• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও বাঙালির গণজাগরণ

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৬ মার্চ ২০২৪  

১৯৭১ - যুদ্ধ চলমান, বাংলার মানুষের কাছে রেডিওতে তখন দেশাত্মবোধক গান যেন স্বস্তির তৃষ্ণায় মরুর বুকে বারিধারা। দেশপ্রেম ও সুরের শক্তি কতোটা গাঢ় হলে বাংলার দামালেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির যুদ্ধে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত গানগুলোর অবদান লিখে শেষ করার মতো নয়। এই গানগুলোই ছিলো তখন গণজাগরণের মূল শক্তি।

মহান স্বাধীনতার মাসে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’র সেরা কিছু গান নিয়ে একাত্তরের আজকের আয়োজন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ছয় ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার পর এর নাম বদলে বাংলাদেশ বেতার করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা থেকে সম্প্রচার শুরু করে বাংলাদেশ বেতার, যা এতোকাল রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করতো। 

জয় বাংলা, বাংলার জয়

‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি এ বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে প্রচারিত হতো। ১৯৭০ সালের মার্চে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, গীতিকার ও সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার এই গানটি রচনা করেন। সুর করেন সংগীত পরিচালক, সংগীতজ্ঞ ও শব্দসৈনিক আনোয়ার পারভেজ। দেশ বরেণ্য সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহর কণ্ঠে এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেরা গান। 

কারার ঐ লৌহকপাট
           
গানটির কথা ও সুরারোপ করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার অনবদ্য এই গানটি কয়েকজন শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার করা হয়। গানটি যুদ্ধকালীন সময়ে মানুষের মনে উদ্যম ও শক্তি সঞ্চার করে। গানের কথা আর সুর হাজারো ঘরকোণা যুবককে ঘর ছাড়তে বাধ্য করে, স্বপ্ন দেখায় পরাধীনতার গ্লানি মুছে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনার।  

তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে

একাত্তরের জুনের শেষের দিকে এ গানটি তৈরি করা হয়। দেশাত্মবোধক চেতনায় জাতিকে এক করার জন্য, একই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করার জন্য তখন এ রকম গানের বিকল্প ছিলো না। আর আমাদের মুক্তির সংগ্রামে ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ গানটি জনজাগরণের আরেকটি শক্তি।

এই গানটির কথা ও সুরারোপ করেন আপেল মাহমুদ। যৌথভাবে আপেল মাহমুদ ও রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত গানের মধ্যে এটি অন্যতম সেরা।

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল

এই গানটির গীতিকার সুর সৈনিক গোবিন্দ হালদার। সুরারোপে সমর দাস। গানটি কয়েকজন শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে প্রচার করা হয়।

এটি এমন একটি গান, যার কথা, সুর এবং গায়কী লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহী করে তুলেছিল অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাওয়ার।

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি

গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। সুর করার পাশাপাশি গানটি কণ্ঠে তোলেন আপেল মাহমুদ। তার কণ্ঠে বাংলাদেশ বেতারের গানটি প্রচারের পর জনমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

এছাড়া গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হওয়ার পর পুরো কলকাতাতেও এর বন্দনা শুরু হয়। যুদ্ধ চলাকালে এ গানটি কেবল স্বাধীন বাংলা বেতার নয়, পথে-ঘাটে, রাস্তায় রাস্তায় দলে দলে মুক্তিকামী মানুষেরা গেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছেন।

শোনো একটি মুজিবরের থেকে

শোনো একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গানটি সুরারোপের পাশাপাশি কণ্ঠে তোলেন অংশুমান রায়। এটি ছিল সেই গান, যেটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই ভারতের কোনো এক বেতার থেকে বাজানো হয়েছিল। পরে স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য নতুন করে কণ্ঠ তোলেন আব্দুল জব্বার।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা..

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে/বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/আমরা তোমাদের ভুলবো না। গোবিন্দ হালদারের কথায় গানটির সুরারোপ করেন আপেল মাহমুদ। গানটি কণ্ঠে তোলে জনতার মাঝে দেশপ্রেমের চেতনা জাগান স্বপ্না রায়।

সালাম সালাম হাজার সালাম ..

গানটি আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই মানুষের মুখে মুখে রটতে থাকে। এর কথা লিখেছেন ফজলে খোদা। সুরারোপ করেন আব্দুল জব্বার নিজেই।

নোঙ্গর তোল তোল, সময় যে হলো হলো..

গানটির কথা নঈম গহরের। সুর করেন সমর দাস। তার সুরে সমবেত কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয়। এই সমবেত সংগীতটি তখন সংগ্রামী সংগীত এবং যুদ্ধের মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।

ছোটদের বড়দের সকলের
       
এ এক সম্প্রীতির গান । গানটির কথা ও সুর খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার। এটি জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে তৎকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয়। এই গানটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালির মনে দেশপ্রেম জাগাতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে। 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামের ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’, ‘ওরে আয়রে তোরা শোন’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘রক্ত চাই, রক্ত চাই’।

এই গানগুলো আজো বাঙালির প্রাণের গান, আবেগ ও ভালোবাসার গান । প্রযুক্তির যুগে এর সংরক্ষণ আরো সহজতর, মন চাইলেই পান করা যায় দেশমাতৃকার এই অমূল্য সুধা। এই প্রজন্মের যারা, গানগুলো শোনার সময় হয়তো তাদের চোখে ভেসে ওঠে গল্পে শোনা সেই করুণ দিনের কথা, মুক্তি যুদ্ধের কথা! ভাল থাকুক আমার সোনার বাংলা, সবুজ থাকুক আমার মায়ের আঁচল!

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা