• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

বিসিএস-ই জীবন নয়

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৬ আগস্ট ২০১৯  

বিসিএস হতেই হবে। না হলে জীবন চলবে না। বিসিএস না হলে অন্য কী করবো? তরুণ প্রজন্মের মুখে  কথাগুলো সম্প্রতি খুব বেশি শুনছি। ছোটবেলায় দেখতাম ছেলেমেয়েরা বলত; বড় হয়ে পাইলট হবো, ইঞ্জিনিয়ার হবো, ডাক্তার হবো, টিচার হবো, আর্মি অফিসার হবো, কিন্তু এখন শুধু শুনছি- বিসিএস ক্যাডার হবো।

ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষ থেকেই এখন ছেলেমেয়েরা বিসিএস-এর বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর বিসিএস-এর মোটা গাইড নিয়ে হচ্ছে লাইব্রেরিমুখী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্ত্বর এখন আর তাদের আকৃষ্ট করে না। আড্ডা-গান, নাটক, আবৃত্তিচর্চা টিএসসি’র নানা সংগঠনের সাথে নিজেকে না জড়িয়ে বিসিএস-এর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকছে তারা। যে বিষয়ে তারা অনার্স-মাস্টার্স করছে সে বিষয়েও জ্ঞানার্জনের সময় এখন তাদের নেই। ডিপার্টমেন্টের ভালো ফলের প্রতিও নেই আগ্রহ। আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে একমাত্র বিসিএস।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছি বিসিএস পরীক্ষার কারণে সিনিয়রদের অনেককে বাড়ি না যেতে। বিসিএস-এর আশায় কত ঈদ যে তারা স্বজনবিহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে লেখাপড়া করে কাটিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মুঠোফোনের ওপাশে সন্তানকে দেখার আকুতি জানিয়ে বাবা-মায়ের কান্না। এপাশে নীরব চোখের জল। তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি- বাড়ি গেলেই সবার প্রশ্ন-  কী করছো? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তাদের কাছে নেই। সেজন্য লজ্জায় বাড়ির পথে পা বাড়ান না তারা।

গত কয়েকটি বিসিএস-এ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো প্রায় আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ! সেখান থেকে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সর্বোচ্চ দুই হাজার প্রার্থী। আর নন-ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন তিন হাজার প্রার্থী। সব মিলিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার প্রার্থী চাকরি পাচ্ছেন। যা মোটের তুলনায় একেবারেই যৎসামান্য।

তারুণ্য মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জীবনের একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে বিসিএস পরীক্ষা দিতে। কয়েকটি বিসিএস-এর সময়সীমা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৮ থেকে ৩২তম বিসিএস-এর নিয়োগে সময় কিছুটা কম লাগলেও ৩৩তম বিসিএস থেকে সময় আবার বেড়েছে। বর্তমানে একটি বিসিএস-এর প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় দুই থেকে তিন বছর  লেগে যাচ্ছে। ৩৩তম বিসিএস-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। প্রার্থীরা চাকরিতে যোগ দেন ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট। সব মিলিয়ে এই বিসিএস-এ সময় লেগেছে দুই বছর পাঁচ মাস। ২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ৩৪তম বিসিএস-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২০১৬ সালের ১ জুন চাকরিতে যোগ দেন প্রার্থীরা। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে চাকরিতে যোগদানে সব মিলিয়ে লেগেছে প্রায় ৩ বছর ৪ মাস। ৩৫তম বিসিএস-এ সময় লেগেছে তার চেয়ে বেশি। সম্প্রতি আলোচনা চলছে ৩৮তম বিসিএস নিয়ে। এ বিসিএস-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ২০১৭ সালের ২০ জুন। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় ১ জুলাই ২০১৯ সালে। প্রায় ২ বছর লেগেছে শুধু এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে লিখিত পরীক্ষার ফল বের হতে। এখনও রয়েছে মৌখিক পরীক্ষা। তারপর চূড়ান্ত ফল, তারপর গেজেট। সবকিছু মিলিয়ে নিয়োগ পেতে আরো যে অন্তত এক বছর লাগবে সে বিষয়েও বলা যায় নিঃসন্দেহে। এদিকে ৪০ তম বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে মে মাসের তিন তারিখ। ইতোমধ্যে প্রায় ৮১ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো ফল প্রকাশ করেনি পিএসসি।

একটা ছেলে বা মেয়ে যখন প্রথম বিসিএস পরীক্ষা দেয় তখন তার বয়স ২৩ থেকে ২৪ বছর। ফল বের হতে হতে হয়ে যায় প্রায় ২৬ বছর। এরই মাঝে হয় আরও কয়েকটি প্রিলিমিনারি ও রিটেন পরীক্ষা। যদি দেখা যায় এর কোনোটিতেই সে সফল হয়নি তখন পরের বিসিএসগুলো দিতে দিতে বয়স প্রায় ২৮ বছর। এরই মাঝে উত্তীর্ণ হতে না পেরে মনোবল পৌঁছে যায়  শূন্যের কোঠায়। হাতে থাকা বাকি ২ বছর। তখন বিসিএস-এ সাফল্যের আশা প্রায় ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এরপর সে যখন কোনো প্রাইভেট চাকরিতে প্রবেশ করে ততদিনে জুনিয়রদের তার চেয়ে বড় অবস্থানে দেখে হতাশা আরও বেশি ঘিরে ধরে তাকে। কী করবে না করবে বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যায় জীবনের মূল্যবান সময়গুলো।

কেউ যদি কেবল বিসিএস-ই একমাত্র লক্ষ্য ধরে বসে থাকে তাহলে সেটি তার জীবনের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন বিসিএস-এ যারা সফল হয়েছেন, যারা প্রথম হয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখেছি শুধুমাত্র বিসিএস-ই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো না। তাদের সিংহভাগ অন্তত ৩টি চাকরি করে তারপর বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। সবাই যদি বিসিএস ক্যাডার হতে চায় তাহলে বড় বড় উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, গবেষক, বিজ্ঞানী, লেখক-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে কীভাবে?

একশ জন ছাত্রকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কয়জন বিসিএস দিতে চাও? কয়জন চাও না। তাহলে দেখা যাবে সেখানে প্রায় ৮৫ জন বিসিএস দেয়ার পক্ষে হাত উঠাবে। বাকি ১৫ জন হয়তো অন্য পেশায় যেতে চাইবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা খুব ভয়াবহ। আমি কোনটার জন্য যোগ্য, তা ঠিক করা জরুরী। যেকোনো মূল্যে আমাকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে এই ভাবনাটা তরুণ প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষার হার ও কর্মসংস্থানের প্রেক্ষাপটে এটা খুব ভয়াবহ। আমাদের সবসময় বিসিএস-এর বিকল্প ভাবনাটাও ভেবে রাখতে হবে। সে লক্ষ্যে পরিশ্রম করে নিজের মেধার সঙ্গে কাজের সমন্বয় করতে হবে। আমার কী করতে ভালো লাগে, আমি কোন বিষয়ে মেধাবী- আমাকেই আগে বুঝতে হবে।

লেখক: আফরিন আপ্পি

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা