• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

আমার কাজ বিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখে বিকল্প সমাধান

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২১  

ড. মোবারক আহমদ খান পাটকল করপোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। পাট থেকে উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগ, পাটের তৈরি ঢেউটিন, পাটের তৈরি হেলমেট ও টাইলস উদ্ভাবন করে খ্যাতিমান। তার সঙ্গে সমন্বয় করে পাটের সেলুলোজ-ভিত্তিক স্যানিটারি প্যাড তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছেন ফারহানা সুলতানা। তিনি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহকারী বিজ্ঞানী। পাটের সেলুলোজ-ভিত্তিক স্যানিটারি প্যাড তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবনের প্রস্তাবের জন্য চতুর্থ ইনোভেশন পিচ প্রতিযোগিতায় গ্র্যান্ড পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যে কোনো দেশের নারীর স্বাস্থ্যবিধির জন্য পরিবেশবান্ধব একটি বিকল্প সমাধান।

আমেরিকান সোসাইটি ফর ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন আয়োজিত ‘চতুর্থ বার্ষিক ইনোভেশন পিচ প্রতিযোগিতায়’ জয়ী হওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। 

ফারহানা সুলতানা: ধন্যবাদ। আমি ভাবিনি মানুষ আমার প্রাপ্তি এতো পছন্দ করবে! মেন্সট্রুয়াল হাইজিন বিষয়ে সমাজে মেয়েদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। এর যে গুরুত্ব আছে- স্বাভাবিকভাবেই মেয়েরা-ছেলেরা সব জায়গা থেকেই এটা অ্যাপ্রিসিয়েট করছে। এটা একটা ভালো দিক মনে হয়েছে আমার কাছে। এই কাজটি শুরু করেছিলাম ড. মোবারক আহমেদ খানের সঙ্গে সমন্বয় করে ২০১৯ সালে। এখন মেশিন বানানোর কাজটি শুরু করবো, ইনশাআল্লাহ্।

নারীর স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে কাজ করার উৎসাহ বা অনুপ্রেরণার গল্পটি জানতে চাই।

ফারহানা সুলতানা: নারীর স্বাস্থ্য সমস্যা সমাজে অবহেলিত বিষয়। এর পেছনে সামাজিক ট্যাবু কাজ করে। নারীর অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে যেগুলোর সমাধান না-খুঁজে লুকিয়ে রাখা হয়। এই প্রবণতা সমাজে আছে। গ্লোবালিও দেখা যায় এই খাত নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যা থাকে। এখন পর্যন্ত নারীর স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে পুরুষরা বেশি কাজ করেছে। যেমন নারীর মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে আমাদের দেশে অনেক দিন ধরেই কাজ হচ্ছে কিন্তু আমাদের যেটা দরকার সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হয়নি। একই বিষয়ে নারীরা যখন কাজ করবে আরও গভীর ও ন্যানো সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারবে-কেননা সেও ভুক্তভোগী। এর সঙ্গে একজন নারীর অভিজ্ঞতা জড়িত। আমি নিজেও এর আওতাভূক্ত।

আমি সমস্যার সমাধান খুঁজতে চেয়েছি। পড়েছি নৃবিজ্ঞান নিয়ে, মানুষ সম্পর্কে জানাশোনা, প্রতিটি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া শিখেছি সেখান থেকে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক হেলথ্ নিয়ে পড়েছি, কাজের পরিধি ফেভার করেছে। তাছাড়া  বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী যিনি আমার কাছে অনুপ্রেরণার নাম। যার নাম না নিলেই নয়- তিনি আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ড. মোবারক আহমেদ খান।   

প্রশ্ন: সামাজিক ট্যাবুগুলো মোকাবিলা করে আপনার আবিষ্কার সমাজের গভীরে কীভাবে প্রভাব ফেলবে মনে করছেন?

ফারহানা সুলতানা: যেহেতু নৃবিজ্ঞান নিয়ে পড়েছি, আমি জানি এবং বিশ্বাস করি মানুষের বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া যায় না সবসময়। প্রতিটি মানুষের, সমাজের গোষ্ঠীর আলাদা নর্মস বা ভ্যালু আছে- নৃবিজ্ঞান সেগুলোকে সম্মান করতে শেখায়। আমি যে কাজটি বেছে নিয়েছি তার কাজ এবং প্রভাব হচ্ছে প্রত্যেকের বিশ্বাস এবং চর্চার প্রতি সম্মান রেখে বিকল্প সমাধান দেওয়া। এই প্রক্রিয়া মেনে কাজ করছি, করে যাবো।

প্রশ্ন: নারীর স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে আর কী কাজ করছেন বা করতে চান?

ফারহানা সুলতানা: যারা ঋতুকালীন কাপড় ব্যবহার করেন তাদের জন্য একটি ইনোভেশন করেছি কাপড়ের প্যাড। যারা কাপড় ব্যবহার করে আমরা যদি তাদের বলি কাপড় নয়- প্যাড ব্যবহার করো, তাহলে সেটা কিন্তু তাদের জন্য পীড়াদায়ক হবে। নিম্ন আয়ের কোনো মানুষের মেয়েকে যদি বলি- তুমি কাপড় ব্যবহার কোরো না, প্যাড ব্যবহার করো; আমি হয়তো বলতে পারবো- কিন্তু তার কি সেই সামর্থ্য আছে? তার পরিবার কি সেই টাকা দিতে পারবে? না। তার জন্য প্রয়োজন তার যা আছে তাই দিয়ে হাইজিন সমাধান দেওয়া। সে কাজটি করার চেষ্টা করছি। যে কাপড়ের প্যাড তৈরি করেছে সেটা ইনক্লুড-লিক করবে না। একই সঙ্গে মেয়েটি আরামে থাকতে পারবে। ডিসপোজেবল প্যাড ব্যবহারে অনুৎসাহিত করছি।

মাসিকের সময় অনেক মেয়েই ঠিকমতো খেতে চায় না। শরীরে প্রয়োজনীয় আয়রণ, জিঙ্ক-এর ঘাটতি তৈরি হয়। এই সমস্যা সমাধানে অঞ্চল ভেদে আলাদা আলাদা ‘নিউট্রিয়েন্টস বার’ করছি। আয়রন ও জিঙ্ক সমৃদ্ধ লোকাল ফুড থাকবে। 

প্রশ্ন: বুদ্ধিজীবী হিসেবে লেখক-কবিরা এ দেশে যতটা পরিচিতি বা খ্যাতি পায়, সে তুলনায় বিজ্ঞানীদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

ফারহানা সুলতানা: ছোটবেলা থেকেই আমরা অনেকেই লেখক হতে চাই, অনেকের গল্প, কবিতা পড়ে ভেতরে ফ্যাসিনেশন কাজ করে। এদের সামাজিকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় পাশাপাশি যারা ইনোভেশন বা আবিষ্কার নিয়ে কাজ করে তাদেরকেও যদি গুরুত্ব দেওয়া হয়; প্রচারে, উদাহরণে সামনে আনা হয় তাহলে নতুনরা আবিষ্কারের স্বপ্নটা সহজে দেখবে। অনেকে ফ্যাসিনেশন থেকে এ কাজে যুক্ত হবে। এ সেক্টরে গতি বাড়বে। সমাজে যাদের গুরুত্ব দেওয়া হবে সে কমিউনিটি বা গ্রুপটা শক্তিশালী হতে থাকে। সুতরাং বিজ্ঞানীদের উৎসাহ দেওয়ার অর্থ আপনি নবাগতদের এবং ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদেরকেও উৎসাহ দিচ্ছেন। যে কোনো কাজে উৎসাহটা দরকার। আর তা যদি হয় বড় পরিসরে সেটা অবশ্যই ভালো।

বর্তমান জেনারেশনের বেশির ভাগ বিসিএস-এ টেকা বা আমলা হওয়াটাকে সফলতা মনে করছে। এই মনে হওয়াটা সমাজ তৈরি করে দিয়েছে। সব কিছুই দরকার আছে, কিন্তু আমাদের দেশে যেটা হয়েছে ‘ফলোয়ার’ হও- বিষয়টা শিক্ষার্থীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় পরিবার, সমাজ। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাও জড়িত। পরিপূর্ণ সমাজের জন্য শুধু ফলোয়ার তৈরি না করে লিডার তৈরি করতে হবে। আমাদের সেই মেধা আছে। এর পরিচর্যা করে পরিবার, সমাজ, দেশ এবং বৃহৎ পরিসরের মানুষ আরও নতুন কিছু পেতে পারে।

২০২২ সালে অনুষ্ঠিতব্য ৫ম ইনোভেশন পিচ প্রতিযোগিতায় বিচারক হবার কথা রয়েছে আপনার, সেজন্য অগ্রীম অভিনন্দন।

ফারহানা সুলতানা: হা হা হা, ধন্যবাদ। আমার কাছে ভালো লাগছে তার কারণ সেসময় আরও ভালো ভালো কিছু ইনোভেশন দেখতে পাবো। পরিবেশবান্ধব এবং নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে সত্যিকার অর্থে প্রভাব ফেলবে এরকম কোনো ইনোভেশন যদি পাই সে ধরনের কাজ আমি নিজেও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। যেহেতু এটা প্রেসটিজিয়াস একটা প্ল্যাটফর্ম- ভেবে ভালো লাগছে! 

প্রশ্ন: মেধাবীরা কখনো কাজের পরিধি বাড়ানোর জন্য, আবার কখনো ভালো সুযোগ থাকায় দেশের বাইরে চলে যায়, আপনার ক্ষেত্রেও কি এমন ঘটতে পারে কিনা? 

ফারহানা সুলতানা: অল্প কিছুদিনের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে যাচ্ছি। সেখানে আমার সুপারভাইজার যিনি তিনিও পাবলিক হেলথ-এর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন। তিনি আবার অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া হয়েছেন এ বছর, যেটা আমাদের দেশের স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো। তো, তার অধীনে কিছু কাজ করার সুযোগ হবে বলে মনে করছি।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা