• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

দূর্যোগে দূর্ভোগ, তবুও লড়াই করে বেঁচে আছে কয়রাবাসী

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারি ২০২০  

বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের কোলঘেষা খুলনার সর্ব দক্ষিনের জনপদ কয়রা উপজেলা। চারিদিকে নদী বেষ্টিত হওয়ায় বার বার প্রাকৃতিক দূর্যেোগে বিপর্যস্ত হয়ে এখানকার মানুষ। তবুও সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আইলা, সিডরের পর সর্বশেষ বুলবুলের আঘাতে ক্ষতের আঘাত এখনও বিদ্যামান। ঘরবাড়িহারা মানুষগুলো এখনও স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারেনি। অনেকেই নদীর বাঁধের উঁচু স্থানে ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছেন। 

সেখানকার কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ধরে সোনাপাড়া এলাকায় যেতে চোখে পড়ে বেড়িবাঁধের ওপর সারি সারি কুড়ে ঘর। গোলপাতা, খড় আর মাটির তৈরি ঘরগুলো আইলায় সবকিছু হারা মানুষের। বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছে ৫০টিরও বেশি পরিবার। এদেরই একজন ছবিরন বিবি। একমাত্র মেয়ে রোজিনা খাতুন আর দুই নাতীকে নিয়ে বাঁধের ওপর তার সংসার। ছবিরন বিবির মেয়ে রোজিনার স্বামী আইলার পর অভাব অনটনের কারণে দু’সন্তানকে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। রোজিনা তার ১২ বছরের ছেলে রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছেন ইটের ভাটায়।

আর ১০ বছরের নাতি সাদিয়াকে নিয়ে ছবিরন বিবি আছেন ঘরটিতে। কিন্তু কিছুদিন আগের ঘূর্নিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে ঘরের একপাশের চাল উড়ে গেছে। চালের খোলা অংশে পলিথিন দিয়ে কোনো রকমে বসবাস করছেন দু’জন। জানতে চাইলে ছবিরন বিবি জানান, মেয়ে ইটের ভাটা থেকে ফিরে আসলে ঘর ঠিক করা হবে।

ছবিরন বিবির ঘরের সঙ্গেই আব্দুর রহমানের ঘর। পাঁচ সদস্যের পরিবারটি আইলার পর থেকেই রাস্তার ওপর বসবাস করছে। এক সময় জমিসহ নিজের বসতঘর ছিল। কিন্তু আইলা সব কেড়ে নিয়েছে। পাশের কপোতাক্ষ নদের মাছ ধরেই এখন সংসার চলছে তার।

ছবিরন বিবি, আব্দুর রহমানের মতো কয়রা উপজেলায় আইলার পর সবকিছু হারিয়ে বাঁধের ওপর ঘর তৈরি করে বাস করছে পাঁচ শতাধিক পরিবার। ৪ নম্বর কয়রার পুরোনো লঞ্চ ঘাট এলাকা, ৬ নম্বর কয়রা, দক্ষিণ বেদকাশী ও মহেশ্বরীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার অনেকেরই বসবাস বাঁধের ওপর।

এভাবে লড়াই করেই টিকে থাকতে হচ্ছে কয়রা উপজেলাবাসীকে। বাঁধ ভাঙার আতঙ্ক আর তীব্র পানি সংকট দিন দিন তাদেরকে হাপিয়ে তুলছে। এলাকাবাসী বলছেন, এই সময় বেড়িবাঁধ ঠিক না হলে অচিরেই নোনা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে উপকূলীয় এ উপজেলা।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্নিঝড় সিডরের প্রভাব খুব বেশি পড়েনি এ উপজেলায়। তবে ২০০৯ সালের ২৫ মে এ জনপদকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আইলা। সেদিন পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭ পয়েন্ট ভেঙে গোটা উপজেলা নোনা পানিতে তলিয়ে যায়। প্রাণ হারায় ২৬ ব্যক্তি।

আইলায় কয়রার সাত ইউনিয়নের ৪৩ হাজার পরিবারের মধ্যে সাড়ে ৩৮ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ২১১ হেক্টর জমির শস্য, ২০ হাজার ৩০০ একর মাছের ঘের, ৮০ কিলোমিটার নদীর বাঁধ, ১০৮ কিলোমিটার সড়ক ও এক হাজার ১০৩টি খাবার পানির উৎস নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘদিন নোনা পানি আটকে থাকায় অনেক গাছপালা মরে যায় ও জমিতে লবণ ফুটে ওঠে।

এ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ফণী, বুলবুলের মতো আরও কয়েকটি বড় ঝড়। ফণীর আঘাতে তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও ‘মরার ওপর খড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। তবে সব ছাড়িয়েও আইলার ক্ষত দগদগ করছে এ এলাকার মানুষের মনে।

কয়রা উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বুলবুলের তাণ্ডবে উপজেলার সাত ইউনিয়নের দুই হাজার ৩০০ ঘরবাড়ি একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে যায়। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় চার হাজার ৮০০ ঘর। এক হাজার ৭২০ হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর তিন হাজার ২৬০টি মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে যায়, যার আয়তন প্রায় ৩ হাজার ৩০০ হেক্টর।

লবণাক্ততার কারণে উপজেলা জুড়ে রয়েছে খাবার পানি সংকট। উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ খাবার জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখে। কোনো কোনো এলাকায় খাওয়ার পানির একমাত্র উৎস পুকুর। এলাকা ঘুরে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইলাতে বেশিরভাগ পুকুরেই নোনা পানি ঢুকে যায়। এরপর অনেক পুকুরের পানি আর পান করার উপযোগী হয়নি। কয়েকটি পুকুর সংস্কার করেও পানির লবণাক্ততা কাটেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘেরে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ।

উপজেলার অনেকেরই অভিযোগ, মিঠা পানির পুকুরে চুইয়ে চুইয়ে ঘেরের লবণপানি প্রবেশ করে পুকুরের পানিকে লবণাক্ত করে দিচ্ছে। এমন পুকুরের সংখ্যা প্রায় ২০টি। কালনা গ্রামের আসাদুল ইসলাম হাওলাদার জানান, আইলার পর সব পুকুরের পানি নোনা হওয়ায় পানি সংকট বেড়েছে। বর্ষাকালে পানি পাওয়া গেলেও গ্রীষ্মের ৫/৬ মাস পানির অভাব থাকে তীব্র।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম শামসুর রহমান জানান, আইলার পর এ ইউনিয়নে তেমন কিছুই ছিল না। ইউনিয়নে মাত্র ১ শতাংশ গাছ বেঁচে ছিল। দীর্ঘদিন ধরে মানুষ বসবাস করেছে বাঁধের ওপর ও আশ্রয় কেন্দ্রে।

সব কিছু কাঁটিয়ে যখন মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে তখন আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। ওই ঝড়ে সাড়ে ৮০০ এর বেশি ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক হাজার ৮০০টির বেশি ঘর। এ ইউনিয়নের সাড়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৫ কিলোমিটার অতি ঝুঁকিপূর্ণ আর আট কিলোমিটার বাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। যেখান দিয়ে মোটরসাইকেল পর্যন্ত যেতে পারে না।

কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল গফফার ঢালি জানান, বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনীহা রয়েছে। নামমাত্র বাঁধ সংস্কার হয়, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তারা কাজটা করে না। যে পয়েন্টে বাঁধ ভাঙে, সেখানে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার হয়। কিছুদিন পর আবার অন্য অংশে ভাঙন দেখা দেয়।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম জানান, কয়রায় এখন বেড়িবাঁধ আর খাবার পানির সমস্যা প্রকট। কোনো এক সকালে হয়ত দেখতে হবে কয়রা উপজেলা আবারও পানির নিচে। নভেম্বরের দিকে উপজেলায় বাঁধের ওপর থাকা প্রায় আড়াইশ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাঁধ সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তাদাগা দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় দ্রুত সময়ের মধ্যে কয়রায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
 

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা