• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ভাষা শহীদ ও ভাষা দিবসের কিছু অন্যরকম তথ্য : অমি রহমান পিয়াল

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া এই চারজনের নাম ঠোঁটস্থ ছিল ছোটবেলায়। কারণ বিষয়টি পাঠ্যও ছিলো, পরীক্ষা পাসের জন্য জরুরী। আরেকটু বড় হয়ে জানলাম- না, শহীদ হয়েছিলেন ৫ জন। পঞ্চম জনের নাম শফিক। কোনও গানে তার নাম শুনিনি অবশ্য, তবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে ভাষা শহীদদের ভাস্কর্যে তিনি আছেন। এবং তার নাম শফিক নয়, শফিউর। আবার সরকারের খাতায় তিনি শফিক নামেই লিপিবদ্ধ! সে ঘটনায় পরে আসছি।

আহমেদ রফিকের লেখা ‘একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস’ নামে একটি বই আছে। বাংলা উইকিপিডিয়াতে ভাষা শহীদ হিসেবে এই পাঁচজনের যে ভুক্তি, তাতে তথ্যসূত্র হিসেবে বইটির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। উইকিতে ৫ জনের মৃত্যুর যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা এরকম:

১. আবুল বরকত: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আবুল বরকত। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত আটটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালের রাতে আবুল বরকতের আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর গোরস্তানে তার লাশ দাফন করা হয়।

২. আবদুল জব্বার : আবদুল জব্বারের পুত্র জন্ম হওয়ার কিছুকাল পরে তার শাশুড়ি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শাশুড়িকে নিয়ে ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে আবদুল জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁও নিবাসী হুরমত আলীর রুমে (২০/৮) উঠেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে, কী হয়েছে দেখবার জন্য তিনি রুম থেকে বের হয়ে আসেন। তখনই পুলিশ গুলি শুরু করে এবং জব্বার আহত হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জব্বারকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের মধ্যে ছিলেন ২০/৯ নম্বর কক্ষের সিরাজুল হক।

৩. রফিকউদ্দিন আহমদ : বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে পুলিশ গুলি চালালে সেই গুলি রফিকউদ্দিনের মাথায় লাগে। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়ে ছিল। ছয় সাত জন ধরাধরি করে তার লাশ অ্যানাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। তাদের মাঝে ডা. মশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে যান। রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে শহীদ রফিকের লাশ দাফন করা হয়।

৪. আবদুস সালাম: বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্নোর ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নেন। পরে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ এলোপাতাড়িভাবে গুলি চালালে আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ এপ্রিল, ১৯৫২ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

৫. শফিউর রহমান : ১৯৫২-র ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার দিকে ঢাকার রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন শফিউর। সকাল সাড়ে দশটার দিকে নওয়াবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্বদিনের পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ পুনরায় গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলি শফিউর রহমানের পিঠে এসে লাগে। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচার সফল না হওয়ায় ওইদিন সন্ধ্যা সাতটায় মৃত্যুবরণ করেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে ২২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার কবরের পাশেই রয়েছে পূর্বদিনের শহীদ আবুল বরকতের কবর।

এখানে ব্যাপারটা একটু আগ্রহোদ্দীপক। আবদুস সালাম তাৎক্ষণিক শহীদ নন, প্রায় দেড় মাস পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। কিন্তু তার নামটি আমরা সবার আগে উচ্চারণ করি। অন্যদিকে শফিউর মারা যাওয়ার পর বরকতের পাশেই তার কবর হয়েছে। কিন্তু শুরুতে তার নাম উচ্চারিত হতো না। একটা কারণ হতে পারে শুরুতে শুধু ২১ ফেব্রুয়ারিতে মৃতদেরই আমলে নেওয়া হয়েছিল। মানে ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদের তালিকায় তিনি না থাকলেও ভাষা শহীদের তালিকায় তিনি আছেন।

প্রশ্ন উঠতেই পারে তালিকাভুক্তদের কতজন সত্যিকার মিছিলে শহীদ?  ইতিহাস বলে ভাষার জন্য প্রথম শহীদ হয়েছেন রফিক। তার ঘটনাটা আরো বেশি ট্রাজিক এই কারণে যে তিনি ঢাকা এসেছিলেন বিয়ের বাজার করতে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের পারিল গ্রামে (এখন রফিকনগর) বাড়ি তার। একই গ্রামের মেয়ে রাহেলা খাতুন পানুর সঙ্গে প্রেম, পারিবারিকভাবে এই সম্পর্ককে দুপক্ষ মেনে নেয় এবং বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়।

২০ তারিখ রফিক ঢাকা আসেন, বিয়ের শাড়ি, গহনা এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনেন। ২১ তারিখ সন্ধ্যায় তার বাড়ি ফেরার কথা ছিল। গুলি খাওয়ার পর রফিকের লাশ মেডিকেল হোস্টেলের বারান্দায় পড়ে ছিলো। অর্থাৎ তিনি রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হননি। তাহলে কি তিনিও জব্বারের মতো হোস্টেলে কারো অতিথি হয়ে এসেছিলেন, হট্টগোলের মধ্যে গুলি খেয়ে মরলেন! রফিকের ট্রাজেডি এখানেই শেষ নয়। ভাষা শহীদদের মধ্যে তার কবরটিই অচিহ্নিত রয়ে গেছে। সে রাতে তড়িঘড়ি তাকে আজিমপুরে সমাধিস্থ করা হয়। এবং ঠিক কোন জায়গায় সেটা কখনও বের করা যায়নি।

শহীদদের মধ্যে স্মরণে বরণে সবচেয়ে প্রিভিলেজড আবুল বরকত। কারণ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। আগের বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ পাশ করে সে বছর ভর্তি হয়েছিলেন অনার্সে। বরকতও মারা গেছেন হোস্টেলের বারান্দায়। তবে ৫২ থেকে পরের ফি বছর ভাষা শহীদদের নিয়ে যাবতীয় অনুষ্ঠানে তার মা-বাবা এবং আত্মীয়রা উপস্থিত থেকেছেন অতিথি হিসেবে, স্মৃতিচারণ করেছেন তাদের নিহত স্বজনের। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথি ছিলেন বরকতের মা হাসিনা বেগম। অনুষ্ঠানে তার বোন এবং ভগ্নিপতিও ছিলেন।

হাইকোর্টের হিসাব রক্ষণ শাখার কেরানী শফিউর ২২ ফেব্রুয়ারি অফিসে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নবাবপুর রোডে এক বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সাইকেল আরোহী শফিউরের পিঠে লাগে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা ব্যর্থ হন তার প্রাণ বাঁচাতে, সেদিন সন্ধ্যায় মারা যান শফিউর। জব্বারও রফিকের মতো ঢাকা এসেছিলেন ২০ ফেব্রুয়ারি, ক্যান্সারাক্রান্ত শাশুড়িকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিজে উঠেছিলেন এলাকার ছেলে হুরমত আলীর রুমে। বাইরে ঝামেলা দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। শুধুমাত্র সালামই মিছিলে থেকে গুলি খেয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যাননি। তবে দেরিতে মরেও বাকিদের মৃত্যুকে অথেনটিসিটি দিয়েছেন তিনি। তার নামটিই উচ্চারিত হয় সবার আগে।

একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো তারবার্তাটি বেশ চমকপ্রদ। এখানে কিছু বাড়তি খবর আছে। ঢাকা থেকে কনসাল জেনারেল বোলিং তার তারবার্তাগুলো সরাসরি পৌঁছাতে নাও পারে এই সম্ভাবনা থেকে ইসলামাবাদে রাষ্ট্রদূত ওয়ারেনের সাহায্য নিয়েছেন। ওয়ারেন লিখেছেন বোলিংয়ের বরাতেই। সেখানে বোলিং দুদিনে নিহতের সংখ্যা ১৪র বেশি বলে উল্লেখ করেছেন এবং আহতের সংখ্যা অগণিত। সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে গেছে জানিয়ে এর নেপথ্যে আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিস্টদের ইন্ধন আছে বলে সন্দেহ জানিয়েছেন বোলিং। ঢাকায় সরকারী মুখপত্র বলে পরিচিতি পাওয়া মর্নিং নিউজ জনতা জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তারবার্তায়। এছাড়া প্রভাবশালী দৈনিক আজাদ এই ইস্যুতে নুরুল আমিন সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে জানিয়ে লেখা হয় যে ২২ ফেব্রুয়ারিতেই প্রাদেশিক সংসদ অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার একটি বিল উত্থাপন করেছে নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন সরকারী দল।

২৮ ফেব্রুয়ারি বোলিং যে তারবার্তাটি পাঠিয়েছেন সেটিরও ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা আছে। এতে ঠিক আগের দিন পুলিশি হামলায় ছাত্রদের নির্মিত শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দেওয়ার উল্লেখ আছে। এটিকে ঘিরে ছাত্রজমায়েতটিকেও ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এরপর ছাত্রদের হল তল্লাশি করে ২৭ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম ডা. হুদার যিনি প্রাদেশিক সংসদের স্পিকারের আত্মীয়। ছাত্ররা গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তিসহ ৯ দফা দাবি পেশ করেছে এবং তা মানা না হলে আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে যাওয়ার নেপথ্যে পুলিশ গোপন ওয়ারল্যাস (রেডিও) নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব আছে বলে সন্দেহ করছে বলে বোলিং লিখেছেন তারবার্তায়। পুলিশ রেইডে প্রচুর উস্কানিমূলক লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে এবং নারায়ণগঞ্জে এক সমাবেশে হাতুড়ি কাস্তে পতাকা উড়েছে বলে জানা গেছে (তারবার্তার ভাষায়)। সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং আগামীতে ভাইস চ্যান্সেলর সরাসরি সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন বলে একটি আইন পাশ করা হচ্ছে। মাঝামাঝি ২৫ ফেব্রুয়ারি আরেকটি তারবার্তায় গোটা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ রয়েছে । সেখানে ২৭ জানুয়ারিতে ঢাকায় খাজা নাজিমউদ্দিনের ভাষণে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে পুনরুক্তিই গোটা পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বোলিংয়ের ১৪ জনেরও বেশী নিহত হওয়ার খবরটা আসলে উড়ো খবরের একটা কনসাইজ ফর্ম। ২৪ মার্চ পূর্ব বঙ্গের তথ্য বিভাগ একটি প্রেসনোট ছাড়ে ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় নিহতদের নাম ও নিহত হওয়ার ঘটনাস্থল এবং সমাহিত হওয়ার স্থানের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে। সেখানে শুরুতেই প্রেসনোট নাজিলের প্রেক্ষাপট হিসেবে বলা হয় সাম্প্রতিক গুজবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে যেখানে মৃতের সংখ্যা দেড়শ রও বেশি বলা হচ্ছে যাদের বেশিরভাগই ছাত্র এবং অনেকেই নারী বলে রটানো হচ্ছে। নিহতদের অনেকেই পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে এইসব অপপ্রচারে। শুধু মুখে মুখেই নয়, এসব প্রচারে প্ল্যাকার্ডও ব্যবহার করা হচ্ছে । বোঝা যাচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনরোষ তৈরি এবং পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য এই উপায় অবলম্বন করছে দুষ্কৃতিকারীরা। এরপর সরকার সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে জানতে পেরেছে যে দুইদিনের ঘটনায় (২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি) গুলিতে মাত্র ৪ জন নিহত হয়েছে (তখনও সালাম মারা যাননি) এবং এদের মধ্যে মাত্র একজন ছাত্র (শুধু বরকত)। মৃতদেহগুলো ধর্মীয় রীতি মেনেই সৎকার করা হয়েছে। একজন হাফিজ জানাজা পড়িয়েছেন এবং মৃতদের নিকটাত্মীয়দের কেউ না কেউ উপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি ঘটনাই একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট পুরো অনুষ্ঠান তদারক করেছেন।

প্রেসনোটের দ্বিতীয় পাতায় দেওয়া হয়েছে নিহতদের নাম ও আনুষঙ্গিক বর্ণনা:

সেখানে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে গুলিবর্ষণে নিহত হিসেবে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন এবং আবদুল জব্বারের নাম উল্লিখিত হয়েছে । বরকত ছাত্র, রফিক বাবার প্রিন্টিং প্রেসের সহকারী এবং জব্বারের পেশা উল্লেখ করা হয়েছে মুদি দোকানদার। এদের মধ্যে রফিক ও জব্বারের কোনো আত্মীয়কে পাওয়া যায়নি। তবে বরকতের আত্মীয় হিসেবে ডেপুটি সেক্রেটারি আবুল কাশেম, এজি অফিসের হিসাব বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা আবদুল মালিক, ডা. হাবিবউদ্দিন আহমেদসহ বহু নারী ও পুরুষ আত্মীয় উপস্থিত ছিলেন বলে লেখা হয়েছে।

তিনজনেরই জানাজা পড়িয়েছেন হাফিজ মওলানা আবদুল গফুর এবং দাফন তদারক করেছেন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ। সেক্ষেত্রে ঘটনাগুলো আলাদা ঘটেছে বলে মনে হয় না, তারপরও শুধু রফিকের কবরের জায়গাটিই চিহ্নিত হয়নি। তবে রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় তাকে দাফন করা হলে এমনটা হওয়া অবাস্তব নয়। কারণ জব্বারের লাশ হাসপাতালে পড়ে ছিল এবং বরকত মারা যাওয়ার পর দুজনকে হাসপাতাল থেকে আজিমপুর একসঙ্গে হয়তো নিয়ে যাওয়া হয়।

শফিউর রহমানের নাম সরকারী প্রেসনোটে লেখা হয়েছে শফিকুর রহমান। পেশা হাইকোর্টের কর্মচারী। সমাধিস্থ করার সময় তার বাবা মাহবুবুর রহমানসহ অন্য আত্মীয়রা উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে। এবারও জানাজা পড়িয়েছেন হাফিজ আবদুল গফুর এবং তদারক করেছেন ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদুল্লাহ। শফিউরের সঙ্গে আরও দুজনের জানাজা পড়ানো হয় এবং কবর দেওয়া হয়। ১০ বছর বয়সী ওয়াহিদুল্লাহ একজন রাজমিস্ত্রীর ছেলে, অন্যজন রিকশাচালক আবদুল আওয়াল। পরে তদন্তে জানা যায় যে দুজনই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

এই সরকারী প্রেসনোটটা আসলে সরকারের স্বীকারোক্তির দলিল। ভাষা আন্দোলন দমাতে সরকারের পুলিশ গুলি ছুড়েছে, গুলিতে যারা মারা গেছে তাদের নাম-ধাম প্রকাশ করে এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এইসব মৃত্যুর। সেই অর্থে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে কোনও বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়। আন্দোলনের অংশীদার হয়তো তারা ছিলেন না সবাই, কিন্তু আন্দোলনের কারণেই তারা শহীদ, এই বিষয় তো বিতর্কহীন। তবে আন্দোলনরত ছাত্রদের একাংশ সে বছর ৫ মার্চ শহীদ দিবস পালন করেছেন এবং সেদিন ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিল এবং সমাবেশও হয়েছে। ব্যাপারটা শুরুতে ব্যাপক সাড়া পেলেও শেষ পর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়েই মতৈক্যে আসে সবাই।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ায় আমরা যেসব সুবিধা পেয়েছিলাম তার মধ্যে রয়েছে টাকায়, ডাক টিকেটে এবং সরকারী দলিলে উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা। গুরুত্বপূর্ণ দলিলে উর্দুর পাশাপাশি বাংলার অবস্থান। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির যে আন্দোলন, তার জন্য যে দিবসটাকে আমরা আমলে নিই তা ২১ ফেব্রুয়ারি। এটিকে পালন করি আমরা আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একটি গান গেয়ে। গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের ছাত্রদের প্রকাশিত একটা লিফলেটে। দুই পৃষ্ঠার লিফলেটে দ্বিতীয় পাতায় ছিলো গানটি। শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে এটি আমাদের প্রভাত ফেরির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এবার একটি অন্যরকম তথ্য দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। একাত্তর এবং এর আগে রাষ্ট্রভাষা দিবস তথা ২১ ফেব্রুয়ারি পালন নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান সম্পর্কে আমরা মোটামুটি জানি। আলোচনার স্বার্থে একটু রিপিট করি। ১৯৭১ সালের দৈনিক সংগ্রামে ১২ মে সংখ্যায় ‘সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশের ইতি হোক’ শিরোনামে লেখা হয়:

“হিন্দুস্তানী সংস্কৃতি মুসলমান সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি ক্ষেত্রের প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন করেছে। যার ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় শ্লোগানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আল্লাহু আকবর ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ বাক্যগুলি বাদ পড়ে এগুলোর জায়গা নিয়েছিলো জয় বাংলা। মুসলমানী ভাবধারার জাতীয় সঙ্গীতের স্থান দখল করেছিল মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু কবির রচিত গান।…শহীদ দিবসের ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী মুসলমান ছাত্রদের জন্য দোয়া কালাম পড়ে মাগফেরাত কামনার পরিবর্তে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে হিন্দুয়ানী কায়দা, নগ্নপদে চলা, প্রভাতফেরী, শহীদ মিনারের পাদদেশে আল্পনা আকা ও চণ্ডীদের মূর্তি স্থাপন ও যুবক-যুবতীদের মিলে নাচগান করা মূলত ঐসকল পত্রপত্রিকা ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলির বদৌলতেই এখানে করা সম্ভব হয়েছে।”

স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অবস্থান ফিরে পাওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী ২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ দোয়া দিবস পালন করে। কিন্তু আমরা কেউ হয়তো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি তারা কেন এটা করে, এখানে কী বিষয়ে দোয়া হয়। রটনা আছে ভাষা দিবস একটা উছিলা মাত্র, তবে তারা এদিন সত্যিই শহীদ দিবস পালন করে এবং শহীদদের জন্য দোয়া মাহফিল আয়োজন করে। জানেন এই শহীদদের পরিচয়? ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় একদল বন্দী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এরা সবাই ছিলো ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) আল-বদর বাহিনীর সদস্য। সেই নিহত ১৮ জন আল-বদরকে জামায়াত শহীদি মর্যাদায় এদিন গোপনে স্মরণ করে।

তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে পরিমান বিতর্ক হয়েছে, সে তুলনায় অনেক নিরাপদ আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও তার ইতিহাস। এক গোলাম আযমের ভাষা সৈনিক হওয়ার মিথ্যা দাবিটা বাদ দিলে এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য নেই আমাদের ইতিহাসে খুঁতের খোজে তৎপর পণ্ডিতদের। যাহোক, বিপ্লবে কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলে কিছু নাই। যদিও তারা ব্যঙ্গ করে লিখেন: ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কলেরায় মৃতদের আলাদাভাবে হিসাব করা হয় না, তারাও সার্বিকভাবে শহীদের তালিকাভুক্ত।’ ভাগ্যিস একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখেন না যে এদের অনেকেই ‘একসিডেন্টাল’ শহীদ।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা