• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

এলপি গ্যাসের দাম বাড়ছে হুহু করে

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০১৮  

গত পাঁচ বছরে বাসাবাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, আবাসিক খাতে আর কখনও পাইপলাইনে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া হবে না। সরকারের যুক্তি হলো, উন্নত বিশ্বে এভাবে কোনো বাসায় গ্যাস দেওয়া হয় না। সেখানে রান্নায় ব্যবহার করা হয় সিলিন্ডারভর্তি এলপিজি বা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস। তা ছাড়া দেশে গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে আসছে। ফলে দেশে এলপিজির ব্যবহার সহজলভ্য করতে হবে। গ্যাসের সংযোগ বন্ধের সময়ে সরকার ঘোষণা করেছিল যে এলপিজি সহজলভ্য করা হবে, যাতে কম খরচে যে কেউ এটা ব্যবহার করতে পারে। বাস্তবতা হলো, এলপিজির দাম হুহু করে বাড়ছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো কার্যকর ভূমিকাও দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের বড় বড় শহরে রান্নায় পাইপলাইন গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। যারা দুই চুলা ব্যবহার করেন, তাদের মাসে বিল দিতে হয় ৮০০ টাকা। পাইপলাইন নেটওয়ার্কবিহীন এলাকায় একটি ছোট পরিবারে রান্নার জন্য মাসে সাড়ে ১২ কেজির দুটি সিলিন্ডার লাগে। এ জন্য তাদের গুনতে হয় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। সরকারের দায়িত্বশীলরা বহুবার ঘোষণা দিয়েছেন যে রান্নার গ্যাস ব্যবহারে এ বৈষম্য দূর করা হবে। এলপি গ্যাসের দাম যেভাবেই হোক কমানো হবে, যাতে কোনো বৈষম্য না থাকে।  হাতিরপুল এলাকার নতুন বাড়িওয়ালা ফজলুর রহমান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানালেন, তিনি নতুন বাড়ি করেছেন। তিতাস সেখানে গ্যাস সংযোগ দেয়নি। শুধু গ্যাস না থাকার কারণে ফ্ল্যাট বিক্রিতে হিমশিম খাচ্ছেন। সিলিন্ডার গ্যাসের অনেক দাম। পাশের পুরনো বাড়িতে গ্যাস সংযোগ রয়েছে, যেখানে মাসে ৮০০ টাকা দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ সারছেন। কিন্তু সিলিন্ডারে খরচ মাসে তিন গুণ। একই দেশে একই স্থানে এভাবে বৈষম্য চলতে পারে না। কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে চা বিক্রি করেন ফারুক। চায়ের পানি ফুটাতে তিনি ব্যবহার করেন সিলিন্ডার গ্যাস। আগে এ কাজ করতেন কেরোসিনের স্টোভে। খরচ হতো প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। এখন একটি সাড়ে ১২ কেজির এলপি গ্যাস সিলিন্ডার চলে ১০ থেকে ১২ দিন। মাসে খরচ হয় প্রায় তিন হাজার টাকা। ফারুক জানান, কেরোসিনের চেয়ে গ্যাস লাভজনক। এতে খরচ কম। কালি ও ধোঁয়া হয় না। তবে এক মাসের ব্যবধানে সিলিন্ডারপ্রতি গ্যাসের দাম ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফারুক যে গলিতে চা বিক্রি করেন, সেখানে ভ্রাম্যমাণ চা ও খাবারের ১৫টির মতো দোকান রয়েছে; যার অধিকাংশই এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে। এভাবে দেশজুড়ে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। পরিবহন খাতেও এলপিজির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩০টি এলপিজি ফিলিং স্টেশন গড়ে উঠেছে।  সংশ্নিষ্টরা জানান, গত পাঁচ বছরে এলপি গ্যাসের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। এখন বছরে প্রায় আট লাখ টন এলপিজি ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবহার বাড়লেও এ খাতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই উপযুক্ত তদারকি ব্যবস্থা। বাজার পুরো বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দখলে। মোট চাহিদার ৯৮ শতাংশই সরবরাহ করছে তারা। সরকার শুধু লাইসেন্স দেওয়ার মধ্যেই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রেখেছে। দাম নির্ধারণের এখনও কোনো নীতিমালা প্রণীত হয়নি। এলপি গ্যাসকে সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে পরিকল্পনা থাকলেও নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় আইনি কোনো কাঠামো নেই। যদিও সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ আবাসিক জ্বালানি চাহিদা এলপি গ্যাসের মাধ্যমে মেটানোর ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশে সাড়ে ১২ কেজি, ৩০ কেজি, ৩৫ কেজিসহ বিভিন্ন মাপের সিলিন্ডারে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়। এর মধ্যে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহূত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে সাড়ে ১২ কেজির প্রতিটি সিলিন্ডার গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। গত অক্টোবর থেকে ডিলার পর্যায়েই সিলিন্ডারপ্রতি এলপি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ৯৯৫ টাকা দরে। ভোক্তা পর্যায়ে তা বেড়ে এক হাজার ২০০ টাকা হয়েছে। এলপিজি ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেখাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের কাঁচামাল ও সিলিন্ডার তৈরির উপাদানের মূল্য বাড়ছে। ফলে গ্যাস বিক্রিতে তাদের লোকসান হচ্ছিল। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দেশের বাজারে দাম বাড়াতে হয়েছে। এলপিজি উৎপাদনে সরকারের অবদান খুবই কম। খাতা-কলমে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য ৭০০ টাকা। কিন্তু গ্রাহকরা এই দামে সরকারি সিলিন্ডার কখনও পান না। তাদের বেশি দামেই কিনতে হয়।  অবশ্য পাশের দেশ ভারতেও এলপিজির দাম সামান্য বেড়েছে। কলকাতায় অক্টোবরে ১৪.২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হতো ৯০৭ রুপিতে। নভেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৯৬৩.৫০ রুপি। তবে ভারতে এলপিজি খাতে সরকার গ্রাহক পর্যায়ে ভর্তুকি দেয়। দেশটিতে নিবন্ধিত প্রতিটি পরিবার ভর্তুকিসহ বছরে ১২টি এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে পারে। বাংলাদেশে ভর্তুকির বিষয়টি সরকার নাকচ করে দিয়েছে।

দেশের অন্যতম এলপি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওমেরা গ্রুপ। তাদের কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা তিন লাখ টন। সরবরাহ করে সর্বোচ্চ পৌনে দুই লাখ টন এলপি গ্যাস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শামসুল হক জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের কাঁচামালের (বিউটেন/প্রপেন) দাম বেড়েছে। বেড়েছে সিলিন্ডারের উৎপাদন খরচও। গত এক বছরে কাঁচামালের দাম প্রতি টনে ২৯০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। এতে তাদের টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দাম বাড়ানো হয়েছে। সংশ্নিষ্টদের তথ্যমতে, দেশে এলপির দাম বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ পরিবহন খরচ। দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর গভীরতা কম হওয়ায় এলপির কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা হয়। আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টনের জাহাজে করে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এতে খরচ বেশি। দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকলে একবারেই ৪০ হাজার টনের জাহাজে এলপিজির কাঁচামাল আসত, এতে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম বর্তমানের চেয়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কম হতো।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেছেন, এলপিজির খুচরা মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। কোম্পানিগুলো একেক দামে ডিলারের কাছে গ্যাস বিক্রি করছে। ডিলাররা ইচ্ছামতো লাভ ধরে গ্রাহক পর্যায়ে তা সরবরাহ করছেন। তিনি বলেন, সরকারের সঠিক উদ্যোগ নিলে এলপিজির দাম সাধারণের নাগালে নেমে আসবে। জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এলপিজি হবে বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানি। এর বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাজার কীভাবে/ কার মাধ্যমে তদারক করা হবে, তা নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এটা কি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দেখবে, না জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকবে- তা ঠিক হয়নি। এ জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কাজ আটকে আছে। তিনি আরও জানান, কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। তখন বড় জাহাজে এলপিজি আমদানি সম্ভব হবে। ফলে দাম আরও কমবে।  পাইপলাইনের গ্যাসের সংকট ও নতুন সংযোগ প্রদান বন্ধ থাকায় এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। মানুষের গড় আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত জ্বালানি লাকড়ির পরিবর্তে অনেক পরিবার রান্নার কাজে এখন এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মতে, এখন দেশে বছরে আট লাখ টনের মতো এলপিজি সরবরাহ করা হচ্ছে, যা প্রতিবছর বাড়ছে। উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে জাহাজে করে এলপি গ্যাস এনে দেশের প্ল্যান্টে বোতলজাত করে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করে। বর্তমানে একটি সরকারিসহ ১৫টির মতো কোম্পানি এলপি গ্যাস সরবরাহ করছে। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি সরাসরি গ্যাসের কাঁচামাল আনে। নিজেরাই সিলিন্ডার উৎপাদন করে এলপিজি বোতলজাত করে। অনেকে বড় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনে সিলিন্ডারে বিক্রি করে। কেউ কেউ সিলিন্ডারও বিদেশ থেকে আমদানি করে। 
সরকার প্রায় ৫৫টি কোম্পানিকে এলপি গ্যাস সরবরাহের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে। বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তর থেকে ৭৫ জন উদ্যোক্তা এ-সংক্রান্ত লাইসেন্স নিয়েছেন। কিন্তু বাজারে মাত্র ১৫ কোম্পানি রয়েছে। অধিকাংশ উদ্যোক্তাই ব্যবসা শুরু করেনি বলে জানা গেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মোংলায় রয়েছে বসুন্ধরা, যমুনা, সেনাকল্যাণ সংস্থার সেনা এলপিজি, ওমেরা এলপিজি ও প্রেট্রিগ্যাজ (সাবেক ক্লিনহিট, বিদেশি কোম্পানি); চট্টগ্রামে রয়েছে সুপার গ্যাস (টি কে গ্রুপ), বিএম এনার্জি, প্রিমিয়ার এলপি (সাবেক টোটাল গ্যাস, বিদেশি কোম্পানি), বিন হাবিব, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ইউনিভার্সেল ইত্যাদি। নাভানা, ওরিয়ন, এনার্জিপ্যাক, বেক্সিমকোর মতো বড় প্রতিষ্ঠানও এলপি ব্যবসায় নেমেছে বলে জানা গেছে। দেশে ভবিষ্যতে এই জ্বালানির ব্যবসা বেশ জমজমাট হবে বলে অনেক উদ্যোক্তাই মনে করেন। 
একমাত্র সরকারি কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড বছরে ২০ হাজার টন এলপিজি সরবরাহ করে। দেশের তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি হলে সেখান থেকে ৩০ হাজার টন এলপি গ্যাস মিলবে। এ ছাড়া সরকার মোংলায় বার্ষিক এক লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতার একটি এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করলেও আগ্রহী উদ্যোক্তার অভাবে তা বাতিল করা হয়েছে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা