• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ভাবনার জগৎটা আমরাই বদলাতে পারি

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০১৮  


পৃথিবীতে বড় হতে হলে কি অনেক কিছু লাগে। কিছুই লাগে না। যেমন— আলবার্ট আইনস্টাইন পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি তো বড় বড় সব গবেষণা করেছেন। কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয়, এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর কোনো ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার ছিল না। তাঁর সব বড় বড় আবিষ্কারের পেছনে মাত্র তিনটি জিনিস ছিল। এর দুটি হলো কাগজ, কলম আর সবচেয়ে বড়টি ছিল তাঁর চিন্তাশক্তি। মানুষের বিবেক যদি ইতিবাচকভাবে জাগ্রত থাকে, তবে অনেক কিছু প্রয়োজন নেই শুধু বিবেক আর চিন্তাশক্তি থাকলেই চলে। কিন্তু আমরা সেটা ভুলে যাই। কখনো দেশের টাকা লুণ্ঠন করে দুর্নীতি করি। কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করে যা আমাদের করা উচিত নয়, তা করে বসে থাকি। নিজের স্বার্থের কথা ভাবতে গিয়ে সমাজ আর রাষ্ট্রের স্বার্থকে ছোট করে দেখি। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে দেশকে জনশূন্য করতেও আমাদের বিবেকে বাধে না। মাদক তো অনেক মানুষ আর পরিবারকে ধ্বংস করে কিন্তু খাদ্যে ভেজাল একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। এ বিষয়গুলো কি কখনো আমরা চিন্তা করি? সবাই দেখছি মানুষের পচন ধরেছে কিন্তু সেটা যে রুখে দিতে হবে তা নিয়ে তেমনভাবে ভাবছি না। উন্নয়নের সবখানেই আমাদের প্রগতি। মানবিক প্রগতিতেও আমাদের উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু মনের ভেতরের উন্নয়নটা ঘটাতে পারিনি। সেটারই উন্নয়ন বেশি দরকার।

২.

মন আর মানুষ, কোনটা বেশি মূল্যবান? প্রশ্নটা খুব অবাক হওয়ার মতো। কিন্তু বিস্ময়কর। যে মানুষের মন নেই তাকে কি মানুষ বলা যায়। মন থাকলেই মানুষ হয় আর মন না থাকলে কিসের মানুষ। আমি তো মানুষ খুঁজি না, একটা কিংবদন্তি মন খুঁজি। যে মন মানুষের মনকে আলোড়িত করে, আনন্দিত করে। শীতের কথাটা গায়ে লাগলেই কেমন শিহরিত হই। কিন্তু যারা শীতের দিনে খোলা আকাশের নিচে উদোম গায়ে ঘুমিয়ে থাকে তারা কি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে, নাকি স্বার্থপর মানুষদের দেখে কুণ্ঠিত হয়। কে জানে কেইবা বলতে পারে। নাকি একটা কোমল আলোর মন খোঁজে, যে মনের সূর্যের উত্তাপ তার জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে দেবে। আজকের দিনে মনটাও নাকি বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। মনটা ভাবছে এক আর করছে আরেক। মনও নাকি মানুষের বাজারে বিক্রি হয়। আমরা শুভ্র দীপালোকের বিচ্ছুরিত সম্ভাবনার মনের মতো মানুষ চেয়েছি। পাব কি না জানি না। তার পরও মন দিয়েই তো মানুষ খুঁজতে হবে। মন দিয়েই তো জীবন গড়তে হবে। প্রতীক্ষা দীর্ঘ রাতের অতৃপ্ত দুরন্ত স্বাধীন বাধাহীন একটা মনের। যার মধ্যে থাকবে গতিময়তা আর ছন্দ।

৩.

প্রতিদিন আমি মানুষ খুঁজি। মানুষের ভেতর প্রবেশ করি। তার দুঃখ, দ্রোহ, আনন্দ, বেদনা, দীর্ঘশ্বাস, পাপ, অভিশাপ, জীবন, মরণ, আবেগ, অনুভূতি, দরদ, জীর্ণতা, শীর্ণতা, সফলতা, ব্যর্থতা, আশা, হতাশা, দুঃসহ যন্ত্রণা, আর্তনাদ, ভীরুতা, কাপুরুষতা, বিশ্বাস, জয়, আকুতি, ব্যাকুলতা, চাপা কষ্ট, অনিন্দ্য সুখ, হাসি, অন্তহীন কান্না, কল্পনা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, অপরাধবোধ, অনুশোচনা, অভিমান, ক্ষোভ দেখতে পাই। কেউ যদি আমাকে এসে বলে আমি পচে গেছি, নষ্ট হয়ে গেছি, আমি বিশুদ্ধ হতে চাই, আমি আবার মানুষ হতে চাই। ভালো মানুষ। বিশ্বাস আর আস্থা রাখতে পারেন আমার ওপর। কারণ আমি মানুষকে বদলে ফেলতে পারি। নেতিবাচক ভাবনাকে ইতিবাচক ভাবনায় রূপান্তর করতে পারি। আত্মবিশ্বাসী আর আত্মনির্ভর করতে পারি। দুঃসহ যন্ত্রণার বোঝা টানতে টানতে একটা ক্লান্ত দেহ যদি জীবনকে স্বপ্ন দেখাতে চায়, তবে আমি দাঁড়িয়ে আছি তাদের অপেক্ষায়। হয়তো কিছু নেই আমার। কিন্তু জীবন আর স্বপ্ন দেখানোর সাহস আছে আমার। আমি হয়তো এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি কিন্তু নিজে ভেঙে ভেঙে গড়ার চেষ্টা করছি। প্রতিদিনের ভাঙাগড়া আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে মানুষকে গড়ে তুলতে হয় মানুষের মতো। শূন্য হাত, উদাত্ত মন খোলা জানালার মতো এখনো আমার চোখ দিয়ে সূর্যের কাঠখড় পোড়ানো জীবন্ত আলো দেখতে পায়। হয়তো আমি কিছুই না, তার পরও তো একটা অদৃশ্য বাতাস কিংবা অদৃশ্য মানুষ। হয়তো ভিন্ন গ্রহ থেকে বিতাড়িত আত্মা। এই ‘আমি’ পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তার মধ্যে যে কেউ হতে পারে। শুধু ভাবনার জগত্টা বড় করে দেখার একটা সুনিপুণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে । এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

৪.

প্রত্যেক মানুষের জীবনে দুঃসময় আসা দরকার। দুঃসময়ে চেনা যায় কে আপন ছিল আর কে পর। হয়তো বুকচাপা কষ্টগুলো মোচড় দিয়ে ওঠে। আবেগটা ভেঙে পড়ে আর নিজের অজান্তে দুচোখ দিয়ে দুফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। হয়তো সে জল মোছারও কেউ থাকে না। তার পরও আমি বলব, একজন মানুষের জীবনে দুঃসময় সুসময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো বাকহীন নিস্তব্ধ হবেন আপনি। চারপাশের দুর্যোগের মেঘগুলো অন্ধকার করে দেবে আপনাকে। কেউ আপনার সঙ্গে থাকবে না একমাত্র আপনি ছাড়া। কিন্তু আপনার সঙ্গে আপনি তো আছেন। যদি থাকেন, তবে আপনার আত্মপ্রতিরোধ আপনাকে আত্মশক্তি জোগাবে। দেখবেন একেবারে শূন্য থেকে আপনি একদিন এমনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তখন আপনার কাছে পৃথিবীটা অনেক বড় মনে হবে। দুঃসময় তো আপনার বন্ধু ছিল। সেটা সুসময়ের সময়ও আপনার সঙ্গে রাখবেন। দুঃসময় আপনার অভিজ্ঞতা হবে আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি কিন্তু জেনে গেছেন পৃথিবীর মহান সত্য একটি জিনিস, সেটি হলো কেউ কারো নয়। সুসময়ে সুবিধাবাদী বন্ধুরা জোটে আর দুঃসময়ে আপনিই আপনার অকৃত্রিম বন্ধু। কারণটা কি জানেন। তেমন কিছু না। কোনো কালেই কোনো মানুষের কাছে আপনি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না, যেমন ছিল তাদের স্বার্থটা, লোভ-লালসা আর হিংসা জিঘাংসা।

আমরা প্রায়ই বলি পৃথিবীটা খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেছে, বাস্তবতা খুব কঠিন আর নির্মম। কিন্তু এগুলোর তো কোনো প্রাণ নেই। প্রাণ, মন, আবেগ, ভাবনা, ভালোবাসা নাকি শুধু আছে মানুষের। আমি ঠিক এতটা বিশ্বাস করি না যতটা সবাই বলে আর ভাবে। আমি সব সময় বলি মানুষের মতো নিষ্ঠুর আর কঠিন পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। সময়ের হাওয়ায় মানুষ বদলে যায়, তখন নিজের স্বার্থটা তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। হয়তো আপনি তার জন্য সব করেছেন। জীবনটা দেওয়াই বাকি ছিল। সেটাও হয়তো দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু আপনার দুর্দিনে সে চোখ উল্টে ফেলবে। আপনার বিরুদ্ধে সে যতটা বেশি সরব থাকবে তার থেকে বেশি আর কেউ হবে না। যে ছাতাটা একদিন আপনার মাথায় ধরে নিজের ফায়দা লুটেছে। ‘মানুষ আর মানুষ নেই। সব ধান্দাবাজ, লোভী, স্বার্থপর আর কাপুরুষ।’ এই ধারণাটা পাল্টানোর মতো এখনো একটা মানুষ আমরা খুঁজছি। তবে আশা আর বিশ্বাসকে তো চিরকালের মতো গলা টিপে মেরে ফেলা যায় না। সেটা আছে বলেই হয়তো এখনো মানুষহীন পৃথিবী চলছে। আর মন বলছে মানুষ বদলাবে। স্বার্থের বদল নয়, মানুষ হওয়ার বদল। যেখানে দুঃসময়েও মানুষ থাকবে, যেমন ছিল সুসময়ে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা