• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বৃহস্পতিবার, তবু কাটছে না সংশয়

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০১৯  

বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সেরেছে বাংলাদেশ। তবে প্রত্যাবাসন আদৌ শুরু করা যাবে কিনা তা নির্ভর করছে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছের উপর। প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ছাড়পত্র পাওয়া তালিকার মধ্যে সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া ২২৫টি পরিবারের যারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী হবেন তাদের বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) ঘুমধুম মৈত্রী সেতু দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে।

তবে রোহিঙ্গারা বলছেন, নাগরিকত্বসহ তাদের প্রধান তিনটি দাবি পূরণ না হলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না।

অন্যদিকে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, সরকারের সিদ্বান্ত কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না। তবে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। 

রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হলে বৃহস্পতিবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম মৈত্রী সেতু দিয়ে তিনশো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি রয়েছে বাংলাদেশের। অন্যদিকে মিয়ানমারও এসব রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গাদের ট্রানজিট পয়েন্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁচটি বাস ও তাদের মালামাল পরিবহনের জন্য তিনটি ট্রাকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়াও টেকনাফ শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তবে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলেও এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে আজও প্রত্যাবাসন আটকে যেতে পারে- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

মিয়ানমারে সবশেষ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসিত হয়েছিল ১৪ বছরের বেশি সময় আগে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই। এই দীর্ঘ সময়ে প্রত্যাবাসনের বারবার সময়সীমা ঘোষণার পরও কোনো রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসিত করা যায়নি। উপরন্তু গত দুই বছরে নতুন করে ৮ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। নতুন-পুরনো মিলে এখন উখিয়া টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে।  

এসব রোহিঙ্গাকে নিজদেশে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা মিয়ানমারের ছলচাতুরি আর রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করা যাচ্ছে না। সবশেষ গতবছরের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমার দু’পক্ষই  প্রস্তুত থাকলেও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।

এবারও রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার জন্য শর্ত হিসেবে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা  ও নিজ ভিটেমাটি ফেরত দেওয়াসহ বেশ কয়েক দফা দাবি-দাওয়া দিয়েছে। মিয়ানমার সরকার অন্তত নাগরিকত্ব ও পুরনো ভিটেবাড়ি ফিরিয়ে দিলে সব রোহিঙ্গা একযোগে ফিরে যাওয়ার কথাও বলছে রোহিঙ্গারা। 

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বলেন, গতমাসে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমাদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে, দু’মাসের মধ্যে তারা আবার এসে আমাদের সঙ্গে সংলাপে বসার কথা। কিন্তু মধ্যে হঠাৎ করে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি নিয়ে আমরা হতবাক হয়েছি। বিশেষ করে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও নিজ ভিটেবাড়িতে ফেরত পাঠানোর দাবি পূরণ না হলে কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, দুই বছর আগে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আট লাখেরও বেশি মানুষ। এরআগে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর থেকে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত আরও প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা আসে। 

২০১২ সালের জুনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরও এসেছিল অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তবে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে ব্যাপক মাত্রায় রোহিঙ্গা আসে ২০১৭ সালের আগস্টের পর। এরআগে ব্যাপক মাত্রায় রোহিঙ্গা এসেছিল ৯১-৯২ সালে দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন এবং ৭৮-৭৯ সালে প্রায় দুই লাখ ৩২ হাজার জন। পরে তাদের অধিকাংশকেই মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়। সত্তরের দশকের প্রায় সবাইকে এবং ৯১-৯২ সালে দুই লাখ ৩৭ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়েছিল জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়।

২০০৫ সালের ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে প্রত্যাবাসন বন্ধ থাকায় বাকি ১৩ হাজার ২৭৮ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আর ফেরত নেওয়া হয়নি। আটকে যাওয়া এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার জনে উন্নীত হয়েছে। এরা এখন উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছে। উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে এখন বসবাস করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা।   

গত জুলাই মাসের শেষ দিকে মিয়ানমার উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেশন টিম উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন। টিমের সদস্যরা দু’দিনে কয়েক দফায়  মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাদা আলোচনায় অংশ নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে অনুরোধ জানান। সেসময় সফরকারী টিমের সঙ্গে যুক্ত হন আসিয়ানের পাঁচ সদস্যর প্রতিনিধিদল। 

রাখাইনে রোহিঙ্গারা ফিরে কী কী সুবিধা ভোগ করবে, জীবন-জীবিকা কীভাবে নির্বাহ হবে ও অন্যান্য অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন ডেলিগেশন টিম। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের লিফলেটও বিতরণ করা হয়। তবে এসব প্রতিশ্রুতি রোহিঙ্গাদের মধ্যে কতটুকু রেখাপাত করেছে বা স্বদেশে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি ও সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ইকরামুল কবির চৌধুরী বাবলু।

তিনি বলেন, আজকের প্রত্যাবাসন সফল হবে কিনা তা নিয়ে কক্সবাজারের মানুষ বিশেষ করে উখিয়া-টেকনাফবাসী সন্দিহান। এজন্য তারা চরম ক্ষুব্ধও। তাই যে কোনো মূল্যে প্রত্যাবাসন শুরু করা দরকার। তবে রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তাদের রাজি করানো কঠিন হবে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা