• বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

বারোবাজারে সুলতানি আমলের ১৯ মসজিদ ও নিদর্শন

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

পঞ্চদশ শতাব্দির রাজধানীখ্যাত শাহ মোহাম্মদাবাদে সুলতানী সাশনামলের ঐতিহাসিক স্থান বারোবাজারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক ১৯ মসজিদ, স্থাপনা ও নিদর্শন। এ সবই সুলতানি আমলের স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন।

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য সুপরিচিত স্থান বারোবাজার। এটি উপজেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে আর যশোর জেলা শহর থেকে ১৭ মাইল উত্তরে অবস্থিত।

ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দুই ধারে শত শত পুকুর ও দিঘির স্বচ্ছ পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ আর বুড়ি ভৈরব নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা ঐতিহাসিক মসজিদ পরিবেষ্টিত এই বারোবাজার।

জানা যায়, বারোজন আউলিয়ার নামানুসারে বারোবাজারের নামকরণ করা হয়। আউলিয়ারা হলেন- এনায়েত খাঁ, আবদাল খাঁ, দৌলত খাঁ, রহমত খাঁ, শমসের খাঁ, মুরাদ খাঁ, হৈবত খাঁ, নিয়ামত খাঁ, সৈয়দ খাঁ, বেলায়েত খাঁ ও শাহাদাত খাঁ।

এই বারোবাজারকে পর্যটন এলাকা ও প্রত্নতাত্তিক জাদুঘর স্থাপনের দাবিতে সম্প্রতি স্থানীয় কিছু ব্যক্তি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলনসহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠাণ্ডু তাদের এই দাবির সাথে একমত ঘোষণা করে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘বারোবাজার প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা আন্দোলন কমিটি’ নামে একটি গ্রুপ প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রুপের ভাষ্য, কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার এলাকায় রাজ্য ছিল, রাজ সিংহাসনও ছিল, একসময় এখানে সুপ্রশস্ত রাজপথ আর শান বাঁধানো ঘাটও ছিল। যা কালের চক্রে বিলিন হবার পথে।

jagonews24

১৯৯০-৯২ সালে স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ এখানে প্রত্ননিদর্শনগুলো উদ্ধারের জন্য খনন কার্য পরিচালনা শুরু করে। সেই সময় বেশ কিছু মসজিদ, সেনা ছাউনি, সিড়ি, কবরস্থান, নদী বন্দর বা জাহাজ ঘাট আবিস্কৃত হয়।

আউলিয়াদের পূন্যভূমি বারোবাজারে আরও রয়েছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ গাজি-কালু-চম্পাবতীর মাজার। রয়েছে সুলতানী শাসন আমলের ১৯ টি মসজিদ। যা এতদিন মাটির নীচে ঢাকা ছিল। এখনো মাটির নীচে ঢাকা রয়েছে সাতটি মসজিদ। এছাড়া দিঘি রয়েছে ২০ টি।

ইতিহাস থেকে জানা যায় এখানে ১২৬ টি দিঘি ছিল কিন্তু কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। অনেক স্থান দখল হয়ে গেছে। প্রায় ১০ বর্গ মাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে বহু অজানা প্রত্ন সম্পদ।

‘বিলুপ্তি নগরী বারোবাজার’-এর লেখক ও গবেষক রবিউলি ইসলাম জানান, বারোবাজারে প্রতিদিন শত শত লোক আসে পঞ্চদশ শতাব্দির নিদর্শন ও সুলতানি আমলে স্থাপিত মসজিদসহ আবিস্কৃত স্থাপনা দেখতে। এই এলাকা এখন পর্যটন এলাকা। তাই এখানে প্রত্নতাত্তিক জাদুঘর স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

বিশেষ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম আর্কিটেক্চরের শিক্ষার্থীরা এখানে আসে রিসার্চ করতে। তাদের প্রয়োজনে আমরা এলাকার মানুষদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করছি। আন্দোলনে অংশ নিয়েছে এলাকার তরুণ যুবকসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, এলাকার সুধীজন, সাংবাদিক ও শিক্ষকরা।

jagonews24

বারোবাজার এলাকা  যদি পর্যটন এলাকা ও প্রত্নতাত্তিক জাদুঘর স্থাপন করা হয় তাহলে এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অনেক এগিয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার জানান, বারোবাজার এলাকা প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনে ভরপুর। ১৯৯২ সালের দিকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বেশ কিছু ঢিবি খুড়ে এই নিদর্শনগুলো উদ্ধার করে। এলাকাবাসীর জোর দাবি, এখানে পর্যটন এলাকা ও জাদুঘর স্থাপনের।

তিনি আরও বলেন, এই সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণাদি যদি আমার কাছে দেয়া হয়, তাহলে তিনি পর্যটন এলাকা ও জাদুঘর স্থাপনের জন্য মহান সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করবেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়-

বঙ্গ বিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নদীয়া দখলের পর নদীয়ার দক্ষিণ বা দক্ষিণ পূর্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে মনোযোগী না হয়ে উত্তর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে তার বিজিত রাজ্য উত্তর দিকে প্রশস্ত হতে থাকে।

অবশেষে সামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৬৬৮)-এর শাসনামলে যশোর ও খুলনার কিছু কিছু অংশ তার রাজ্যভুত হয়।

jagonews24

ওই অঞ্চলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন বৃহত্তর খুলনা জেলার বাগেরহাটের পরশমণি শ্রেষ্ঠ আওলিয়া হযরত খান জাহান আলী। তিনি ১৪৫৯ সালে (৮৬৩) হিজরী ২৩ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।

তিনি এক সময় নিজের আত্মরক্ষার্থে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতগঞ্জ প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বৃহত্তর যশোর জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার হাকিমপুর হয়ে বারবাজার অভিমুখে রওয়ানা দেন।

পথিমধ্যে জনসাধারনের পানীয় জলের তীব্র কষ্ট দেখে তিনি এ অঞ্চলে অগনিত দিঘি আর পুকুর খনন করেন। কথিত আছে, একই রাতে এ সব জলাশয় খনন করা হয়েছিল। ফলে বারোবাজার অঞ্চলের ৮৪ একর পুকুর ও দিঘি এখনও বিদ্যমান।

বারোবাজার ইউনিয়নে যত প্রত্নতত্ব নির্দশন

- বারবাজারে সাতগাছিয়া মৌজায় আদিনা মসজিদ অবস্থিত। এটি ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। এটি ১৯৯২ সালের দিকে আংশিক সংস্কার করা হয়। সাতগাছিয়া মৌজায় কোটালী মসজিদও অবস্থিত।

- ঘোপপাড়া মৌজায় ঘোপ ও আড়পাড়া ঢিবি অবস্থিত। এটি রওজাশরীফ।

jagonews24

- সাদিকপুর মৌজায় চোরাগদানি মসজিদ অবস্থিত। সাদিকপুর মৌজায় মনোহর ১৬ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিও অবস্থিত।

- বারবাজার মৌজায় জোড় বাংলা মসিজদ অবস্থিত। এটিও ১৯৯২ সালের দিকে সংস্কার করা হয়। এখন এখানে লোকজন নামাজ পড়ে। তবে পাশে একটি দিঘী আছে যা সংস্কার করা প্রয়োজন। বারবাজার মৌজায় ৬ গম্বজ বিশিষ্ট গলাকাটা মসজিদও অবস্থিত।

- বেলাট দৌলথপুর মৌজায় নামাজগাজ রওজাশরীফ অবস্থিত। একই মৌজায় ৪ গম্বুজ বিশিষ্ট গোড়ার মসজিদ অবস্থিত। এখানে মানুষ নামাজ পড়ে। অনেক সময় এখানে বিভিন্ন সময় মনের বাসনা পুরণে মানত করে সাধারণ মানুষ।

তাছাড়া এ মৌজায় ১৬ গম্বুজ বিশিষ্ট পীর পুকুর মসজিদ, সওদাগর মসজিদ এবং পাঠাগার মসজিদ আবিস্কৃত হয়। এখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক শাহী মহল। যা সেকেন্দার বাদশার বসতবাড়ি ছিল।

- বারোবাজারের মিঠাপুকুর এলাকায় আবিস্কৃত হয় নুনগোলা মসজিদ। মাতারানী রওজা শরিফও রয়েছে এখানে।

jagonews24

- হাসিলবাগ এলাকায় দমদম জাহাজঘাট, সেনানিবাস ও নদী বন্দর ছিল। সেখানে আবিস্কৃত হয় শুকুর আলী মসজিদ।

- বাদিডিহি এলাকায় রয়েছে আলোখা মসজিদ। ২০০২ সালে প্রত্নতত্ব বিভাগ এটি খনন করে।

- বারবাজার  ইউনিয়নের বাদুরগাছা এলাকায় গাজী-কালু-চম্পাবতীর আস্তানা ও রওজা শরিফ রয়েছে। এ এলাকায় দিঘী পরিবেষ্টিত শ্রী রাম রাজার বাড়িও অবস্থিত।

- মুরাদগড় এলাকায় রয়েছে ৩টি ঢিবি।

এছাড়াও বারোবাজার ইউনিয়নের ১০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রচুর দীঘি ও পুকুর। বারোবাজার ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত অনেক প্রত্নতত্ব সম্পদ বিলুপ্তির পথে। যার বেশির ভাগই খনন বা পুনঃখনন খুবই প্রয়োজন।

jagonews24

বারোবারের পুকুর নিয়ে জনশ্রুতি আছে-

এ ইউনিযনে ছয় কুড়ি ছয়টি অর্থাৎ ১২৬টি দীঘি ও পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি উল্লেখযোগ্য দিঘির নাম ও পরিধির কথা জানা যায়-

- পীরপুকুর : ৪ একর;

- গোড়ার পুকুর : ৫ একর;

- সওদাগর দিঘি : ১১ একর;

- সানাইদার পুকুর : ৩ একর;

jagonews24

- সাত পীরের পুকুর : ৩ একর;

- ভাইবোনের দিঘী : ৪ একর;

- আনন্দ দিঘী : ২ একর;

- গলাকাটা দিঘী : ৪ একর;

- জোড়াবাংলা দিঘী : ৩ একর;

jagonews24

- চোরাগদা দিঘী : ৪ একর;

- মাতারানী দিঘী : ৮ একর;

- নুনগোলা দিঘী : ৩ একর;

- কানাই দিঘী : ৩ একর;

- পাঁচ পীরের দিঘী : ৩ একর;

jagonews24

- মনোহর দিঘী : ৩ একর;

- আদিনা দিঘী : ৩ একর;

- শ্রীরাম রাজার দিঘী : ১০ একর এবং

- বেড় দিঘী : আট একর।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা