• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

রুপসা ঘাট দিয়েই মুত্তিযোদ্ধাদল প্রথম খুলনা শহরে প্রবেশ করে।

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

আগেই বলেছি সেই বৃটিশ আমল থেকেই ভারতের দার্জিলিং ও সিমলার মত একটি টয় ট্রেন অর্থাৎ ন্যারো গেইজ রেল লাইন চালু ছিল পুর্ব রুপসা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত।বাগেরহাট,পিরোজপুর সহ আশে পাশের জেলা গুলি থেকে যাত্রীরা ঐ ট্রেনে করে পুর্ব রূপসা ঘাট দিয়ে প্রতিদিন রুপসা নদী পার হয়ে খুলনা শহরে প্রবেশ করতেন ও ফিরতেন ।সে কারণে পুর্ব রূপসা রেল স্টেশন সহ রূপসা ঘাট ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যারা ১৯৭১ এর মার্চ মাসে রুপসা রেল ষ্টেশনের স্টেশন মাস্টার জনাব আতিয়ার রহমান সাহেবের অফিস রুমকে খুলনা শহর থেকে পার হয়ে আসা আনাসারদের রাইফেল সংগ্রহ করে অস্ত্র ভান্ডার গড়ে তুলে ছিলাম তারা আবার ডিসেম্বারের ১ম সপ্তাহে রূপসাতে জড়ো হয়েছিলাম।
ভারতীয় বাহিনী সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহন করার পর থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বরের বেশ কয়েকদিন আগেই যশোর মুক্ত হয়ে যায়।যশোরের দিক থেকে মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সাড়াশি আক্রমনের মুখে পাকিস্তান বাহিনী টিকতে না পেরে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পাকিস্থান বাহিনী খুলনার দিকে পিছু হাটতে থাকে। পিছু হাটতে হাটতে তারা শিরোমনিতে এসে পৌছলে খুলনায় আবস্থানরত পাকিস্তান বাহিনীও তাদের সাথে মিলিত হয়ে তারা আকত্রে আত্বরক্ষার প্রচেষ্টা চালায়।এতে মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সাথে পকিস্তান বাহিনীর এ স্থানে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ হয়। শিরোমনির যুদ্ধে গোলার আঘাতে এ এলাকার প্রত্যেকটা নারকেল ,সুপারি বা লম্বা লম্বা গাছে বড় বড় ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ও বহু বছর যাবত এ সব গাছ্গুলিতে গোলার আঘাতের ক্ষতচিহ্নগুলি দৃশ্যমান ছিল। আমার যতদুর মনে পড়ে ১২ই ডিসেম্বরের পর থেকেই ভারতীয় বিমান থেকে ছিটানো লিফলেটে খুলনার আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান বাহিনীকে আত্বসমর্পনের জন্য ফিল্ডমার্শাল মানিক শ এর তরফ থেকে আহবান জানানো হয়েছিল ঐ লিফলেট এ। অন্যদিকে স্বাধিন বাংলা বেতার সহ বিদেশী বেতারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হওয়ার খবর আসতে থাকলোএবং বিমান থেকে ও পাকিস্থান বাহিনীর উপর গোলা বর্ষন করে পাকিস্থান বাহিনীকে কাবু করা হয়েছিল। শিরমনিতে এ সম্মুখ যুদ্ধের কারনে খুলনার পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে মুক্তি বাহিনীর ১৬ ডিসেম্বর খুলনা শহরে প্রবেশ করা কষ্ট সাধ্য ছিল। তাই খুলনা শহরের পূর্ব ও উত্তর অঞ্চল দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের খুলনা শহরে প্রথম প্রবেশ করা সহজতর ছিল।
ডিসেম্বর মাসের বেশ আগে থেকেই খুলনা শিপইয়ার্ডের ঘাটে একটা বড় জাহাজ নোঙ্গর করা ছিল। কিসের জাহাজ ছিল তা আমরা জানি না, তবে ৭ বা ৮ ডিসেম্বর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এই জাহাজের উপর বোমারু বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করা হত। ১৬ ই ডিসেম্বরের আগেই বার বার গোলার আঘাতে জাহাজটিকে ঐখানেই ডুবিয়ে দেয়া হয়। বিমান থেকে আত্বসমর্পনের আহবান সম্বলিত জেনারেল মানিক শ এর লিফলেট ছড়ানো ও বোমারু বিমান থেকে জাহাজের উপর গোলা বর্ষনের পর থেকে রুপসার বিহারী রাজাকার গ্রুপ কাবু হয়ে পড়ে এবং দেশীয় রাজাকারেরা আমদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে ফজলু ভাই এর নেতৃত্বে আমরা বাগমারা, রহিমনগর.রামনগর, ইলাইপুর, নিকলা্নগর,এবং রূপসার বিহারী রাজাকারদের আটক করে ফেলি। এই সব রাজাকারদেরকে আমরা বাগমারার ‘হামিদা মঞ্জিল”এর ছাদের চিলেকোটার ঘরে আটকিয়ে রাখি।মানিক মোল্লা দ্রুতার সাথে কোথা থেকে একটা স্বাধীন বাংলা পতাকা যোগাড় করে আনার পর আমি একটা বাঁশের মোটা কঞ্চির মাথায় পতাকাটি বেঁধে হামিদা মঞ্জিল এর উপর উড়িয়ে দেই। এই হামিদা মঞ্জিল ছিল বাগমারার অচীনতলা মাদ্রাসার পূর্বেদিকে এবং পূর্ব রুপসা পুরাতন পোস্ট অফিস(তানসেনদের বাড়ী) এর বিপরিতে রেলওয়ের অধিগ্রহনকৃত এবং জনাব মোসলেম মৌলবী(এডভোকেট মোস্তাক এর বাবা) সাহেবের মালিকাধীন একটি পরিত্যাক্ত দেতালা বিল্ডিং। এ বিল্ডিংটি ছিল এ অঞ্চলের রাজাকার ক্যম্প।মাত্র কয়েক বছর আগে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ দোতালা বিল্ডিংটি ভেংগে ফেলেছে বলে জানা গেছে।
ঐ দিন সকাল ১০টায় খবর পেলাম আনন্দ নগরে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল উপস্থিত হয়েছে। আমরা যারা রুপসাতে অবস্থান করছি তারা ঐ দলের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে পুর্ব রুপসা ঘাট থেকে রুপসা নদী পার হয়ে রাজাকারদের রাইফেল নিয়ে খুলনা শহরে প্রবেশ করবো এ উদ্দেশ্যে তাদের সাথে যোগাযোগ করার পরিকল্পনা গ্রহন করলাম।।রাজাকারদেরকে হামিদা মঞ্জিলের’ দোতালার চিলে ঘরে আটকিয়ে রেখে এবং মানিক সহ কয়েকজনকে রাজাকারদেরকে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে ফজলু ভাই এর পরামর্শে আমি ও ডাঃ আখতার বাবু( আখতারের কিছুদিন আগে ও রুপসা বাজারের একটি ঔষধের দোকান ছিল) আনন্দ নগরের দিকে ছুটে গেলাম। আমরা আঠারোবাকি নদী পার হয়ে আনন্দ নগরে সরদার বাড়ীতে গিয়ে সাক্ষাৎ পেলাম গাড় সবুজ রঙের পোশাকে সজ্জিত একদল শসস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার। তারাই আমাদেরকে তথ্য দিল যে, কামরুজ্জামান টুকু ভাই এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দক্ষিন দিক দিয়ে পূর্ব রুপসার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং কিছক্ষনের মধ্যেই তারা সেখানে পৌছবে। তারা আমাদেরকে ফিরে গিয়ে ঐ দলের সাথে যুক্ত হতে বললেন।
আমি এবং বাবু হামিদা মঞ্জিলে ফিরে এলাম।ফিরে এসে দেখলাম বিল্ডিং চত্তরে বিপুল সংখ্যক জনগন জড়ো হয়েছে। তারা জানালো নৈহাটির তাছির সাহেবকে শত্রুতাবসত ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আটক করা হয়েছেএবং হামিদা মঞ্জিলের দোতালায় তার উপর শারিরীক নির্যাতন করা হচ্ছে। তাছির সাহেব ছিলেন নৈহাটী ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং তখনকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব আকবার সাহেব এ প্রাক্তন চেয়ারম্যান জনাব সুলতান সাহেবের প্রবল প্রতিদ্বন্ধী। বিল্ডিং এর নীচে অবস্থানরত স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানালো তাছির সাহেব গত নয় মাসে কারো উপর কোন অত্যাচার বা অন্যায় করেনি বরং অনেক হিন্দু পরিবারকে সহায়তা করেছে। অধিকাংশ জনগন বিশেষ করে কিসমত খুলনা গ্রামের জিনারুদ্দিন সাহেবের ছোট ভাই ছিলেন তাছির সাহেবের পক্ষের সমর্থকদের অন্যতম। তাছির সাহেবকে ছেড়ে দেয়ার জন্য তারা বিনীত অনুরোধ জানালো আমাদেরকে। আমি দোতালায় গিয়ে দেখি হামিদা মঞ্জিলের দোতালার ছাদের উপর তাছির সাহেবকে ফজলু ভাই একটি বাঁশের কঞ্ছি দিয়ে আঘাত করছে আর তাছির সাহেব নিজেকে নির্দোষ দাবী করে বলছে যে, সে প্রতিহিংসার শিকার। আমি ফজলু ভাইকে শান্ত করে সার্বিক বিষয়টি অবহিত করলাম। ফজলু ভাই আমাদের উপস্থিত সকলের সাথে আলোচনা করে তাছির সাহেবকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।তাছির সাহেবকে মুক্ত করে দেয়া হোল।তিনি মুক্ত হয়ে আমাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বিল্ডিং এর নিচে অবস্থানরত তার সমর্থকদেরকে নিয়ে মিছিল করে নৈহাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। তাছির সাহেবকে ছেড়ে দেয়ায় উপস্থিত স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শ্লোগান দিলেন। তাদের কেউ কেউ তাছির সাহেবের সংগ নিলেন ।
তাছির সাহেবকে ছেড়ে দেয়ার পরপরই হামিদা মজ্ঞিলের ছাদের উপর থেকে দক্ষিন দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পেলাম ধানক্ষেতের মধ্যে গাড়ো সবুজ রঙের পোশাক পরিহীত একঝাক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বিল্ডিং তাক করে অস্ত্র উচিয়ে আছে।এ দলের অগ্রভাগে আমি কামরুজ্জামান টুকু ভাইকে অস্ত্র তাক করে থাকতে দেখেই টুকু ভাই বলে চিৎকার করে উঠলাম।সাথে সাথে ছাদের উপরে থাকা আমাদের সকল সাথী টুকু ভাইদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চিৎকার করে উঠে এবং জয়বাংলা স্লোগান দিতে থাকে।আমরা টুকু ভাই সহ সকল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের উপরে আসার আহবান জানাই। টুকু ভাই ও শসস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জয় বাংলা শ্লোগান ও উল্লাসে উত্তেজিত ভাবে শ্লোগান দিতে দিতে দ্রুততার সাথে হামিদা মঞ্জিলের দোতালায় উঠে আসে এবং আমরা একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরি। শসস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও আমাদের সম্মিলিত জয়ধ্বনিতে শত শত স্থানিয় জনগন হামিদা মঞ্জিলে এসে উপস্থিত হয় এবং সৃষ্টি হয় এক অপরুপ দৃশ্যের। টুকু ভাই জানালো তারা মনে করেছিল বিল্ডিং এ রাজাকার বাহিনী সশস্ত্র অবস্থায় অবস্থান করছে ।তাই তারা দক্ষিণ বাগমারা গ্রামের গ্রামের ভিতর দিয়ে এসে চামটাখোলার দিকদিয়ে হামিদা মঞ্জিলের দক্ষিণে ধানের ক্ষেতের মধ্যে অবস্থান নিয়েছিল।হামিদা মজ্ঞিলের দোতালার চিলেকোঠায় আটককৃত রাজাকারদেরকে কি করা হবে সে বিষয়ে আমরা টুকু ভাই গ্রুপের সাথে আলোচনায় বসি। কামরুজ্জামান টুকু ভাই রাজাকারদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ফজলু ভাই এবং আমাদের উপর ছেড়ে দিলেন। আমরা রাজাকারদের মধ্যে নটোরিয়াস বিহারী রাজাকার সুলতান এবং অপর দুজন বিহারী শাহজাহান ও মুরাদকে টুকু ভাই এর নিকট হাওলা করে তাদের ঘাড়ে আটককৃত রাজাকারদের থ্রি নট থ্রি রাইফেলগুলি তুলে দিয়ে টুকু ভাই এর সাথে পাঠিয়ে দিলাম। অন্যান্য স্থানীয় রাজাকার তাদেরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আমাদেরকে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। আমরা নিজেদের মধ্যে ও উপস্থিত স্থানীয় জনসাধারনের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে রাজাকারবৃন্ধ এলাকা ছেড়ে যাবে না এ শর্তে তাদেরকে সাময়িক ভাবে মুক্ত করে দিলাম। টুকু ভাইয়ের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল বিহারী রাজাকার ও তাদের রাইফেল সহ খুলনা শহরের উদ্দেশ্যে রুপসা নদীর ঘাটের দিকে রওনা দিলেন। তাদের সাথী হল শত শত স্থানীয় জনগনও আমরা এবং স্বধিীন বাংলার পতাকা। এভাবেই ১৬ ই ডিসেম্বর,১৯৭১ এ আমাদের পূর্ব রুপসা ঘাট এবং খুলনা শহরের উত্তর পাড় দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম খুলান শহরে প্রবেশ করে । এবং সে দিন থেকেই শুরু হল আমাদের বিজয় আনন্দ। ১৬ই ডিসেম্বর রাত্রে রহমতউল্লাহ দাদু ভাই এর নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী, টুকু ভাই এর বাহিনী ও অনান্য মুত্তিযোদ্ধারা খুলনা রেডিও ষ্টেশন আক্রমন করে রেডিও ষ্টেশন দখলে নিয়ে নেয়। এ সময় শিরোমনির যুদ্ধ ও শেষ হয় এবং ১৭ই ডিসেম্বর খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে পাকিস্তান বাহিনী আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্বসমর্পণ করে। ১৭ই ডিসেম্বর,১৯৭১ খুলনা পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে যায়।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা