• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

যুদ্ধাহতদের চিকিৎসায় ফল বাগানে হাসপাতাল

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০১৯  

সুলতানা কামাল। তিনি কবি বেগম সুফিয়া কামালের মেয়ে। ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে রয়েছে ব্যাপক পরিচিত। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। একপর্যায়ে ঢাকায় থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। যুদ্ধকালীন ছোট বোনসহ ঢাকা ছাড়তে হয়। চলে যান সোনামুড়া। মেজর আখতারের সঙ্গে সেখানে থেকে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার সম্পৃক্ততা, ঢাকা ত্যাগ, যুদ্ধাহতদের চিকিৎসায় যুক্ত হওয়া ও বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিষয়ে এই গুণীজন কথা বলেন।

কেমন আছেন?
সুলতানা কামাল: ভাল আছি। আপনারা কেমন আছেন? কোন বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন?

মুক্তিযুদ্ধে আপনার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে জানতে চাই।
সুলতানা কামাল: ২৫ মার্চের পরে যখন গণহত্যা শুরু হল, অবশ্যই আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা আলাপ আলোচনা হতো যে, আমরা কে কি করতে পারি। কারণ, এটা তো এরকমভাবে মেনে নেওয়া যায় না। তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমার ছোট বোন চারুকলা কলেজে ছিলো। বন্ধু বান্ধব যারা ছিলো তাদের মধ্যে জাকিয়া আপা বলে একজন ছিলেন, যিনি ইডেন কলেজে পড়াতেন। আমরা সারাক্ষণই চিন্তা করতাম যে, কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারি, এগুলো বন্ধ করার বা কোথায় কি করতে পারি। তখনই জানতে পারলাম মুক্তিবাহিনী গঠন হচ্ছে। আমাদের বন্ধু বান্ধবরা সবাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। বিশেষভাবে সেক্টর টু-তে।

তখন শাহদাৎ চৌধুরি ওখানে ছিলেন, মাহমুদুর রহমান বেনু, ফতে আরী চৌধুরি, আলম, বাদল, চুল্লু, রুমি এবং তার সঙ্গে যারা ছিলো, তারা সবাই সেক্টর টু-তে সেই সময়ে যোগ দিয়েছে। আমাদের সঙ্গে ওদের তো একটা যোগাযোগ থাকতো যে, ঢাকায় এসে ওরা কোথায় থাকবে, কি করবে, কার কাছে কোন খবর দেবে, কোথা থেকে খাবার জোগাড় হবে, কোথা থেকে টাকা পয়সা জোগাড় হবে, যাতায়াতেরও তো খরচ লাগে। তখন সেই কাজগুলো আমার মা আর আমরা করতাম। কিছু টাকা পয়সা তুলে দেওয়া, কোন বাসায় থাকতে পারে। শাহাদাৎ চৌধুরি এখানে অনেক ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় মানুষজনকে রাখা, যত্ন করা এই সমস্ত কিছু করেছেন।

শুনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। সেখানে আপনিও সম্পৃক্ত ছিলেন, সেখানে কিভাবে গেলেন, কিভাবে হাসপাতাল তৈরি হল, কারা যুক্ত ছিলেন- এ সম্পর্ক যদি বলতেন।
সুলতানা কামাল : 
সব বলতে গেল রাত হয়ে যাবে। অল্প সময়ে বলা সম্ভব নয়। ওই সময়ে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে একজন বাঙালি অফিসার হামিদুল্লাহ আমাদের বাড়ির সামনে থাকতেন। তিনি স্কোয়াড্রন লিডার ছিলেন। একসময় তাকে ডেকে পাঠানো হলো। তিনি জানতেন, ডেকে পাঠানো মানেই, মেরে ফেলা প্রায়। সেজন্য তিনি এসে আমার মাকে বললেন, খালাম্মা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। তখন আমরা তাকে সীমান্ত পার হতে সাহায্য করি। তার পরিবারকে আমরা  ‍লুকিয়ে রাখি। তারপর যেটা হলো তার বাড়ির কাজের লোককে ধরে নিয়ে গেলো। ধরে নেওয়ার পরে একটা শঙ্কা সবার মনে দেখা দিলো যে, এই কারণে হয়তো, ওই কাজের লোককে যদি চাপ দেয় কিংবা যে অত্যাচার করবে, তাতে হয়তো তার কাছ থেকে কথা বেরিয়ে যেতে পারে যে, আমাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো। আমরা তার পরিবারকে সরিয়েছি। আমরা তাকে সীমান্ত পার করতে সাহায্য করেছি। কারণ, কাজের লোক তো দেখতো, আমাদের বাসায় আসছে যাচেছ। তার বাড়ির কার্পেটসহ কিছু নিজস্ব জিনিস আমাদের বাড়িতে রেখে দিয়েছে। সেগুলো তো কাজের লোক জানে। সেই জন্যে তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, জুন মাসের ১৬ তারিখ সীমান্ত পার হবো। শাহাদাৎ চৌধুরি, মাহমুদুর রহমান বেনু এবং অন্য আরো অনেকে ছিলো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাসরিন আহমাদ, যিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা), তিনিও ছিলেন। হামিদুল্লাহ ভাইয়ের পরিবার অর্থাৎ তার স্ত্রী ও তিন ছেলে, এই সবাইকে নিয়ে আমরা রওনা হলাম। এখান থেকে ট্যাক্সি করে, তখন তো আর দাউদকান্দি ব্রিজ ছিলো না, ফেরি পার হয়ে আমরা গেলাম চান্দিনা। চান্দিনা বাজারে নেমে ওখান থেকে রিকশা নিয়ে সোনামুড়া যাই। সেই সময়ে সোনামুড়ায় আর্মির ডাক্তার মেজর আখতার ছিলেন। ময়নামতি থেকে পুরো একটা অ্যাম্বুলেন্সে ওষুধপত্র ব্যান্ডেজ কাঁচি ছুরি যা যা লাগে সমস্ত কিছু নিয়ে ওই অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভ করে সোনামুড়া চলে গিয়েছিলেন। সেখানে সোনামুড়া ফরেস্ট বাংলোতে একটা ঘরে উনি চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন। সেই সোনামুড়া গিয়ে আমরা তার সঙ্গে যোগ দেই। কারণ, আখতার ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিলো।

আখতার ভাইয়ের স্ত্রীকে আগিই কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আমি আর আমার ছোট বোন যাওয়ার পরে, আখতার ভাইয়ের স্ত্রীকে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হল। আমরা তিনজন মিলে আখতার ভাইয়ের সঙ্গে সোনামুড়ায় এই চিকিৎসা কেন্দ্রটা প্রথমে শুরু করি।

এরপর খালেদ মোশাররফ এলেন। খালেদ মোশাররফ এসে আমাদের বললেন, খুবই ভাল হয়েছে। খালেদ মোশাররফ তখন ক্যাপ্টেন ছিলেন। পরে সবাই মিলে পরিকল্পনা করে একটা হাসপাতালের প্ল্যান দিল্লিতে পাঠানো হয়। কারণ, ওখান থেকে টাকা পয়সা না এলে  তো হবে না।

ততোদিনে জুলাই মাস চলে এসেছে। বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেছে। সোনামুড়ায় আমরা চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছি সেটা পাকিস্তানি আর্মি জেনে গেছে। তারা শেলিং করতো সোনামুড়া কেন্দ্র লক্ষ করে। তখন স্থানীয় মানুষজন আমাদের উপর একটু.. ওই অর্থে যে, আপনাদের কারণে আমাদের উপর শেলিং টেলিং হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তা থাকছে না। হঠাৎ হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মি শেলিং করতো। তখন আমরা একটু ভেতরে চলে গেলাম। সেটা হলো দারোগাবাগিচা, মেলাগড়ের ক্যাম্পের কাছে।

দারোগাবাগিচায় আমরা তাবু করে চিকিৎসা দিতাম। ওখানে আটটা তাবু ছিলো। দুইটা তাবু আমাদের জন্য আর ছয়টা রোগীদের জন্য থাকতো। ওখানে আহত অবস্থায়, কারো পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, কারো একদিক থেকে গুলি ঢুকে আরেক দিক থেকে বেরিয়ে গেছে, কারে হাতে গুলি লেগেছে। এরকম আহত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা আসতো। ওখানটায় আমরা চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলাম।

জুলাইয়ের কোন একটা সময়ে কিংবা অগাস্টের প্রথম দিকে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলো। হাবুল ব্যানার্জি বলে এক ভদ্রলোক  বিশ্রামগঞ্জে তার ফলের বাগানে আমাদের একটা জায়গা দিলেন। সেই জায়গায় সেই ফিল্ড হাসপাতালটা হলো। ডা. মুবিন সার্জন ছিলেন। তিনি সার্জারি করতেন। অক্টোবর মাসে ক্যাপ্টেন সেতারা এসে সেখানে যোগ দিলেন। শাহাদাৎ চৌধুরির ছোট ভাই ডা. মোরশেদ এসে যোগদান করলেন, ডা. মাহমুদ এসে যোগ দিলেন, আমাদের বন্ধু ডালিয়া, সেই সময়ে তার যে স্বামী ছিলো ডা. শাসমুদ্দিন- এরা মিলে আমাদের সেখানে তখন প্রায় ১৫ জনের মত চিকিৎসা দল হলো।

এদিকে রুমিরা যেদিন ধরা পড়ল, রুমিরা ধরা পড়ল ২৮ অগাস্ট কিংবা ২৯ অগাস্ট। রুমিরা ধরা পড়ার পর, পাকিস্তানি আর্মির রেইডের আশংকায় আলমের দুই বোন আসমা-রেশমা, মিরু বিল্লা, এখন মিরু হক, আলতাফের শ্যালিকা সীমান্ত পার হয়ে এসে    আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো। অনুপমা দেবনাথ বলে আরেকজন মেয়ে, সে এখন বোধহয় ইন্ডিয়ায় আছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়তো, তার ভাই ছিলো কনক দেবনাথ কিংবা অন্য কোন নাম, সেও ডাক্তার, সেও ওখানে যোগ দিলো। এভাবে ইউনিভার্সিটিতে পড়া, মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে বা ডাক্তার হয়েছে মাত্র, আর্ট কলেজে পড়া, মলি তো তখন মাত্র কলেজে পড়ে, আসমা রেশমাও বোধহয় কলেজে পড়ে, আমার সবাই মিলে ওখানে কাজ শুরু করি। পদ্মা, নিলিমা মিলে আমরা ১৫ জন মেয়ে হলাম, যারা ওই হাসপাতালটা তখন চালিয়েছি। সেখানে ডা. নাজিম বলে আরেকজন এসেছিলেন। আমরা সবাই মিলে হাসপাতালটা চালিয়েছি, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ওই হাসপাতাল কত শয্যার ছিলো?
সুলতানা কামাল: ৩০-৩০ মোট ৬০ বেডের ছিলো।

ঢাকায় কি চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিলো?
সুলতানা কামাল: ঢাকায় কিভাবে থাকবে!

আর কোথাও চিকিৎসা হতো?
সুলতানা কামাল: ফিল্ড হাসপাতালে তো সব কিছুর ব্যবস্থা ছিলো না। যদি কারো গুরুতর কিছু হতো, তখন আগরতলায় গোবিন্দ বল্লব হাসপাতালে (জিবি হসপিটাল) নিয়ে যাওয়া হতো, সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হত। খালেদ মোশাররফ যখন আহত হলেন, কোনাবনে, কসবাতে। তখন তাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল আগরতলায়, সেখানে চিকিৎসা হলো না, গৌহাটি নিয়ে যাওয়া হল, সেখানেও কিছু করা গেলো না, তারপর দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হল।  তার মাথায় ভিষণ চোট লেগেছিলো। শেষ পর্যন্ত ওইভাবেই অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন।

ফিল্ড হাসপাতালে কি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া হত, নাকি শরণার্থীদেরও ?
সুলতানা কামাল : শরণার্থীদের আমরা সেইভাবে দেখতাম না। ওটা ছিলো ফিল্ড হসপিটাল, ওখানে মুক্তিযোদ্ধারাই আসতো। কাজেই শরণার্থীদের কোন ব্যাপার ছিলো না। তবে যারা বর্ডার ক্রস করে যেত, তারা অনেক সময় ওখানে থামতো। ওখানটায় আহত, মানে সেরকম তো আর আহত লোকজন যায় নি, গেছে তো যারা বর্ডার ক্রস করে আগরতলা হয়ে কলকাতা কিংবা অন্য কোথায় চলে যাবে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা