• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

`মানুষের ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিই অপরাধ বাড়াচ্ছে`

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর ওয়ারীতে শিশু সামিয়া আক্তার সায়মাকে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আলোচনায়। এভাবে প্রতিদিনই দেশের এখানে-সেখানে ঘটছে সহিংস সব ঘটনা। সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া অপরাধমূলক বিভিন্ন ঘটনার নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার। 

প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের মতো সহিংস ঘটনা ঘটছে। অনেকেই বলছেন, অতীতের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অপরাধ বেড়েছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ড. মেখলা সরকার : অপরাধ আগের চেয়ে বেড়ছে কি-না সেটা বোঝার জন্য যে পরিমাণ তথ্য, গবেষণা ও পরিসংখ্যান থাকা দরকার তা নেই। যেহেতু তা নেই, তাই আগের তুলনায় অপরাধ বেড়েছে না কমেছে- সেটা বলা কঠিন। হত্যা, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ এগুলো মানুষের এক ধরনের প্রবণতা। এগুলো সবসময় ছিল। এখন এসব নিয়ে রিপোর্টিং অনেক বেড়েছে। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অপরাধের ধরন পাল্টেছে। আগে হয়তো প্রকাশ্যে এতটা সহিংসহার ঘটনা ঘটত না, যেটা এখন হচ্ছে।

মানুষের অপরাধ প্রবণতার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আসলে কী?

ড. মেখলা সরকার : মানুষ মূলত প্রবৃত্তির দাস। ফ্রয়ডের মতে, মানুষের মধ্যে দুই ধরনের প্রবৃত্তি রয়েছে। একটা হচ্ছে জীবনমুখী, আরেকটি ধংসাত্মক প্রবৃত্তি। এই ধংসাত্মক প্রবৃত্তির কারণে মানুষ আরেকজনের ক্ষতি করতে চায়। অনেক সময় নিজেরও করে।

মানুষ অপরাধ করে তাহলে কোন কারণে?

ড. মেখলা সরকার :মানুষ ধ্বংসাত্মক কাজ করে দুটি ফ্যাক্টর থেকে। প্রথমত যদি তার নৈতিক মূল্যবোধের জায়গা দুর্বল থাকে এবং দ্বিতীয়ত যদি বাস্তবতা তার অনুকূলে মনে করে। যেমন কারও প্রতি যদি তীব্র আক্রোশ তৈরি হয় তাহলে মানুষ আগে বাস্তবতা দেখে। যদি দেখে ওই ধ্বংসাত্মক কাজ করলে তার বড় শাস্তি বা ক্ষতি হবে তাহলে নেতিবাচক সেই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যদি দেখে তার কোনো সমস্যা হবে না, তাহলে মানুষ ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তির তাড়নাকে তুষ্ট করে। অবশ্য আরেকটা জিনিস মানুষকে ধ্বংসাত্মক কাজ করতে বাধা দেয়। সেটা হচ্ছে তার নৈতিক মূল্যবোধ।

নৈতিক মূল্যবোধের জায়গা তৈরিতে পরিবারের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

ড. মেখলা সরকার : পরিবারই মানুষের মূল্যবোধ তৈরির আসল জায়গা। অপরাধমূলক কার্যকলাপের পেছনে অনেক সময় পরিবারের পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। তবে পরিবার যে সরাসরি কাউকে অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ করে তা নয়।

বিষয়টা যদি একটু ব্যাখ্যা করেন?

ড. মেখলা সরকার : শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন বংশগত কিছু বৈশিষ্ট্য পায়। এই বৈশিষ্ট্যের বাইরে পরিবেশের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানুষের মিথস্ত্রিয়া হয়। এর মাধ্যমেই তার মানসিক কাঠামো তৈরি হয়। সাধারণত শৈশব ও কৈশোরেই এটা তৈরি হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, শিশুরা নির্দেশ শুনে বড় হয় না, দেখে বড় হয়।

হয়তো কোনো শিশু বায়না করে কাঁদছে, একটু রাগারাগি করছে কিংবা না খেয়ে চাহিদা আদায় করছে। বয়ঃসন্ধির সময় এই চাহিদা আরেকটু বাড়ছে। তখন মা-বাবা কিছু না দিলে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আর মা-বাবা ভয় পেয়ে তার চাহিদা পূরণ করছে। এতে সে মনে করে, জীবনে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। পরবর্তী জীবনে অন্যদের সঙ্গেও একই আচরণ করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করে।

অন্যদিকে যে শিশুটি ৭০ শতাংশ পাচ্ছে এবং বাকি ৩০ শতাংশ পাচ্ছে না সে হয়তো দুঃখ পাচ্ছে। কিন্তু সে ছোটবেলা থেকে শিখছে চাইলেই সবসময় তা পাওয়া যায় না।

মানসিকতা গঠনে আর কোন বিষয়গুলো কাজ করে?

ড. মেখলা সরকার : হয়তো কোনো শিশু তিরস্কার করার মতো আচরণ করল এবং মা-বাবা এটাকে এড়িয়ে গেল। তখন সে মনে করবে, সে যা চায় তাই করতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে এই নেতিবাচক আচরণগুলো নানাভাবে শক্তিশালী হয়।

কেউ যখন দেখে তার নেতিবাচক আচরণের জন্য পরিবারে সমস্যা হচ্ছে না, সমাজও ভয়ে কিছু বলতে পারছে না, আবার রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থাও দুর্বল; তখন তার অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। অর্থাৎ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র-ধাপে ধাপে মানুষের অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।

একই পরিবারে বেড়ে উঠলেও সব সন্তান তো নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে না।

ড. মেখলা সরকার : এটা ঠিক, একই পরিবারের সব সন্তান এক রকম হয় না। কেউ হয়তো প্রবৃত্তিকে নিবৃত করতে শেখে, কেউ শেখে না। তবে পরিবার যে শেখাচ্ছে না ব্যাপারটা তা নয়। হয়তো কারও মধ্যে গভীর হীনমন্যতা কাজ করে। সে হয়তো পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। মা হয়তো প্রথম বা শেষের বাচ্চাটাকে বেশি সময় দিয়েছে; কিন্তু তার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। অবহেলিত হওয়ার কারণে সে হয়তো বেশি দুষ্টু হয়েছে। মা-বাবা সন্তানের সঙ্গে কী রকম আচরণ করে, তার ওপরও মানসিকতা তৈরি নির্ভর করে। শিশু অবস্থায় কারও মধ্যে হীনমন্যতা ঢুকলে পরবর্তী জীবনে তা থেকে যায়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তো যৌননিপীড়নের ঘটনা ঘটছে?

ড. মেখলা সরকার : শিশুরা কিন্তু কখনোই নিরাপদ ছিল না। এটা শুধু এই যুগে নয়, সব যুগেই ছিল। নিকটাত্মীয়, বাসায় আসা ধর্মীয় শিক্ষকদের কাছে আগেও শিশুরা নিপীড়িত হয়েছে। নিপীড়ক কিছু মানুষ আগে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তার মানে এটা নয়, সব শিক্ষক বা আত্মীয় খারাপ। কিছু মানুষের খারাপ প্রবৃত্তি বেশি। তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম। নৈতিকতার জায়গা দুর্বল। তারাই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকে।

সামাজিকতা শেখাতে হলে শিশুকে অন্যদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। তবে মা-বাবাকে বোঝাতে হবে অন্যদের কোন আচরণটা ভালো এবং কোনটা খারাপ। মা-বাবাকেও সন্তানের আস্থা অর্জন করতে হবে। শিশুরা কী বলতে চায়, সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।

মাদকের সহজলভ্যতাও কি অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আরেকটি কারণ?

ড. মেখলা সরকার : কিছু কিছু মাদক গ্রহণ করলে মানুষের বিচার-বুদ্ধি কাজ করে না। কুপ্রবৃত্তি তখন বেড়ে যায়। নৈতিক মূল্যবোধ কাজ করে না। এভাবে মাদকের অতিব্যবহার ও সহজলভ্যতা অপরাধ প্রবণতা বাড়াচ্ছে।

মানুষের নৈতিকতা কমে যাওয়ার জন্য অনেকে প্রযুক্তিকে দায়ী করেন।

ড. মেখলা সরকার : প্রযুক্তি অবশ্যই একটা ভূমিকা রাখছে। অনেকে পরিবার বা সন্তানকে সময় না দিয়ে ভার্চুয়াল জগতে দিচ্ছে। শিশুদের হাতেও প্রযুক্তি তুলে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে তার বড় হওয়ার কথা ছিল, সেই জায়গা থেকে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে শিশুরা বেড়ে উঠছে। প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে। শিশুরা নিজেকে সমাজের একটা অংশ ভাবার সুযোগ পচ্ছে না।

তাছাড়া শিশুরা এখন সহিংস ভিডিও গেম দেখছে। গেমে মানুষের মৃত্যু দেখে মজা পাচ্ছে এবং সেটা অবচেতনভাবে তার মনে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি তৈরি করছে।

এই পরিস্থিতি তো একদিনে তৈরি হয়নি।

ড. মেখলা সরকার : আমরা একটি পরিবর্তিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। গত ১০ বছরে আমাদের পারিবারিক কাঠামো বদলে গেছে। একটা সময় ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেমন- পূজা-পার্বণ, শবেবরাত, ঈদ, মাঘী পূর্ণিমায় সবাই পরস্পরের বাসায় যেত। এখন উৎসবে মানুষ রিসোর্ট কিংবা বিদেশে যায়।

হঠাৎ করে মানুষের হাতে টাকা চলে এসেছে। প্রযুক্তি, টাকা, গ্ল্যামারের কারণে সবাই হতবিহ্বল অবস্থার মধ্যে আছে। হয়তো সবকিছু এখন মজা লাগছে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া জানা যাবে আরও ১০ থেকে ১৫ বছর পর।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?

ড. মেখলা সরকার : শিশুর মানসিক গঠনে মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা পরিবারকে আলাদাভাবে সেটা বোঝানো সম্ভব নয়। যদি স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অভিভাবকদের কাউন্সিলিং করা যায়, তাহলে বিষয়টা অনেক সহজ হয়। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটা বাধ্যতামূলক করা দরকার, যেখানে বছরে দু'বার সব অভিভাবক কাউন্সিলিং সেশনে উপস্থিত থাকবেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও একটা ভূমিকা থাকবে। রাষ্ট্রের নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশন বা নবায়ন করার ক্ষেত্রে এ ধরনের কার্যকলাপ বাধ্যতামূলক থাকতে হবে।

এই ব্যাপারে গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। একইভাবে শিক্ষকরা শিশুদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবেন, সেটারও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এখন ধর্মের খোলস নিয়ে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। ধর্মের যে একটা দর্শনগত জায়গা আছে, সেটা অনেকেই জানেন না। সত্যিকার অর্থে যারা ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, আলোকিত মানুষ সরকারের উচিত তাদের নিয়ে একটা কমিটি করা। আধুনিক সময় আর ধর্মের আসল দর্শন- এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে তারা যদি ধর্মের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে সবাই সহজে তা গ্রহণ করবে। এভাবে সামনের সময়টা চিন্তা করে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা