• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ভাবনায় বঙ্গবন্ধু

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯  

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হব। আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশের সারিতে আমাদের অবস্থান সুনিশ্চিত করার প্রত্যয়ে আমরা আজ টেকসই উন্নয়নের মহাসড়কে উত্তরণের পথ বাতলাচ্ছি। কিন্তু এ স্বপ্নের বীজ যার দ্বারা উপ্ত হয়েছিল, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বলতে হয়, আমাদের যা কিছু অর্জন; যত সব উত্তরণ, তার ভিত্তিমূলে রয়েছে জাতির পিতার আজীবন স্বপ্ন লালিত উন্নয়ন ভাবনা।

সেজন্যই বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ কিংবা বাঙালির ইতিহাস পাঠ যেমন পূর্ণতা পাবে না, তেমনি বাংলাদেশ কিংবা বাঙালির কোনো উন্নয়ন দর্শনের অভিযাত্রার পরিক্রমা পাঠও এক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মূলত বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একই সত্তার এপিঠ-ওপিঠ। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করলে কার্যত বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা হয়।

বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সব প্রত্যয় নিয়ে আমরা বলতে পারি বঙ্গবন্ধু এমন একটি নাম, যা বাঙালির আবেগের রসে সিক্ত; বঙ্গবন্ধু এমন একটি আবেগ, যা বাঙালির প্রাণের ভেতর থেকে উত্থিত; বঙ্গবন্ধুÑএই একটিমাত্র নাম দ্বারাই বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রাম-চেতনা-আবেগমথিত ভাবধারা-সম্মিলিত প্রয়াসের মহত্তম অর্জন ও নির্যাসের সাবলীল প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনও বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন দ্বারা ঋদ্ধ এবং আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা ও উন্নয়ন দর্শন একান্তই প্রাসঙ্গিক।

একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছি। পেয়েছি অনেক স্বপ্নের, অনেক আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ সংজ্ঞায়িত হয়েছে শত শত শহীদের রক্তে অর্জিত জাতীয় সোনালি ভূমি প্রশংসিত গণতান্ত্রিক চিরসুবজ পবিত্র আবাসস্থল হিসেবে।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, ধ্বংসপ্রায় দেশকে কীভাবে পুনর্গঠন করা যায়, উন্নতির শিখরে নেয়া যায়, সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কার্যকর উদ্যোগ নিলেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা খুঁজে বের করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত চাইলেন। তাদের গভীর পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এল অমিত সম্ভাবনাময় এ দেশের মাটি ও মানুষ, জল ও বৃত্ত এবং পরিবেশ ও প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর এ সম্পদকে যথার্থ অর্থে কাজে লাগাতে এবং দেশের উন্নয়নের নিয়ামক করতে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছিলেন সমবায়ভিত্তিক কর্মযজ্ঞ।

বঙ্গবন্ধু সংগ্রামী চেতনার আলোকে মনে করতেন, সমবায় একটি মানবকল্যাণমূলক আর্থসামাজিক উন্নয়ন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে মানুষের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর এ ভাবনারই স্বীকৃতি আমরা পাই বর্তমান সময়ে এসেও যখন দেখি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গঠনে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তিমত্তার কথা জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে ২০১২ সালকে আন্তর্জাতিক সমবায় বর্ষ হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে। এ প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন বলেছিলেন, ‘সমবায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, অর্থনৈতিক মুনাফা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা একই সঙ্গে অর্জন সম্ভব।’

আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী সংস্থার (আইসিএ) সভাপতির ভাষায়, ‘সমবায় মানুষের চাহিদা মেটানোর কাজ করে, লোভ মেটানোর কাজ করে না’। এসব কথা বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন বলে আমরা মনে করতেই পারি। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, সমবায় সমিতি একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠান নয়। সমবায় সমিতি এমন একটি জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে থাকে গণতন্ত্র, অর্থনীতি, সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা, উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ, সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস, সর্বোপরি সদস্যদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধন।

গ্রামবাংলার দরিদ্র, দুঃখী, শোষিত কৃষক জনতার মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ‘বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম সমবায়’ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এ কর্মসূচির কতিপয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো (১) পাঁচশত থেকে এক হাজার পরিবার সমন্বয়ে গ্রাম সমবায় গঠন। (২) এসব পরিবারের সব কৃষিজমি সমবায়ের অধীনে ন্যস্তকরণ। (৩) প্রতিটি গ্রাম সমবায় পরিচালনার জন্য সমবায় সভ্যদের ভোটে একটি নির্বাচিত পরিষদ গঠন। (প্রত্যেক কর্মক্ষম ভূমিহীন কৃষক-মজদুর, মালিক-কৃষক বাধ্যতামূলক সমবায়ের সভ্য হবে।) (৪) মালিক-কৃষক ও ভূমিহীন কৃষক-মজদুর সমবায়ের কাজের জন্য নগদ পারিশ্রমিক পাবেন। (৫) সমবায় ক্ষেত-খামারে ও অন্যান্যভাবে উৎপাদিত ফসল সমান তিন ভাগে ভাগ করে ভূমি মালিক, ভূমিহীন কৃষক-মজদুর বা সমবায় ও সরকারের মধ্যে বিতরণ। (সরকারের প্রাপ্য অংশ স্থানীয় ধর্মগোলায় রাখতে হবে।) (৬) সরকার সমবায়ের কৃষি উৎপাদন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যাবতীয় উপকরণ বা সাজসরঞ্জাম স্বল্পমূল্যে বা ঋণে বা বিনামূল্যে সমবায়কে প্রদান করবে। (৭) সমবায় সভ্যদের যৌথ চাঁদা বা শেয়ারে গঠিত মূলধনে এবং সরকারের মূলধন ও ঋণে প্রতিটি সমবায়ের অধীনে নানা কুটিরশিল্প ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। (৮) সরকার ধর্মগোলায় রক্ষিত সম্পদের মধ্য থেকে একটি অংশ নিয়ে নেবে, বাকি অংশ সমবায়ের নানা দুর্যোগ ও প্রয়োজন মোকাবেলার জন্য জমা থাকবে। (৯) সরকার গ্রাম সমবায় এলাকার আইনশৃঙ্খলা, রাস্তাঘাট, অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, সেচ, সার, বীজ, কীটনাশক ওষুধ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ করবে। (১০) সমবায় তার সভ্যদের প্রদানকৃত শেয়ার মূলধন ও সরকারের ঋণ বা অংশগ্রহণের ভিত্তিতে যেকোনো ব্যবসা-বাণিজ্য ও ছোটখাটো কল-কারখানা স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে পারবে। (১১) প্রতিটি গ্রাম সমবায় উৎপাদন ও প্রশাসনিক ইউনিটরূপে গড়ে উঠবে। (১২) প্রতিটি গ্রাম সমবায় সমন্বয়ে একটি করে ‘আঞ্চলিক সমবায় কার্যালয়’ গড়ে উঠতে পারে, তবে থানা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে গ্রাম সমবায়সমূহের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। মূলত প্রতিটি গ্রাম সমবায় স্থানীয়ভাবে ‘সমবায় সরকার’ হিসেবে পরিগণিত হবে। সমবায়ের যাবতীয় নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব সমবায় সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকবে। সমবায় তথা বিভিন্ন সমবায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিবাদ মীমাংসার জন্য আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘সমবায় ট্রাইব্যুনাল’ গঠিত হবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ মানে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন আবর্তিত হয়েছিল শুধু কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে। তাই বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য গ্রহণ করেছিলেন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। যদিও তিনি সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে ১৯৯৪-৯৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপিতে মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যেত বাংলাদেশ এবং ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত গড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতো। এ পরিসংখ্যানগত উন্নয়ন তথ্য কোনোভাবেই অবাস্তব নয়, বরং চরমভাবে সত্য, আমরা বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কর্মদর্শনের মাধ্যমে যার প্রমাণ পাচ্ছি।

বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনসহ সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন; যেখানে তিনি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সমবায়কে। সমবায়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এ দর্শন বাস্তবায়নে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ। বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনাকে পাথেয় করে ইতিবাচক মানসিকতায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তাই আসুন বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে যথার্থ অর্থে কাজে লাগাই; আর উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তির অপরিহার্যতা প্রমাণ করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করি এবং আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলি আমাদের কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা।

লেখক: সমীর কুমার বিশ্বাস, উপসচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা