• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

৭ই মার্চেরঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ড.খ.ম. রেজাউল করিম

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০১৯  

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় স্তরেভাষণ ও বক্তব্যপ্রদান করা হয়। তবে সকল ভাষণ বা বক্তব্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য একরকম হয় না। যে ভাষণে জাতি দিক নির্দেশনা পায়, জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়, এমনকি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে বিজয়ের পতাকা ছিনিয়ে আনতে পারে বিশ্বের মানচিত্রে; এমন ধরনের ভাষণ ব্যতিক্রমী ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চেরেসকোর্স ময়দানে দেয়া ভাষণ অনন্য। বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ, সম্মোহনী, তেজস্বিতা, বাগ্মীতা, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, সুদুরপ্রসারী চিন্তা, পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয়তার নিরিখে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সক্ষমতায় এ ভাষণ ছিল ব্যতিক্রমী। এ ভাষণ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানেরআবাল বৃদ্ধ বণিতাকে এক পতাকাতলে সমবেত করে।এ ভাষণ ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।

এটি কোন প্রথাগত বা লিখিত ভাষণ ছিল না। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৭ সালে ইউনেস্কো এ ভাষণকে মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার-এ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ফলে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ স¤পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়। স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকৃত ৩০ লাখ শহীদ আর সম্ভ্রমহৃতকয়েক লাখ মা-বোনসহ দেশের সবার জন্য এটি আনন্দ ও বিরল সম্মানের বিষয়। এর আগে ২০১৩ সালে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদঔধপড়ন ঋ. ঋরবষফসম্পাদিত ডব ঝযধষষ ঋরমযঃ ড়হ ঞযব ইবধপযবং-ঃযব ঝঢ়ববপযবং ঞযধঃ ওহংঢ়রৎবফ ঐরংঃড়ৎুনামক এক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকেঞযব ঝঃৎঁমমষব ঃযরং ঞরসব রং ঃযব ঝঃৎঁমমষব ভড়ৎ ওহফবঢ়বহফবহপবশিরোনামে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ।

মূল আলোচনা 

স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এ স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের এই দীর্ঘ বন্ধুর পথে বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তীতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিকনির্দেশনা জাতিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌছে দেয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীণ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে ঢ়াকার রেসকোর্স ময়দানে বিকাল৩.২০ মিনিটে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের  ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতার অসামান্য অবদান। তাঁর অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক।  ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা। সঙ্গত কারণে এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।কারণ ৭ই মার্চের ভাষণের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ আথ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। 

১৯৪৭ সাল : পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মাঝখানে ভারত নামক বিশাল রাষ্ট্র রেখে দু’পাশের দু’টি অংশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ফলে এক অদ্ভূত ভৌগোলিক অবস্থান তৈরি হয়।
১৯৪৮ সাল : পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা হওয়ায় ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্বতৈরি হয়।
১৯৫২ সাল : ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দু’টি অংশের মধ্যে প্রথম সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ফলে বাঙালিরা আত্মসচেতন হয়ে ওঠে।১৯৫৪ সাল :  ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার আইনসভার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। যুক্তফ্রন্ট প্রধানত পূর্ব বাংলার চারটি বিরোধী দল (আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম ও গণতন্ত্রী দল) নিয়ে গঠিত হয়েছিল। 

১৯৫৮ সাল : পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক শাসন জারির পর বঙ্গবন্ধুসহ বহু নেতাকর্মীকে গ্র্রেফতার করা হয়।
১৯৬৬ সাল : ঐতিহাসিক ছয়দফা ঘোষণা করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন।
১৯৬৯ সাল : গণঅভ্যুত্থান দেশের শাসন ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়। প্রেসিডেন্ট আইযুব খান তদানীন্তন প্রধান সেনাপতিইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
১৯৭০ সাল :  ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের  নির্বাচন ছিল অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন) অর্জন করে।  কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোনভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা।

১৯৭১ সাল : বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক-

১)    দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা;
২)    তাঁর নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা করা;
৩)    পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা;
৪)    সামরিক আইন প্রত্যাহারের  আহবান;
৫)    অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকবিলার হুমকি;
৬)    দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা;
৭)    নিগ্রত ও আক্রমন প্রতিরোধের আহবান। 

কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ? 

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। কোনো ধরনের আপোসের পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষজীবন উৎসর্গ করে, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজীরবিহীন। শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্ববোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে ¯পষ্ট দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি।  এ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গ-িবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী। এ ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর কাব্যিক গুণ-শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস, যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও  চতুর্দিকে অনুরণিত। যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই উত্থিত হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তা তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও ছিল তাই, যা লিখিত ছিল না। এ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি আকারে ছিল নাতিদীর্ঘ। ১৮৬৩ সালে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন-এরএবঃঃুংনঁৎম অফফৎবংং-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম। ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত যা ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়। অপরদিকে আফ্রো-আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিংয়ের‘ও যধাব ধ ফৎবধস' অফফৎবংং-এর সময়কাল ছিল ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭।ভাষণটির প্রথমাংশ লিখিত ও পঠিত যার শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ।পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর ৭ইমার্চের ভাষণ ছিল ১৮ মিনিট ব্যাপী, শব্দ সংখ্যা ১১৩৫।  যেটি ছিল তাৎক্ষণিক, স্বতস্ফুর্তও অলিখিত। এ ভাষণের প্রতিটি শব্দ নির্বাচন করা হয়েছিল অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনের নিরিখে।প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল তার হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। 

বিখ্যাত ব্যক্তিদের মতামত

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিলঅত্যন্ত প্রজ্ঞাপূণ ও কৌশলী। পৃথিবীর বহুসমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক ৭ই মার্চের ভাষণনিয়ে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণকরেছেন।এ ভাষণ বিশ্বসম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ঝঁহফধু ঞরসবং এ ভাষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে অ ঢ়ড়বঃ ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপং আখ্যায়িত করেন। লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার তখনকার বিখ্যাত কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিল ডান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নেতা এলেন, যিনি, চারিত্রিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষা, পোশাক-আশাক, গায়ের রং, আচার আচরণে একজন নিখুঁত বাঙালি। তাঁর বজ্রকন্ঠের ঘোষণা দেশের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে এবং মান্য করে। ১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও স¤পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।” ভারতীয় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, “বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির পথ প্রদর্শক। তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবী স্বীকার করবে।” পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেন, “৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।” কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, “৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।” গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস।” 

৭ই মার্চের ভাষণের প্রভাব

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস। সম্ভবতপৃথিবীতে অন্য কোন ভাষণ এতবার উচ্চারিত হয়নি। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ঐ ভাষণের দিক-নির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্র কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ একটি জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী এক মহাকাব্য। এ ভাষণে তাঁর তেজস্বিতা ও সম্মোহনী ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। এ ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। এ ভাষণমানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলে। এভাষণ ছিল বহুমাত্রিকতায় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটিই স্বীকৃত হয়েছে। গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম,জাতিভেদ-বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী- সবার জন্যই এ ভাষণে অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।

উপসংহার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণ এদেশের জনগণকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে এবং মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা ”এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। এই উচ্চারণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা মুক্তিকামী  মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে। আর এরই মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। কেবল স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে। জাতির জনকের এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়েই দেশব্যাপী সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়।তারই ধারাবাহিকতায়  দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করি বহু কাঙ্খিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। 

সহায়ক তথ্যপঞ্জী

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে তালিকাভূক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল এ্যাডভাইজরি কমিটি। ২০১৭ সালের ২৮ থেকে ২৭ অক্টোবর অনুষ্টিত চারদিনের বৈঠকে ৭ মার্চেও ভাষণকে এই স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আইএসি কমিটি । প্যারিসে ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বুকোভা এই ঘোষণা দেন(দৈনিক সমকাল, ঢাকা, ৩১ অক্টোবর ২০১৭)।  ইউনেস্কো তার ওয়েবসাইটে আরো লিখেছে, উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া জাতিরাষ্টগুলো অঙশগ্রহনমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে ব্রর্থ হয়ে কিবাবে বিভিন্ন নৃতাত্ত্কি, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত বা ধশীৃয় সম্প্রদায়ের জনগনকে দূওে সরিয়ে দিয়েছে, তার যথাথৃ  প্রামাণ্য দলিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। যদিও বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের নির্দিষ্ট সময় ছিল বেলা  দুইটা। কিন্তু বেলা ১১ বাজতেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান। তবে জনতার    ভীড়ে ৩২ নম্বর থেকে সভামঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ঘন্টাখানেক দেরি হয়।

 উইকিপিডিয়া: মুক্ত বিশ্বকোষ 

  আশফাক হোসেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের রূপরেখা, ঢাকা: জে.কে. প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স, সেপ্টেম্বও ২০০৪

 ১. মো. মকসুদুর রহমান, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ঢাকা, আলেয়া বুক ডিপো, ২০০৫ 
 ২. ৭ই মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তাৎপর্য, ফেমাস২৪.কম, ৪ মার্চ ২০১৮
 ৩. ৭ই মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তাৎপর্য, ফেমাস২৪.কম, ৪ মার্চ ২০১৮
 ৪. আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ৭ই মার্চেও ভাষণ কেন একটি অমর মহাকাব্য, দৈনিক কালেরকন্ঠ, ঢাকা, ৭ মার্চ ২০১৮
 ৫. আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ৭ই মার্চেও ভাষণ কেন একটি অমর মহাকাব্য, দৈনিক কালেরকন্ঠ, ঢাকা, ৭ মার্চ ২০১৮
 ৬. ড. হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কেন আজ বিশ্ব স্বীকৃত, দৈনিক যুগান্তর, ঢাকা ১৮ নভেম্বর ২০১৭
 যার আবেদন আজও অটুট রয়েছে।

লেখক : ড.খ.ম. রেজাউল করিম সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি এমএম কলেজ, যশোর

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা