এলে শেখ হাসিনা দলটাকে নতুনভাবে সাজাতে পারবেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতার শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধির জন্য সংগঠনটির পুনর্গঠন প্রয়োজন।

তাই বলে দল পুনর্গঠনের নামে পুরনো সব নেতাকে সরিয়ে দিয়ে শুধু নতুন মুখ আনলে দলে অভিজ্ঞ ও কুশলী রাজনীতির অনটন দেখা দেবে। আওয়ামী লীগকে উপদেশ দেওয়ার অধিকার আমার নেই। তবু বলছি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন মুখ নেওয়ার ব্যাপারেও দেখতে হবে তাঁরা সৎ ও নীতিপরায়ণ চরিত্রের অধিকারী কি না। পুরনোদেরও রাখার ব্যাপারে ক্রাইটেরিয়া হওয়া উচিত, তাঁরা এত দিন সৎ রাজনীতি করেছেন এবং নিজের চরিত্র অবিতর্কিত রেখেছেন কি না। ফেরেশতা খোঁজার দরকার নেই। তাহলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। দেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখন সবচেয়ে বড় মূলধন। এই মূলধন রক্ষা এবং জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য আওয়ামী লীগের যে আত্মশোধনের প্রয়োজন, এবারের জাতীয় কাউন্সিলের পর দলটি সে পথেই পদক্ষেপ নেবে বলে আমার আশা।
বিএনপি তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনে নামার কথা ভাবছে। আইনি লড়াই তারা অবশ্যই চালাতে পারবে। কারণ তাদের অর্থের জোর আছে। কিন্তু রাজপথে আন্দোলন চালাতে গেলে জনসমর্থনের জোর থাকা দরকার। সেটা তাদের আছে কি না তা সম্ভবত আগে যাচাই করে নেওয়া দরকার। নইলে আগের মতো ফিয়াসকো হতে পারে। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস চালানোর শক্তিও এখন তাদের নেই। হুমকি আর শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে পার্থক্য অনেক।

লেখক: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। লন্ডন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা