• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অসামান্য অবদান ও ত্যাগ

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৯ জানুয়ারি ২০২০  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিভিন্ন মামলায় হাজিরা দেওয়ার প্রয়োজনে গোপালগঞ্জ জেলা শহরের কোর্টে আসা-যাওয়া করতে হতো বিভিন্ন সময়ে। সেই সময়টাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় নৌকার উপর ভরসা করে যাতায়াত করতে হতো সে এলাকার মানুষগুলোর। এ রকম একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে সহচরদের, ‘‘গোপালগঞ্জে যেয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা, মা, রেণু, হাসিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল। এরাও এইমাত্র বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেছে। এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাসিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনেও না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল। আব্বা মাকে ধমক দিলেন এবং কাঁদতে নিষেধ করলেন।’’

ফজিলাতুন নেছা সুযোগ পেলেই সন্তানসহ স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, কারণ সন্তানরা যেন তার বাবা সম্বন্ধে জানতে পারে এবং তিনিও স্বামীর সার্বিক খোঁজখবর নিতে পারেন। টানা এক বছর পরে স্বামীর সাথে দেখা হওয়ার পর একজন রমণীর মাঝে আবেগ-অনুভূতির যে প্রকাশ ঘটতে পারে, তার বিন্দুমাত্র তিনি প্রকাশ করতেন না। কারণ, তিনি জানতেন এ আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটালে কারাগারে স্বামীর কষ্ট হতে পারে, তাই যতটা পারতেন নিজে সংবরণ করে থাকতেন।

জেল গেটে দেখা করার সময় ফজিলাতুন নেছা শেখ মুজিবকে বিভিন্ন অনুরোধ করতেন, পরামর্শ দিতেন, সাধ্যমত রাজনৈতিক পরিস্থিতির খোঁজখবর আদান-প্রদান করতেন।

বাঙালির ঐতিহ্য আর চিরকালীন রূপায়িত গৃহিনীর ন্যায় ফজিলাতুন নেছাও স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন। কখন আবার অতিরিক্ত রাজনৈতিক চাপে কী হয়ে যায়? তাই স্বামীর সঙ্গে কারাগার, জেল-হাজত বা কোর্টে সাক্ষাতের সময় স্মরণ করিয়ে দিতেন আগে জীবন পরে রাজনীতি। আসল মানুষটা না থাকলে রাজনীতিটা করবেন কে? কেননা, শেখ মুজিবের রক্তেমাংসে মিশে ছিল বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নিশানা ও সাধারণ মানুষের শোষণ-শাসন ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি-আন্দোলনের দ্রোহ। তাই তো, ফজিলাতুন নেছা বঙ্গবন্ধুর শারীরিক এবং মানসিক উভয় বিষয়কে সামঞ্জস্যতায় এনে রাজনীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন।

জীবনের একটা বিরাট সময় জেলখানাতেই ছিলেন শেখ মুজিব। পরিবার পরিজন ছেড়ে একজন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে জীবন কাটানো যে কতটা কষ্টের তা একমাত্র জেলে আটক থাকা ব্যক্তিটিই উপলব্ধি করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব উল্লেখ করেন: ‘রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়-স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা কত যে জঘণ্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’

সামরিক সরকারের সময় কোন যৌক্তিক কারণ ব্যতিরেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে জেলখানায় রাখা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে জেল গেটে স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন ছিল এমন: “রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কী করে?’ কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হলো উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাসু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, “খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কী? পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হল।” স্বামীর প্রতি আনুগত্য, আবেগ ও সহমর্মিতা ফজিলাতুন নেছার চরিত্রকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফজিলাতুন নেছার চরিত্র বাঙালি জাতির সকল নারীর কাছে আদর্শের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত।

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সামরিক সরকার বিভিন্ন সময়ে নানান অজুহাতে জেল-হাজতে প্রেরণ করেছিলো। পরিবারের কাছে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য না দিয়েই এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণ করতেন তৎকালীন সরকার। এ রকম একবার বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কারাগার থেকে গোপালগঞ্জে কারাগারে প্রেরণ করে কোন রকম তথ্য প্রদান না করেই এবং সে সময় অনশন করায় শেখ মুজিব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে সাক্ষাতের সময় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “রেণু কেঁদে ফেলল এবং বলল- তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা করে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়ামায়া আছে? আমাদের কারও কথা তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কী করে বাঁচতাম? হাসিনা, কামালের অবস্থা কী হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা? আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। শুধু বললাম-উপায় ছিল না।”

ফজিলাতুন নেছা বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে আজীবন জাগরুক থাকবে তার অবদান ও ব্যক্তিসত্তায়। স্বামীর প্রতি ফজিলাতুন নেছার আবেগ, অনুভূতি, ভালবাসা ও আগ্রহের বৈশিষ্ট্যতা ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। কারাগারে স্বামী অথচ ফজিলাতুন নেছা নিজে নিরাশ না হয়ে স্বামীর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতেন।

তৎকালীন সময়ের ছাত্রনেতা সুলতান শরিফ বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাককালীন ফজিলাতুন নেছা মুজিবের দায়িত্ব সম্পর্কে মূল্যায়ন করে বলেন: ‘১৯৫৪ সালের স্বল্পকালীন মন্ত্রিসভার পর আবারো জেলে যান শেখ মুজিব, রাজনৈতিক কর্মীদের একত্রে রাখা এবং নিজের সংসারকে সচল রাখা, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সন্তানের দেখাশোনা করেছেন, লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন, এই সময়ে রাজনৈতিক কর্মী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর যাদের প্রতি অবাধ ভালবাসা ছিল তাদের দেখাশোনা করেছেন। তাদের প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য, শ্রদ্ধা-ভালবাসা, প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে আমাদের সকলের কাছে অত্যন্ত উপযোগী এবং অন্যান্য পরিবারের জন্য উদাহরণস্বরূপ হয়ে জীবনযাপন করতেন বঙ্গবন্ধুর আদরের রেণু। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যে বাড়িটিতে গেলে মায়ের স্নেহ পেতাম, ঐ বাড়িতে নিজেদের মত করেই থেকেছি, কখনোই মনে হয়নি অন্যের বাড়িতে গিয়েছি, বন্ধুবান্ধব সবার কাছেই শুনেছি বেগম মুজিবের গুণকীর্তনের কথা। অনেক সময় নিজেদের বাড়ির তুলনায় ঐ বাড়িতে বেশি আদর যত্ন পেয়েছি আমরা। রাজনৈতিক কর্মী ব্যতীত অন্যদেরও পরম মমতায়, প্রোটেকশন দিয়ে পরিচিতজন এবং তাদের ছেলেমেয়েদের রক্ষা করেছেন তার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে গোপালগঞ্জ এবং বরিশাল থেকে যারা ঢাকায় আসত তাদের সবার ঠিকানা ছিল ধানমন্ডি ৩২।’ একবার ভাবা যায়, একজন মানুষ কতটা দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হলে এমন দৃঢ়চেতার অধিকারী হয়, তার সবটুকুই ফজিলাতুন নেছা অর্জন করেছিলেন।

কারাগারে বেগম মুজিব নিয়মিত স্বামীর সাথে দেখা করতেন। তিনি নিজেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত স্বৈর-সরকারের বিভিন্ন মামলা চালানোর অর্থ সংগ্রহের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতেন। ছয় দফা আন্দোলন ও আগরতলা মামলার সময় বেগম মুজিব তদানীন্তন পাকিস্তান শাসক ও শোষক আইয়ুব-মোনেমের রোষানলের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন নেপথ্যে থেকে। এই দুর্দিনের সময় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির সামনে দিয়ে একটি কাকও উড়ত না। সেসময় মুজিব পরিবারের চরম দুর্দিন।” দলের এবং সংসারের চরম দুর্দিনে কখনো একটিবারের জন্যও মনোবল হারাননি বাঙালির পরম আশ্রয়স্থল ফজিলাতুন নেছা। তিনি ঠিকই নিজস্ব প্রজ্ঞায় এবং সাধনায় সকল ধরণের বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকাবস্থায় বঙ্গজননীর সাথে নিয়মিত চিঠি আদান প্রদান করতেন। সেই সব চিঠি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীরতাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। সাংসারিক চিন্তা, রাজনৈতিক পরিকল্পনা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর দিতেন ও নিতেন পরস্পর। পাশাপাশি বঙ্গজননীকে নিয়ে জাতির জনক দুশ্চিন্তা করতেন, এত বড় সংসারের ঘানি টানতে টানতে বঙ্গজননী পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তেন। সে বিষয়গুলো নিয়ে জেলে বসে ভাবতেন জাতির জনক।

এমনই এক চিঠির প্রতিউত্তরে শেখ মুজিবকে লিখেছিলেন বঙ্গজননী এবং সেটি আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গজননী লিখেছিলেন, “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভার ছেড়ে দেন।” অর্থাৎ, স্বামীকে উৎসাহ প্রদানের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা ও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন সর্বক্ষণ। এমন একজন স্ত্রীর জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রাম ও রাজনৈতিক আন্দোলন কখনোই ব্যর্থ হয়নি।

বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন সংসারের পাশাপাশি সকল কাজকর্মই করতে হতো ফজিলাতুন নেছাকে। মায়ের সার্বিক বিষয়/ সাংসারিক দায়িত্ব পালন নিয়ে শেখ রেহানা বলেন, “জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি আমার বাবা কারাবন্দী। মা তার মামলার জন্য উকিলদের সঙ্গে কথা বলছেন, রাজবন্দী স্বামীর জন্য রান্না করে নিয়ে যাচ্ছেন, গ্রামের শ্বশুর-শ্বাশুড়ী ও আত্মীয়-স্বজনদের খবরাখবর রাখছেন। আবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, যারা বন্দী তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে টাকাও পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারাগারে দেখা করতে গিয়ে স্বামীর কাছে বাইরের সব খবর দিচ্ছেন এবং তার কথাও শুনে আসছেন। কাউকে জানানোর থাকলে ডেকে জানিয়েও দিচ্ছেন। এরপর আছে তার ঘর-সংসার। এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের আবদার, লেখাপড়া, অসুস্থতা, আনন্দ-বেদনা সবকিছুর প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়। এতকিছুর পরও তার নিজের জন্য সময় খুঁজে নিয়ে তিনি নামাজ পড়ছেন, গল্পের বইও পড়ছেন, ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতেন।”

একজন জননী নিজেকে স্বার্থক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যে অন্তিম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তার নমুনাই আমাদের বঙ্গজননী এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন সেই যাত্রায়। এতকিছুর পরও সবসময় মুখের হাসি লেগেই থাকতো সর্বক্ষণ।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা