• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

পরিবার গ্রহণ না করলেও হার মানেননি সৌদিফেরত ৭ নারী

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০২০  

অনেক আশা বুকে বেঁধে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরব যান ডালিয়া। কিন্তু নিয়োগকর্তার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। একপর্যায়ে তিনতলা বাড়ির ওপর থেকে লাফিয়ে নিচে পড়েন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার মেরুদণ্ড। দেশে ফেরার পর স্বামীর বাড়িতে জায়গা হয়নি। বিচ্ছিন্ন হন পরিবার থেকেও। তবু হার মানেননি ডালিয়া। তিনিসহ তার মতো আরও ছয় সৌদিফেরত নির্যাতিত নারী মিলে ব্র্যাকের সহযোগিতায় শুরু করেছেন ‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং সার্ভিস’। বুকে কষ্ট থাকলেও মুখে হাসি নিয়ে এই সাত নারী চালাচ্ছেন এই ক্যাটারিং সার্ভিস। 

রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখান এলাকায় একটি বাসার নিচতলায় চলছে ‘ধ্রুবতারা ক্যাটারিং সার্ভিস’। সেখানে রুম আছে তিনটি। এর একটিতে রান্নার সরঞ্জাম রাখা হয়, আরেকটিতে হয় রান্না। তৃতীয় রুমে থাকেন এই সাত নারী।

ডালিয়া জানান, সকাল ৭টা থেকে রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ১১টার মধ্যে রান্না শেষ করে যে যার মতো বক্সে ভরে চলে যান গন্তব্যে। রাজধানীর প্রবাসীকল্যাণ ভবন, বনানী, খিলক্ষেত, উত্তরা, বিমানবন্দরসহ আশপাশের বিভিন্ন অফিস-মার্কেটে আসা লোকজনের কাছে বিক্রি করেন। খাবারের দাম ১০০-১২০ টাকার মধ্যে। সপ্তাহে এক একদিন একেক আইটেম থাকে। কোনোদিন ভাতের সঙ্গে মাছ, কোনোদিন মাংস। পাশাপাশি আছে ছোট মাছ, ভর্তা, ভাজি, আবার কোনোদিন খিচুড়ি। খাবার বিক্রির পর বাটি নিয়ে বিকেল গড়িয়ে ফেরেন। এরপর একে অন্যের সহায়তায় ব্যস্ত থাকেন তারা। প্রতিদিন খাবার বিক্রি হবে কিনা, এই অনিশ্চয়তা আছে। তবুও প্রবাসে গিয়ে ভাগ্য বদল করতে না পারা এই নারীরা নতুন করে ভাগ্য বদলের আশায় অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই কঠোর পরিশ্রম করছেন।

ডালিয়ারা জানান, কোনোরকমে তারা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকলেও পরিচ্ছন্নতায় কোনও ছাড় দেন না। খাবার তৈরির পুরো প্রক্রিয়া সারেন তারা অ্যাপ্রন, টুপি ও গ্লাভস পরে। পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা ব্র্যাকে।

ধ্রুবতারা চালু হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে। গত জানুয়ারিতে বেশ লাভ এসেছে বলে জানান ডালিয়া। লাভের ২ শতাংশ তারা ব্যাংকে জমা রাখেন। এই টাকা অসহায় নারীদের কাজে লাগানো হবে বলে জানান তারা। বাকি টাকা নিজেদের মধ্যে সমান ভাগ করেন নেন।

ধ্রুবতারা নিয়ে কথা বলার সময় পরিবারের কথায় আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন ডালিয়া। চোখ মুছে বলেন, ‘২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট দেশে ফেরত আসি। স্ট্রেচারে ভর দিয়ে হাঁটি। আমি ঝুঁকে কাজ করতে পারি না, তাই ম্যানেজারের কাজটা সামলাই। বাকিরা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। এক গ্লাস পানি লাগলেও আগায় দেয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখান ছাড়া আর থাকার জায়গা নাই। আমার স্বামী আমাকে বিদেশ পাঠাইলো, ফেরত আসার পর সেই আমাকে মেনে নেয় নাই। কিছু জায়গা থেকে অনুদান পাইছিলাম, সেগুলা সে নিজেই আত্মসাৎ করছে।’

বাকি ছয় নারীকেও তাদের পরিবার গ্রহণ করেনি। তবে তারা জানান, তারা তাদের এই নতুন জীবন বেশ উপভোগ করছেন। আয় যা হয় তাতে চলে যাচ্ছে সবার।

সৌদিফেরত এই সাত নারীর কিছু করার আগ্রহের কথা জেনে তাদের পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক। এককালীন ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকার সামগ্রী কিনে দেয় সংস্থাটি। নির্যাতনের শিকার এই নারীদের দেশে ফেরত আনতে আবেদন তৈরি ও মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর কাজে সহায়তা করেছিল ব্র্যাক। দেশে ফিরে বিমানবন্দরে নেমেই তাদের সঙ্গে কথা হয় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মীদের সঙ্গে। বিমানবন্দরে দেওয়া হয় জরুরি সহায়তাসহ বিভিন্ন তথ্য। এরপর ব্র্যাক তাদের আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘ধারাবাহিক কাউন্সিলিংয়ের পর এই নারীরা বলেন, তারা কিছু একটা করতে চান। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা জানান, তারা রান্না-বান্নার কাজ ভালো পারেন। এরপর প্রত্যেকের জন্য ৬৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করি। শুরু করেন তারা নতুন লড়াই।’  ডালিয়া জানান, তাদের কথা জানতে পেরে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে স্কয়ার গ্রুপ সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রবিবার (৮ মার্চ) বেলা ৩টায় স্কয়ার নিট কোম্পানিজ লিমিটেডে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই সম্মাননা দেওয়া হবে।

ডালিয়া বলেন, ফেসবুকে ধ্রুবতারা ক্যাটারিং সার্ভিস নামে একটি পেজ আছে। এছাড়া খাবারের অর্ডার নিতে একটি হটলাইন নম্বর (০১৭৪১৫১৩৩৩০) চালু করেছেন তারা। এই নম্বরে ফোন দিলেই খাবার পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য খাবার সরবরাহ করে ধ্রুবতারা ক্যাটারিং সার্ভিস।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা