• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

পলিথিন পুড়িয়ে তেল ও গ্যাস উৎপাদন করে চমক দেখালেন ইউসুফ

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২২  

খুলনায় পরিত্যক্ত পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানী তেল ও গ্যাস উৎপাদন করে চমক দেখিয়েছেন ইউসুফ। তার বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার দেয়াড়া গ্রামে। ছয় মাস আগে ইউটিউব দেখে জ্বালানী তেল উৎপাদনের চেষ্টা করেন ইউসুফ। সম্প্রতি তার পরীক্ষামূলক এই উদ্যোগ সফল হয়েছে। পলিথিন পুড়িয়ে সে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেন উৎপাদন করছেন। সেই সঙ্গে পাচ্ছেন গ্যাসও।

সোমবার (২৮ নভেম্বর) পরীক্ষামূলকভাবে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক পুড়িয়ে জ্বালানী তেল ও গ্যাস তৈরিতেও সফল হয়েছেন কয়রার ইউসুফ। আর তার এই উদ্যোগ চমক সৃষ্টি করেছে। ইউসুফের স্বপ্ন এখন পরিত্যক্ত পলিথিন এবং প্লাস্টিক দিয়ে জ্বালানী তেল ও গ্যাস উৎপাদন করে একটি বাণিজ্যিক রূপ দেওয়া ও ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করা। যা দেশের পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবেশের ক্ষতি নয় ও সঠিক নিয়ম মেনে জ্বালানী তেল উৎপাদন করা ভালো একটি উদ্যোগ। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে, মানতে হবে নির্দেশনা।

নবীন এই উদ্যোক্তা ইউসুফ বলেন, আমি ছয় মাস আগে ইউটিউবে পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানী তেল উৎপাদন করতে দেখেছি। তখন মনে মনে ভেবেছিলাম আমিও করবো। এর তিন মাস পর কিছু পলিথিন পুড়িয়ে তেল উৎপাদনের চেষ্টা করি। তেল জাতীয় তরল পদার্থ তৈরি হয়। তবে সেটি ঠান্ডায় কিছুটা জমে যেত। কারণ খুঁজতে আবার ইউটিউব দেখি। সেখানে দেখা যায় এই তরল রিফাইনিং করতে হয়। এর জন্য একটি রিফাইনিং মেশিনের প্রয়োজন। একমাস আগে একজনকে ফোন দিয়ে রিফাইনিং মেশিনের মূল্য জানতে চাইলে তিনি ২ লাখ টাকার কথা বলেন। তবে সেই মেশিনে এক সাথে ৫ লিটারের মতো তেল রিফাইন করা যাবে। ভাবলাম এতো টাকা দিয়ে কিনে মাত্র ৫ লিটারে লাভ কি। পরে আমি নিজেই ইউটিউব দেখে রিফাইনিং মেশিন বানানোর কাজ শুরু করি। অবশেষে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যুক্ত করে একটি রিফাইনিং মেশিন তৈরি করে সফল হই। এখন সেই মেশিনেই তেল রিফাইন করছি।

তিনি জানান, এক মণ পলিথিন পুড়িয়ে ২৮ লিটার তরল পদার্থ তৈরি হয়। যা রিফাইনিং করে ২০ লিটার ডিজেল, সাড়ে ৫ লিটার পেট্রোল ও আড়াই লিটার অকটেন পাওয়া যায়। এছাড়া ২ সিলিন্ডারের মতো গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস দিয়ে রান্নার কাজও করা যাচ্ছে। আমি গ্যাস ব্যবহার করছি।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যতিক্রমী আবিষ্কারের খবরে এক নজরে দেখার জন্য প্রতিনিয়ত ভীড় করছে এলাকার মানুষ। এটার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন ইউসুফ।

তিনি জানান, বড় টিনের ড্রামে পলিথিন ভরে মুখ বন্ধ করে আগুনের তাপ দেওয়া হয়। তাপে ড্রামের সঙ্গে লাগানো পাইপ দিয়ে বেরিয়ে আসা বাষ্পীয় পদার্থ পানিভর্তি একটি ছোট ড্রামের মধ্য দিয়ে কিছুটা শীতল হয়ে পাইপের সাহায্যে তরল আকারে তিনটি পাত্রে জমা হয়। আর বাকী বাষ্প (মিথেন গ্যাস) অন্য একটি পাইপের মাধ্যমে টিনের ড্রামে যায়। সেখান থেকে আগুন জ্বালানো হয়। ফলে পলিথিন পোড়াতে বাড়তি তেমন কোন জ্বালানী লাগছে না। প্রথমে কাঠ দিয়ে সামান্য কিছুক্ষণ জ্বালানোর পরে বাকি সময় উৎপাদিত গ্যাস জ্বালানো হয়। মূলত প্রথমে তাপের মাধ্যমে বাষ্প আর বাষ্প পানির মাধ্যমে শীতল করে তরল পদার্থ সংগ্রহ করা হয়। পরে ওই তরল পদার্থ  রিফাইন মেশিনের মাধ্যমে তিনটি আলাদা আলাদা পাত্রে অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেল আকারে বেরিয়ে আসে। 

ইউসুফ বলেন, বিভিন্ন দোকানে বলেছি পলিথিন না ফেলে দিয়ে আমাকে দিবেন, আমি মূল্য দিবো। তারা এখন আর পলিথিন ফেলে দেয় না। আমি সেগুলো সংগ্রহ করি। আবার ফেলে দেওয়া পলিথিন কুড়িয়ে এনে সংরক্ষণ করছি। এগুলো দিয়ে এখন প্রতি সপ্তাহে দু’বার জ্বালানী তেল ও গ্যাস উৎপাদন করছি। উৎপাদিত অকটেন ও পেট্রোল বিক্রি করছি। আর ডিজেল আমার নিজের শ্যালো মেশিনে ব্যবহার করছি।

ইউসুফ বলেন, পরিবেশের ক্ষতি হবে এমন কাজ করবো না। কারণ পলিথিন পোড়ানোর সময় কোন ধোয়া ড্রাম থেকে বাইরে বের হতে পারেনা। এই ধোয়া (বাষ্প) তরল করে রিফাইনের মাধ্যমে তেল উৎপাদন করছি। এজন্য পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই। বরং একদিকে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত পলিথিনের ক্ষতি থেকে প্রকৃতি রক্ষা পাবে, অন্যদিকে দেশে চলমান জ্বালানি তেলের সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখবে ।

স্থানীয়রা জানায়, বিষয়টি শোনার পরে বিশ্বাস করতে পারিনি। নিজের চোখে দেখে অবাক হয়েছি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কাজটি অবশ্যই ভালো। এখানে উৎপন্ন জ্বালানি তেল দিয়ে মোটরসাইকেল ভালোভাবে চলছে। একদিকে সামান্য হলেও জ্বালানি তেলের চাহিদা মিটছে, অন্যদিকে আত্মকর্মসংস্থান হচ্ছে। তারা বলেন, ইউসুফ দারিদ্রতার কারণে তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি। তবে ছোটবেলা থেকে গবেষণা করে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করেছেন। চীন দেশের মেশিন ইউটিউবে দেখে নিজ বাড়িতে সব তৈরি করেছেন। এটা আমাদের গর্বের বিষয়।

খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, যদি সঠিক পদ্ধতিতে এই কাজটি করা হয় তাহলে আমাদের জন্য ক্ষতিকর না। পলিথিন ২০ বছর মাটিতে পচে না, প্লাস্টিক থাকে ৪৫০ বছর, এমএম মোটা পলিথিন থাকে ১২০ বছর, যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, যদি এটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় করতে পারি তাহলে আমাদের জন্য ভালো। আর যদি এর পদ্ধতিটা সঠিক না হয়, তাহলে দূষণ হবে। বিষয়টি দেখার জন্য আমাদের কর্মকর্তাকে সরেজমিনে যেতে বলা হয়েছে। এর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, খুলনার বটিয়াঘাটার মাথাভাঙ্গা মৌজায় পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতায় খুলনা সিটি করপোরেশন পলিথিন ও প্লাস্টিক দিয়ে জ্বালানী তেল উৎপাদন কাজ করছে। এছাড়া সবজির উচ্ছিষ্ট নিয়ে জৈব সার তৈরি করছে। বৈজ্ঞানিক যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন করে যদি করা যায় তা অবশ্যই ভালো। 

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা