• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

‘১৯৭১ সালের আর্কাইভ সমৃদ্ধ করা’

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯  

বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির সুর তাঁরই করা। মুক্তিযুদ্ধে আলতাফ মাহমুদের রয়েছে অমূল্য অবদান। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদকে ঢাকার আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাঁকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছি তাঁর কন্যা শাওন মাহমুদের।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর কী ঘটেছিল সে স্মৃতি কি আপনার মনে পড়ে?

শাওন মাহমুদ: তখন আমার বয়স ৩ বছর। এরপর তো আসলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে বের হতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছি। সবসময় বাবাকে খুঁজতে গিয়েছি, তিনি কোথায় আছেন? ছোটবেলা কখনো আমাকে বলা হতো না, বাবা আর ফিরবেন না। সবসময় বলা হতো— বাবা ফিরবেন। সুতরাং এসব বিষয় বহন করতে করতে বড় হয়েছি এবং জেনেছি— বাবা আর আসবেন না। কিন্তু এখনো মনে হয় না, বাবা বেঁচে নেই কিংবা বাবাকে দেখিনি। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনার মনের ভেতর সবসময় যখন এই অনুভূতি থাকবে তখন কোনোভাবেই আপনি এখান থেকে বিচ্যুত হতে পারবেন না। 

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন কিনা?

শাওন মাহমুদ: ১৯৭২ সালে শহীদ পরিবার থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছিল। কিন্তু আলাদা করে কখনো এই বিচার চাওয়া হয়নি। বাংলাদেশে জেনোসাইডের ঘটনা ঘটেছিল। এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন মানেই সবকিছু একসঙ্গে হওয়া। বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার আলাদা করে কেন করা হচ্ছে না— এটা বলা ভুল হবে। বরং সবগুলো হত্যার বিচারই হচ্ছে।

বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। এ অবস্থায় আপনার প্রত্যাশা কী?

শাওন মাহমুদ: মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের কাছে সবসময়ই চাওয়া— সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন। সবগুলো মুক্তিযোদ্ধার পরিবার বা তাদের সন্তানেরা এটাই চেয়ে আসছেন। তৃণমূলের শহিদদের কথাও ধরুন, যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে; এখন আমার একান্তই দাবি, এ বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকার যেন এগিয়ে আসে। খুব ছোট ছোট পরিসরে গবেষণা হচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করছেন। কিন্তু এত বৃহৎ একটি কাজ স্বল্প পরিসরে হয় না। এজন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। নয় মাসে আমাদের আত্মত্যাগ, অনেক ক্ষতির যে তথ্য আর্কাইভে আছে তা খুবই কম বলে আমার মনে হয়। মূল কথা হলো, ১৯৭১ সালের আর্কাইভ সমৃদ্ধ করা। শত বছর পরেও যেন আগামী প্রজন্ম আর্কাইভে ক্লিক করে একাত্তরকে জানতে পারে। কতটা বিভীষিকাময় সময় পার করে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তা যেন বুঝতে পারে।

এই সময়ে এসেও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা হচ্ছে…  

শাওন মাহমুদ: এর একমাত্র কারণ আমাদের আর্কাইভ নাই। মাঝে মাঝে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সামনে গিয়ে অনশন করি। কারণ আমাকে এগুলোর উত্তর অনেক বেশি দিতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ যে রেফারেন্স দিব সেটা কোথা থেকে দিব? শহিদ বুদ্ধিজীবীদের উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখবেন, সেখানে অল্প কিছু তথ্য দেয়া। অল্প কিছু কাজের বিবরণ। খুব দায়সারা কাজ। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা অলৌকিক একটা সময় ছিল। কিন্তু আমরা কিছু লিপিবদ্ধ করিনি। আমরা আর্কাইভ করিনি। আমরা তালিকা করিনি। কীভাবে সেসব তথ্য পাওয়া যাবে? এটা বিশাল একটা শূন্যতা।

রায়ের বাজার বদ্ধভূমির কথা বললেন। তার মানে গোড়ায় টান দিতে হবে। কারণ কতটা আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা আমরা আমাদের সন্তানদের শেখাতে পারিনি। এটা আমরা আমাদের মগজেই ঢুকাতে পারিনি। না বইয়ে আছে, না অনলাইনে আছে। দেশে এত এত মিডিয়া কিন্তু কয়টা মুক্তিযুদ্ধের অনুষ্ঠান হয়? শুধু দিবস এলে কিছু অনুষ্ঠান হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কয়টা সিনেমা, কয়টা নাটক হয়েছে? কয়টা বই লেখা হয়েছে? এ বিষয়ে বললে হাতে গোনা কয়েকটার নাম বলা যাবে। আসলে এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে হবে না। বরং যার যার জায়গা থেকে কাজগুলো করতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন কিছু ইতিহাস তুলে আনতে পারব। এছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে কিচ্ছু আশা করবেন না।

বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা ধারণ বা লালন করছে বলে মনে করেন?

শাওন মাহমুদ: আপনি কি বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো অনেক দূরের কথা। এরা কিছু ইংরেজি শব্দ শিখেছে। যেমন: ব্রো আরো কী কী যেন বলে! এগুলো আমি আপনি কোনোদিন সমাধান করতে পারব না। এগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্যা। এটা তারা বুঝবেন। তবে হ্যাঁ, আমি আমার জায়গা থেকে যতটা সম্ভব কাজ করার চেষ্টা করি এবং করব। ছোট ছোট কিছু কাজ করি। অনলাইনে নিয়মিত লিখি। যেমন: কিছু স্থিরচিত্র খুঁজে বের করে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে তুলে ধরি— এমন আর কি। আমার মতো আরো দশজন যদি এ কাজ করে তবে সংখ্যায় সেটা অনেক।  

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা