• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

আজও গণহত্যায় শহীদদের স্মরণ করছে দিঘলিয়াবাসী

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২১  

আজ ২৭ আগস্ট, খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গণহত্যা দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে আজ ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি খুলনা জেলা শাখা ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী এবং তাঁদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার বাহিনী সারাদেশে যে নৃশংসতা এবং গণহত্যা সংঘটিত করেছিলো এমন একটি গণকবরের সন্ধান ২০১০ সালে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গ্রামে আবিষ্কৃত হয়।

১৯৭১ সালের এই দিনে রাজাকার বাহিনী ওই গ্রামের ৬০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে জবাই এবং গুলি করে হত্যা করে। শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রতিবছর দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করে থাকেন।

এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, ঘটনার দিন দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গ্রামের ডাক্তার শেখ মতিয়ার রহমানের পুত্র মুক্তযোদ্ধা শেখ আবদার রহমান তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দেয়াড়া গ্রামে সংগঠিত হচ্ছেন এমন সংবাদের ভিত্তিতে পাক হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসর কয়েক’শ রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেন এবং সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবজাল হোসেনের পিতা ডাক্তার শেখ মতিয়ার রহমান, তাঁর চাচাতো ভাই শেখ রহমত আলী পিরু, মোঃ আলী শেখ, ভাগনে শেখ ইসমাইল হোসেন ছোট খোকা, জামাই আব্দুল জলিল, তাঁর ভাই আব্দুল বারেক, হোসেন সরদার, মোঃ আজিম হোসেন, সাত্তার শেখসহ ওই গ্রামের ৬১ জনকে ধরে নিয়ে যায়।

ধৃতদের কাছে এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ আবদার হোসেনের সন্ধান চায়। ধৃত ব্যক্তিরা তাঁর সন্ধান দিতে অস্বীকৃতি জানালে ঘটনার দিন সকালে আনুমানিক ৯ টার দিকে প্রকাশ্যে দিবালোকে ওই গ্রামের পৃথক ৩টি স্থানে এদেরকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে ২২ জনের লাশ পৃথক ৩টি স্থানে গণকবর দেয় এবং বাকী লাশগুলো পাশ্ববর্তী ভৈরব নদীতে ভাঁসিয়ে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে সৈয়দ আবুল বাশার নামে এক ব্যক্তি একাধিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান।

২০১০ এ সব গণকবরের সন্ধান আবিষ্কৃত হলে ওই বছরের ৬ জানুয়ারি প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা কাজী শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান বাচ্চু, গাজী আজগর আলী, শহীদ ডাক্তার শেখ মতিয়ার রহমানের পুত্র দিঘলিয়া সদর ইউনিয়ন আ’লীগ নেতা সদ্য প্রয়াত সভাপতি শেখ আবজাল হোসেন, সাংবাদিক শেখ মনিরুল ইসলাম, আ’লীগ নেতা মোঃ মকবুল হোসেনসহ স্থানীয়দের সহযোগীতায় উল্লেখিত গণকবর থেকে শহীদের দেহাবশেষ ৩টি স্থান থেকে সংগ্রহ করে একত্রিত করে দেয়াড়া মুক্তিযোদ্ধা কাজী শাহনেওয়াজ এর নিজস্ব গোডাউনের সামনে তাঁর দান করা জমির উপর ভৈরব নদীর পাশ্ববর্তী একটি স্থান চিহ্নিত করে গণকবরের স্থান নির্ধারণ করা হয় এবং দেহাবশেষগুলি সেখানে সমাহিত করা হয়। ওই গণকবরে ২২ জন শহীদ সমাহিত আছেন।

 

দেয়াড়া গণহত্যাকান্ডের স্থান থেকে একমাত্র জীবিত মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল বাশার বর্তমানে বয়সের ভারে নতজানু হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছেন। ৮৮ বছর বয়সী ৮ সন্তানের জনক সৈয়দ আবুল বাশার তাঁর পিঠে রাজাকারদের ১৯ টি ধারালো অস্ত্রের কোঁপ এবং বোগলের নীচে একটি গুলির ক্ষত চিহ্ন তিনি আজও বহন করে চলেছেন অথচ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম নেই।

এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে সৈয়দ আবুল বাশার অশ্রুজল চোখে ৫০ বছর আগের সেই ভয়ংকর এবং নৃশংস ঘটনার কিছুটা বর্ননা দেন। বয়সের ভারে তিনি সব স্মৃতি স্মরণও করতে পারছিলেন না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এ পর্যন্ত অনেক সাংবাদিক এসে আমার সাক্ষাতকার নিয়েছে। কিন্ত দুঃখের বিষয় আমার ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হলোনা, কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পরও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেলাম না।

তিনি আরও বলেন, আমার জীবনে আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই তবে সরকারের কাছে আমার দাবি মৃত্যুর আগে আমি যেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরকারি স্বীকৃতির খবর নিজ কানে শুনে মরতে পারি।

দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুবুল আলম বলেন, সরকার সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং গণকবরগুলি চিহ্নিত করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সে লক্ষে আমরা গণকবরটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে ৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেন বাদী হয়ে ওই রাজাকারদের বিরুদ্ধে তৎকালীন দৌলতপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে মামলাটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেনের মৃত্যুর পর ২০১০ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারদের হাতে নিহত শহীদ মোঃ ইসমাইল হোসেন ছোট খোকার স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদী হয়ে খুলনা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর আদালতে ২২ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। অভিযুক্ত ২২ জনের মধ্যে ইতিমধ্যে ২১ জন মারা গেছে।

সর্বশেষ রাজাকার মারা যান গোয়ারপাড়া গ্রামের শেখ শওকত হোসেন। জীবিতদের মধ্যে একজন হলেন দিঘলিয়া উপজেলার ব্রক্ষগাতী গ্রামের মৃত গফুর শেখের পুত্র জাফর শেখ এখনও এলাকায় দাপটের সাথে চলাফেরা করছেন। দেয়াড়া গণহত্যার অনেক স্মৃতি চিহ্ন খুলনা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা