• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

আমি প্রথম শুনেছি বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ১৯৬৬ সালের পর যখন উনি ‘ছয় দফা’র সমর্থনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ কিংবা মিটিং করেছেন ঠিক সেই সময়েই। তিনি গিয়েছিলেন সিলেটে। তো সিলেটে সেই রেজিস্ট্রি, রেজিস্ট্রি বলতে যেখানে আইনের কিছু বিষয় থাকে। সেই রেজিস্ট্রার মাঠে তিনি বতৃক্তা দিয়েছিলেন। তো এই প্রথম আমি এমন বাগ্মিতার পরিচয় পেলাম এবং আমরা মাঠের দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চাইতেন না যে, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশেষ করে ছাত্ররা এতে অংশগ্রহণ করুক। এখন যে রকম পাড়ায় পাড়ায় মন্ত্রীরা গেলে স্কুল-কলেজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়; তো বঙ্গবন্ধু এগুলো একেবারেই পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা গেলে তিনি খুবই বিরক্ত হতেন এবং তাঁর কথা ছিল যে, এ বয়সে ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে থাকবে, পড়ালেখা করবে। আর যারা ছাত্র রাজনীতি করে তারা কিছুটা বয়স হলে তারপর আসতে পারে। এজন্য একটু ভয়ে ভয়ে আমরা একটু দূরেই এবং আমাদের বলেই দেয়া হয়েছিল যে, আমরা যেন একেবারে সামনে না যাই। তাই আমরা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তখন এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি ঠিক সেই সময়েরই ঘটনা এটি। তখন আমার মনে হয়েছিল, অসাধারণ একটি বতৃক্তা শুনলাম। এবং সেখানে তিনি হাস্য-রসেরও কিছু জোগান দিয়েছিলেন। কিছুটা কৌতুক, সরস কথাবার্তা কিন্তু মূল বক্তব্যটা খুবই প্রায়োগিক ছিল। তবে তাঁর একটি কথা আমার এখনও কানে বাঁজে। তিনি বলেছিলেন— ‘সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না, আঙ্গুল ত্যাড়া করতে হয়।’ এই কথায় আমরা খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। আমার মনে আছে জোরে জোরে হাততালিও দিয়েছিলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনেছি কয়েকটি। কিন্তু আমার কাছে কানে লেগে আছে আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ শোনা ‘৭ই মার্চে’র ভাষণ। সোহওরার্দী উদ্যানেই শুনেছিলাম ভাষণটি। বিদেশি এক রেডিও সাংবাদিক এসেছিল। সে একজন দো-ভাষী খুঁজছিলেন। তার সঙ্গেই আমি গেলাম সোহওরার্দী উদ্যানে। সাংবাদিকের যেহেতু আলাদা একটা বসার জায়গা থাকতো আমাকে তাই সেখানে নিয়েই তিনি বসালেন। বলতে গেলে অনেকটা সামনেই ছিলাম। সেখান থেকেই আমি শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সেই কাব্যিক ভাষণ।

সেই সাংবাদিক একটা রেডিও বোধহয় মঞ্চে রেখে এসেছিল রেকর্ড করার জন্য। খাতা ছিল আমার কাছে। সে শুধু বলল, তুমি শুধু অনুবাদটা করো আমার জন্য। দুই মিনিট শোনার পর বলল, তুমি শুধু ‘কি ওয়ার্ড’ লিখে রাখো। তো আমি শুধু ওই কি ওয়ার্ডগুলো লিখে রেখেছি। প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনেছি। কিন্তু আমার শুধু মনে হচ্ছিল এ রকম ভাষণ! আমি সারা পৃথিবীতে শুনিনি। আসলে ওই সময়টায় একটা জাদু ছিল বাতাসে। আমরা যা চাচ্ছিলাম তাই তিনি বলেছিলেন। শুধু তাই নয় আমরা যা আশা করছিলাম আর প্রতিফলন ছিল সেই ভাষণে। আমরা পরে বুঝেছি, কেন তিনি সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি। এতো বড় দায়িত্ব নিয়ে এতো বড় বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন। যা হোক, তারপর আবার যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে এলেন। ওইদিনও আমি ঢাকাতেই ছিলাম। কিন্তু একটু দেরি করে যাওয়ার ফলে পুরো বক্তৃতা শুনতে পারি নি। তবে যেটুকু শুনেছিলাম তাতে মনে হয়েছে, তা ৭ই মার্চের ভাষণ এর ধারে কাছে আসতে পারে। এটি মূলত তাঁর একটি দিক নির্দেশনামূলক বতৃক্তা ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। আর উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা তো আলাদা জিনিস। তারপর বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর দালানের উপর। আবার, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন আলোচনা চলছে তখন আমরা শেরাটন হোটেলের আশেপাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। কারণ তিনি মূলত এই রাস্তা ধরেই চলাফেরা করতেন। এটা আমি ’৭২, ’৭৩ কিংবা ’৭০ সালের আগেও দেখতাম। বঙ্গবন্ধু যখন জননেতা ছিলেন, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো পদে বহাল ছিলেন না তখনই তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়াটা সহজ ছিল। তাঁর ৩২ নম্বর বাসার সামনে গেলে এবং ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলে তাঁকে দেখতে পাওয়া যেতো। কারণ তিনি বাসায় থাকলে বারান্দায় আসতেন অথবা যখন তিনি বের হতেন তখন মানুষের মাথায় হাত দিতেন। এক কথায় ভয়ানকভাবে মানুষকে ভালোবাসতেন। আর তাঁর চেহারার মধ্যেই একটা অন্য রকমের আকর্ষণ ছিল। অনেকের নাম মনে রাখতেন। আমার খুব কষ্ট লাগে যে আমার সমবয়সী অনেকের নাম বঙ্গবন্ধু জানতেন। কিন্তু আমি তো কখনো সামনে যাইনি তাই হয়তো আমার নাম তাঁর জানা হয়নি। সেই অর্থে বঙ্গবন্ধুকে সামনে থেকে কথাবার্তা বলার সুযোগ আমার হয়নি। অনেকের সঙ্গেই গিয়েছি তাদের সঙ্গে কথা হয়ে কিন্তু আমার সঙ্গে হয়নি।

আবার আমার কিছু ছাত্রনেতা আছে যাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে কিন্তু আমার সঙ্গে হয়নি। সুতরাং এরা যখন লিখেন, আমারই সঙ্গেরই কেউ কেউ তখন আমার খুবই মন খারাপ হয়। এবং মনে মনে আক্ষেপ করে বলি, ‘বঙ্গবন্ধু’র একটা ইন্টারভিউ তো নিতে পারতাম! কে জানতো যে তিনি চলেন যাবেন? আর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর দায়িত্ব বেড়ে গেল এবং নিরাপত্তাও বেড়ে গেল। সুতরাং আগের মতো সহজেই তাঁকে পাওয়া বা দেখা যেতো না। বাড়ির সামনে গেলেই পুলিশ সরিয়ে দিতো। আর তখন মানুষের মধ্যে উৎসাহও অনেকটা কমে গিয়েছিল। কারণ স্বাধীন তো হয়েই গেছি আর বঙ্গবন্ধু তো আছেন-ই। আর ১০ই জানুয়ারির পর আর কোনো বক্তৃতা শোনা হয়নি। এর আগে যখন তিনি আগরতলা মামলা থেকে বেরিয়ে আসলেন ’৬৯-এ তখন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। আর দূর থেকে দেখেছিলাম কিন্তু এতো দূর থেকে যে বুঝতে অনেক সময় লাগলো এটা বঙ্গবন্ধু। এতো ভিড় ছিল। আর আমি একটু ভিড়-টিড় এড়িয়ে চলি তো! ঠেলে ঠেলে সামনে যাওয়ার মানুষ আমি না। তো ঠ্যালে ঠ্যালে সামনে যারা গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে এবং তারা যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছে এবং হাত মিলিয়েছে সে কথাও আমি শুনেছি পরে এবং দূর থেকে আমি দেখেছি। এই তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার স্মৃতি। আর বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় জিনিস ছিল তিনি আছেন আমাদের সঙ্গে। এইটা কিন্তু আমাদের জন্য বিশাল একটা পাওয়া বা প্রেরণা। এমনকি ’৭১ সালে তিনি যখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন না, পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, তখনও আমি দেখেছি মুক্তিযোদ্ধরা তাঁর নামে যুদ্ধ করেছেন, আমাদের সবারই মনে হয়েছে আছেন তিনি। এখন হয়তো মানুষ বুঝবে না বঙ্গবন্ধুর কারিশমা জিনিসটা কেমন ছিল? অসম্ভব অনুপ্রেরণাদায়ী একজন মানুষ; যাঁর গলার স্বর থেকে হাতের আঙ্গুল বা হাত উত্তোলনের ভঙ্গি বা কৌশল যা তাঁর নিজস্ব। এসব কিছুই খুবই আকর্ষণীয় ছিল। তার কারণ হচ্ছে, আমরা যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিকে দেখছি, তারা তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী কেউ ছিলেন না। এটা কাউকে বোঝানো কঠিন। এটা ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ। তিনি একেবারে সবার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। এজন্য তাঁর জন্য আমাদের একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো।

এটার বাইরেও তিনি; আসলে আমি মনে করি একজন ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ নেতা ছিলেন, মানুষ ছিলেন। উঁচু, লম্বা এবং সব সময় মাথাটা উঁচু করে থাকতেন। পাইপ খেতেন; এগুলো আমরা দূর থেকে দেখেছি এবং পাইপ হাতে নিয়ে পায়চারি করছেন। যখন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়েছি, তিনবারের মতো গিয়েছি এটা ’৭০-এর শেষের দিকে কিংবা ’৭১-এর মার্চে তিনি হয়তো মানুষের দিকে হাত নেড়েছেন। এবং মানুষ এমনিতেই দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁকে দেখার জন্য। আর সবার আশা ছিল বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে পারলে হয়তো কিছু দিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে। তখন তো এই মোবাইল একেবারেই ছিল না। বলতে গেলে এই রেডিও, টেলিভিশন সবই ছিল পাকিস্তানিদের দখলে। আর পত্র-পত্রিকায় যেগুলো বের হতো, এই ব্রেকিং নিউজ বলতে কিছুই ছিল না। খবরটা জোগাড় করতে হতো। আর আমাদের সুবিধা ছিল হলে থাকার ফলে অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যেত। এবং বঙ্গবন্ধু কোথায় যাচ্ছেন? যখন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তখন আমরা হল থেকে এমনিতেই চলে যেতাম। মনে হয় পনেরো-কুড়ি মিনিট হাঁটলেই চলে যেতে পারতাম। তো সেইজন্য সুযোগগুলো আমরা বাদ দেইনি আরকি। এবং তখন বঙ্গবন্ধু ভিতরে আলোচনা করছেন, আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, মনে হচ্ছে আমরা আছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এই অনুভূতিটা ঠিক বুঝানো মুশকিল। এটা এখন কোনো রাজনৈতিক নেতা সেটা দাবি করতে পারবেন বলে মনে হয় না আমার। এবং কেউ এগুলো এখন করতে পারবেন বলে আমার সন্দেহ হয়।

যা হোক, এই হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার স্মৃতি। দূর থেকে দেখা, বতৃক্তা শোনা, ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে অনুসরণ করা এই বিষয়গুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবং তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে আমার কিছুটা দূরের মানুষ মনে হয়েছে। সেটা সব সময়ই হয়। কারণ একজন মাঠের মানুষ যখন ঘরের মধ্যে (গণভবনে) চলে গেলেন তখন মনে হলো যে এখন তো আর সেই বঙ্গবন্ধুকে পাবো না, কাজেই এখন সরকার পরিচালনা করছেন আর এখন কোনো মাথা ব্যথা নেই। তো তাঁর প্রতি ওই রকম আগ্রহ আর ছিল না। যেটা আগে ছিল। কিন্তু যখন তাঁকে মেরে ফেলা হলো তখন যে শূন্যতা অনুভব করেছিলাম এর কোনো তুলনা নেই। একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো। বিমূঢ় হয়ে যাওয়ার মতো। ওইদিনটা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। যাইহোক, আনন্দ এখানে যে, তাঁকে অস্বীকার করা হচ্ছিল, তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু আমি জানতাম যে, বঙ্গবন্ধুকে সেটা কোনোদিনই সম্ভব নয়। এখন তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে চিনছে, তাঁর আদর্শকে ধারণ করার চেষ্টা করছে এটি আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। আর দ্বিতীয় আরেকটা জিনিস, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বেরিয়েছে এবং কারাগারের ঘটনাগুলো বেরিয়ে আসছে এটা খুবই আনন্দের বিষয়।পুনর্মুদ্রণ

শ্রুতিলিখন : আমিনুল ইসলাম

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা