• বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

বিধ্বস্ত জনপদে টিকে থাকার সংগ্রাম

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২০ মে ২০২১  

দুই বিঘা জমিতে চিংড়িঘের ছিল রোজিনা খাতুনের স্বামী ওবায়েদ গাজীর। ঘেরের এক প্রান্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের পাশে ছিল এক বিঘার বসতভিটা। ঘেরের আয় আর বসতভিটায় লাগানো শাকসবজিতে তিন সন্তান নিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের ছোট্ট সংসার। বছর শেষে উদ্বৃত্ত না থাকুক, কারও কাছে হাত পেতে কিছু চাইতে হতো না।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় জলোচ্ছ্বাসে ঘেরসহ বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে এ পরিবার। রোজিনা খাতুন বলেন, 'এক বছর আগের আর এখনকার মধ্যি আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আগে চাইলে মানুষকে সাহায্য করতাম। এখন সহযোগিতা নিতি হচ্ছে।'
কাশিরহাটখোলা এলাকায় ছিল কুদ্দুস গাজীর মুদি দোকান। তার বড় ছেলে রহমত গাজীরও ছিল আলাদা একটি দোকান। ছিল তিন বিঘার বসতভিটা এবং বিলে পাঁচ বিঘা ফসলি জমি। কিন্তু আম্পানের রাতে জলোচ্ছ্বাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কাশিরহাটখোলা এলাকা। এখন এ পরিবার বসবাস করছে বাঁধের ওপরের টংঘরে।
কুদ্দুস গাজী বলেন, 'কখনও ভাবতি পারিনি গাঙে জাল টাইনে খাতি হবে। পরিবারের মুখির অন্ন জোগাতি বাধ্য হয়ে তাই করতি হতিছে।'
ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম :গত বছরের ২০ মে খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ তীরবর্তী গাজীপাড়া গ্রামে ঘরবাড়ি ও ক্ষেত-খামার হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে এ রকম কয়েকশ পরিবার। তাদের অনেকে এখনও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে টিকে থাকার সংগ্রাম করে চলেছেন।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, অধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বেশিরভাগই পুনর্বাসনের আওতায় এসেছে। তবে বাস্তবচিত্র ভিন্ন। বিশেষত কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো রয়েছে বেশি অসুবিধায়। কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, লোনা পানি বসে যাওয়ায় প্রায় তিন হাজার বিঘা জমিতে ধান চাষ সম্ভব না হওয়ায় দুরবস্থা দেখা দিয়েছে দুই হাজার কৃষক পরিবারে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কয়রা উপজেলার চারটি ইউনিয়নে পাউবোর বেড়িবাঁধের ২১টি স্থান ভেঙে যায়। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি হয় ৪০ হাজার পরিবারের। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও চিংড়িঘের হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে এক হাজার আটশ পরিবার। বসতঘরের ক্ষতি হয় তিন হাজারের মতো পরিবারের। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ পর্যন্ত পুনর্বাসনের আওতায় এসেছে মাত্র ২৭৮ পরিবার। তবে অন্যদেরও এ সুবিধার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
বড় সমস্যা পাউবোর দুর্বল বাঁধ :সরেজমিনে দেখা গেছে, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া এলাকার ৫০টি পরিবার চেষ্টা করছে ঘুরে দাঁড়ানোর। তাদের কেউই সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে গৃহনির্মাণ সুবিধা পায়নি। তবে গ্রামবাসী মিজানুর মোল্লা বলেন, 'বাঁধ মেরামত না হলি, চাইলেও এ দুরবস্থা কাটানো সম্ভব হবি না।'
কয়রা উপজেলার ঘাটাখালি গ্রামের সিরাজুল আলম, গোবরা গ্রামের হাফিজুর রহমান ও দাকোপ উপজেলার সুতারখালির ইব্রাহিম শেখ বলেন, দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে।
উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার এক হাজার ৬৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা প্রায় একই রকম- প্রায় ৬০ বছর আগে তৈরি এই বাঁধগুলোর এখন আর দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা নেই।
কয়রার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আম্পানে ভেঙে পড়া বাঁধ মেরামত হলেও বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল বাঁধের অনেক স্থানেই মেরামত করা হয়নি। পাউবো সূত্র জানায়, কয়রায় আম্পানে ভেঙে যাওয়া ২১টি স্থানে মেরামতের পাশাপাশি ১৫ কিলোমিটার বাঁধে মাটির কাজ ও বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় ১০ কিলোমিটার সংস্কারকাজ চলছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, আম্পানে এ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে চারটির ক্ষতি হয়েছে বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নানাভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। তবে এখানকার বড় সমস্যা পাউবোর দুর্বল বেড়িবাঁধ। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার।সংস্কার চান জনপ্রতিনিধিরা :কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ষাটের দশকে বাঁধ তৈরির পর আর কখনও নতুন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধগুলোর ক্ষতি হলেও সংস্কারকাজ হয়েছে দায়সারা গোছের।
এ ব্যাপারে খুলনা-৬ (কয়রা ও পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ মো. আকতারুজ্জামান বাবু সমকালকে বলেন, গত বছর ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর এটি স্পষ্ট যে, দুর্বল বেড়িবাঁধ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকার নানা ক্ষতি হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে।
পাউবো খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল হোসেন জানান, নানা কারণে বাঁধগুলোর সক্ষমতা কমেছে। এ অবস্থায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য সাতটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমবে।
ঝুঁকিপূর্ণ, বসবাসের অনুপযোগী বাড়িঘর :পশুর নদের তীরে খুলনার দাকোপ উপজেলার চালনা কলোনিপাড়া এলাকায় খাসজমিতে ৩০ বছর ধরে বসবাস করেন ভ্যানচালক আবদুর রহমান। ঘূর্ণিঝড় আইলা, আম্পানসহ চারটি ঝড়ে তার ঘরবাড়ি ভেঙেছে। কিন্তু যাওয়ার মতো কোনো জায়গা না থাকায় প্রতিবারই কোনোমতে মেরামত করে পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে তিনি সেখানেই পড়ে আছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার নদীর আশপাশের এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। আবদুর রহমানের মতো হাজারো মানুষ ঝুঁকি নিয়ে নদীর তীরে ও বেড়িবাঁধের পাশে নিজের জমি বা খাসজমিতে বসবাস করছেন। ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু তারপরও তাদের অন্য কোথাও স্থানান্তর করার বা দুর্যোগ সহনশীল ঘর তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই।
খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলায় নদীর তীরে ও বেড়িবাঁধের পাশে এমন অসংখ্য মানুষের বসবাস। তিনটি জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, তিন জেলার উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ থাকে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা মানুষের কোনো পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই।
খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন সমকালকে বলেন, উপকূলীয় তিন জেলায় যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করেন, তাদের স্থানান্তর, ঘর তৈরি করে দেওয়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা