• রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

রূপসায় ভিডব্লিউবি প্রকল্প : হতদরিদ্রের চাল স্বচ্ছলের ঘরে

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১ মার্চ ২০২৪  

খুলনায় ‘ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) প্রকল্পে দরিদ্র সুবিধাভোগীদের বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে। অস্বচ্ছল, বিধবা, প্রতিবন্ধী, হতদরিদ্র নারীরা প্রকল্পে সুবিধাভোগী হলেও তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। উল্টো প্রভাবশালীদের অনুসারী স্বচ্ছল পরিবারের মহিলারা প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করছে। তারা সরকারি চাল নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে বিক্রি করছে। ফলে এ প্রকল্পের সুফল থেকে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বঞ্চিত হওয়ায় সরকারের পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। জেলার রূপসার উপজেলার বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

রূপসা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ভিডব্লিউবি প্রকল্পের আওতায় মোট ২৬৩৩ জন মহিলা সুবিধাভোগী রয়েছেন।

আইচগাতি ইউনিয়নে ৭৩৮, শ্রীফলতলা ইউনিয়নে ৩৬৮, নৈহাটি ইউনিয়নে ৭৩২, ঘাটভোগ ইউনিয়নে ৪৫৪ এবং টিএসবি ইউনিয়নে ৩৪১ জন মহিলা উপকারভোগী রয়েছেন। তালিকায় সুবিধাভোগী নারীদের অধিকাংশের ঘর টিন, মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরী উল্লেখ করা। এছাড়া উপকারভোগীদের ৮০ শতাংশ তাদের পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির পেশা হিসেবে কৃষি জমিতে দিনমজুরের তথ্য দিয়েছেন। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায় এসব তথ্যের সিংহভাগই অসত্য।

নীতিমালা অনুযায়ী, ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের সভাপতিত্বে তৃণমূল পর্যায়ে কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে উপকারভোগীদের তালিকা করতে হবে। পরে ইউনিয়ন কমিটি সব তালিকা সমন্বয় করে উপজেলা কমিটিতে জমা দেবে। অসচ্ছল, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারী ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকারের কথাও বলা আছে নীতিমালায়। তবে নীতিমালার তোয়াক্কা না করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কর্মী ও এলাকার প্রভাবশালীদের মাঝে ভিডব্লিউবি কার্ড বণ্টন করা হয়েছে। এছাড়া নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিগত চক্রে যারা কার্ড পেয়েছিলেন, তাদেরকেও ফের অন্তর্ভূক্তি করা হয়। এছাড়া নীতিমালায় উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুফলভোগীদের আত্নকর্মসংস্থানের দিকে উদ্বুদ্ধ করার নির্দেশনা থাকলেও অদ্যবধি কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইচগাতির এক বিধবা মহিলা জানান, তিনি একটি লবন তৈরীর কোম্পানিতে কাজ করেন। কোম্পানির জমিতে ঝুপড়ি ঘরে দুই সন্তান নিয়ে কোন রকমে দিনাতিপাত করছেন। গত বছর বার বার কাগজ নিয়ে সিংহেরচর ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার আকলিমা খাতুন তুলির কাছে ধর্ণা দেওয়ার পরেও তার ভিডব্লিউবি কার্ড হয়নি।

অন্যদিকে দেখা যায়, আইচগাতি ইউনিয়নে ৪ নং ওয়ার্ডে ছাদ দেওয়া দালান বাড়ির বাসিন্দা রোকেয়া বেগমের ভিডব্লিউবি কার্ড রয়েছে। বাড়ির সামনেই রোকেয়া বেগম তৈরী করছেন পাকা দোকান ঘর। স্বামী আলমগীর হোসেনের রয়েছে একটি ট্যুরিষ্ট ও একটি মালবাহী ট্রলার। এতকিছুর পরেও রোকেয়া বেগম ভিডব্লিউবি ২০২৩-২৪ প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগী অসচ্ছল নারীদের তালিকায় যুক্ত রয়েছেন।

এছাড়া ঘাটভোগ ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের আলাইপুর গ্রামের বাসিন্দা মোসাঃ সাদিয়া শান্তা ভিডব্লিউবি কার্ড পেয়েছেন। আবেদনের তালিকায় তথ্য রয়েছে তার স্বামী দিনমজুর কৃষক এবং বসবাস করেন টিনের তৈরী ঘরে। তবে বাস্তবে তার স্বামী মোঃ সাদ্দাম হোসেনের রয়েছে ড্রেজারের মাধ্যমে বালি উত্তোলনের ব্যবসা, চলাচল করেন মোটরসাইকেলে। তার থেকে অধিক অসচ্ছল পরিবার ওই এলাকায় রয়েছেন, যারা প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি সাদ্দাম হোসেনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

অপরদিকে নৈহাটি ইউনিয়নের রহিমনগর বাজারের নাজিম স্টোরের মালিক মোঃ নাজিম ফরাজীর রয়েছে মুদি-মনোহরিসহ জ্বালানি তেলের ব্যবসা। তবে সরকারি ভিডব্লিউবি চক্রের তালিকায় তিনি একজন দিনমজুর কৃষক, বসবাস করেন মাটির ঘরে। আর সে কারণেই তার স্ত্রী নাজমুন নাহার পাচ্ছেন সরকারী চাল।

নাজমুন নাহার, রোকেয়া বেগম, সাদিয়া শান্তার মত অনেক নারীই তুলনামূলক অধিক স্বচ্ছল পরিবারের হয়েও অসহায় ও হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের দেওয়া চাল পাচ্ছেন। অন্যদিকে লবন কোম্পানির হতদরিদ্র মহিলা শ্রমিকের মত মহিলারা ভিডব্লিউবি প্রকল্প থেকে বাদ পড়ছেন। এছাড়া অনেকে আবেদন যাচাই -বাছাই কমিটির যোগসাজসে নিজের বিবাহিত মেয়ে, বোনের তথ্য দিয়ে চাল উত্তোলন করে বাইরে বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কার্ড পেতে অর্থ লেনদেনের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।

রূপসা উপজেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ভিডব্লিউবি প্রকল্পের তালিকায় স্বাক্ষর থাকা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মনোয়ারা খানমের সাথে এসকল অসঙ্গতি নিয়ে কথা হয় প্রতিবেদকের। মনোয়ারা খানম জানান, তিনি বর্তমানে রূপসা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে নেই। বদলি হয়ে বাগেরহাটে রয়েছেন। আবেদনের সময় মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনেকে আবেদন করে। ইউপি চেয়ারম্যানরা ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি। অনলাইনে আবেদন করার পরে অটো স্কোর পড়ে, সে অনুযায়ি নাম আগে চলে আসে। পেশা, আয়, বাড়ির বিবরণী স্বল্প সময়ে যাচাই বাছাই করতে যেয়ে হয়ত কিছু ক্রুটি থাকতে পারে।

নৈহাটী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ কামাল হোসেন বুলবুল বলেন, অনলাইনে যে কেউ আবেদন করতে। আবেদন করার সময় যাচাই বাছাই করা হয় না। আর উপজেলা দপ্তর থেকে কার্ড দেয়া হয়। আমাদের কাছ থেকে কোন তালিকা নেয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে রূপসা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হাসি রানী রায় বলেন,অভিযোগ পেয়ে বিগত চক্রে যারা ছিলেন এমন ৬২ জনকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর আপনাদের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে উপজেলা কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে তাদের কার্ড বাতিল করা হবে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা