• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

বদলে যাবে দেশ, এই ব্রতে মনোনিবেশ

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০১৯  

পোকেটক  (Pocketalk) পকেটে বহনযোগ্য ছোট্ট একটি ডিভাইস। প্রায় ৭৪টি ভাষার অনুবাদক যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। একজন পর্যটক বা ব্যবসায়ীর জন্য ডিভাইসটি অতি প্রয়োজনীয়। এর মাধ্যমে অতি সহজে অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কথোপকথন সম্ভব। যন্ত্রটি তৈরি করেছে জাপানের সোর্সনেক্সট  (Sourcenext) নামের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই যন্ত্রটির মধ্যে ব্যবহৃত সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে অবস্থিত একটি বহুজাতিক কম্পানির সফটওয়্যার ল্যাবরেটরিতে। আবার পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় স্মার্টফোন প্রস্তুতকারী কম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা রয়েছে বাংলাদেশে। এখানেও স্মার্টফোনের নানা অ্যাপলিকেশন প্রগ্রাম তৈরি হচ্ছে। এগুলো আমাদের সক্ষমতার গল্প। সাশ্রয়ী শ্রম বাজারের কারণে অনেক বিদেশি কম্পানি এখানে আসবে এটাই স্বাভাবিক। যে দুটি কম্পানির কথা আমি উল্লেখ করলাম তারা বছরে এক হাজার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিতে পারে। কিন্তু তাদের প্রগ্রামিং অ্যাপটিচিউট টেস্ট পাস করে প্রতিবছর ২০০ ইঞ্জিনিয়ার খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

কেন এমনটি হচ্ছে? একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার আইসিটি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ, গড়ে তোলা হচ্ছে ডিজিটাল অবকাঠামো। এর পরও আইসিটির দক্ষ জনবল তৈরিতে দুর্বলতা কোথায়?

বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য ম্যানেজমেন্টের চারটি ধাপের কথা আজ আলোচনা করব। যেকোনো উৎপাদনমুখী কাজ শুরু করা থেকে তার সফলতা প্রাপ্তির সময়কালকে আমরা চারটি ধাপে ভাগ করতে পারি। ধাপগুলো হলো—ফরমিং (Forming), স্টরমিং (Storming), নরমিং (Norming) এবং পারফরমিং  (Performing)। কোনো কর্মযজ্ঞের শুরুতে যে আয়োজন, তাকে আমরা ফরমিং ধাপ হিসেবে অভিহিত করছি। একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন তার সঙ্গে শিক্ষক, বই, প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো, সহপাঠীর সঙ্গে সর্বজনীন জ্ঞান অর্জনে প্রারম্ভিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এপর্যায়কে আমরা ফরমিং ফেজ (Forming face) বলতে পারি। এর পরের ধাপটি হলো স্টরমিং  (Storming)। এই ধাপটি দক্ষ জনবল তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এপর্যায়টি যত বেশি সৎ ও স্বচ্ছ হবে, শিক্ষাও ততটাই মানসম্মত হবে। স্টরমিং ফেজে ছাত্রের মধ্যে জানার আগ্রহ এবং শিক্ষকের মধ্যে জানানোর আগ্রহ থাকতে হবে প্রবল। ব্যাবহারিক ক্লাস ও পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করে সার্টিফিকেট-নির্ভর ডিগ্রি পাওয়া বা ব্যাবসায়িক কারণে সার্টিফিকেট-নির্ভর ডিগ্রি দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পড়াশোনার সুন্দর পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক, বোঝানো ও বোঝার চেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তবে এই ধাপের সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটবে। এর পরবর্তী ধাপই হলো জ্ঞানের স্বাভাবিকতা ও পরিপূর্ণতা। যাকে নরমিং ফেজ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এপর্যায়ে জ্ঞানের সাবলীল প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত থাকে শিক্ষার্থী। তারা হয়ে উঠে প্রত্যয়ী। স্টরমিং ধাপের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষার্থী জানে জীবনে হারতে নেই। সঠিক পথে মাথা খাটালে এবং পরিশ্রম করলেই যেকোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব। স্টরমিং এবং নরমিং ফেজ দুটি গাণিতিক প্রক্রিয়ায় সমানুপাতিক। স্টরমিং ধাপটি যতটা নির্ভেজাল হবে, জ্ঞানের নরমিং ধাপ ততটাই হবে উন্নত। নরমিং ধাপটি পরিপূর্ণ হলে পারফরমিং ধাপটি পূর্ণরূপে কার্যকর হয়। কিন্তু বিপুলসংখ্যক আইসিটি গ্র্যাজুয়েট বের হওয়ার পরও কর্মক্ষেত্রে দক্ষ জনবল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—দুর্বলতা কোথায়? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস নেওয়ার পরিবেশ অনেক কারণে বিঘ্নিত হয়। তার মধ্যে রয়েছে আমাদের নিজেদের মধ্যে দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব, ল্যাবগুলোতে ক্লাস চলার সময়ে ইন্টারনেট ও মোবাইলের ব্যবহার ইত্যাদি। ক্লাস চলাকালে ইন্টারনেট ও মোবাইলের ব্যবহার শিক্ষার্থীকে অনৈতিক করে তোলে। যেকোনো ছোট অ্যাসাইনমেন্ট বা সমস্যা সমাধান করতে দিলে শিক্ষকের অজান্তেই মোবাইল ও ইন্টারনেটের সহায়তায় দ্রুত কপি করে রেজাল্ট দেখিয়ে দেয়। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীর স্টরমিং ফেজ। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদের অনুসরণ করতে হবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দৃষ্টান্ত। যেকোনো ল্যাবে ল্যাব চলাকালে ইন্টারনেট সংযোগ থাকে না। স্মার্টফোনের ব্যবহারও নিষিদ্ধ। স্মার্টফোনকে ইতিবাচক ব্যবহারের হাতিয়ার না বানিয়ে ২৪ ঘণ্টা চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে কমছে পড়াশোনার সময়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মনের একাগ্রতা এবং পৌঁছানো দুষ্কর হয়ে পড়ছে অভীষ্ট লক্ষ্যে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোতেই শিক্ষা বিষয়ে ইউজিসির তদারকি সেল থেকে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে গিয়ে যদি স্টরমিং ফেজ হালকা করে ফেলি, তাহলে নরমিং ফেজও কুয়াশাচ্ছন্ন ও ধোঁয়াশা রয়ে যাবে, ফলে পারফরমিং ফেজে কার্যসম্পাদনকারী দক্ষ জনবল তৈরির প্রচেষ্টা অধরাই থেকে যাবে।

গ্র্যাজুয়েশনের পরে বাস্তব জীবনে কাজ করতে কিছু দুর্বলতা থাকতেই পারে। সেটি যদি সমুদ্র সমান না হয়, তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। তাই যারা চাকরির ক্ষেত্রে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাপটিচিউট প্রগ্রামিং টেস্টের সঙ্গে পরিচিত নয়, তাদের জন্য যদি সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে সফটওয়্যার শিল্পের জন্য প্রত্যয়ী দক্ষ জনবল তৈরি হতো। বিষয়টি নিয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হলে বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো সম্ভব সফলতার গাণিতিক মডেল। বাস্তব অভিজ্ঞতায় সরকারের মহতী উদ্যোগ ও দূরদর্শী চিন্তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি এবং প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি দক্ষ জনবলের।

লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ,

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা