• মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর করতে পেরে গর্বিত’

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

কারাগারের চার দেয়ালে ৩০ বছর কাটিয়েছেন গোপালগঞ্জের সানোয়ার শেখ। জীবনের সবেচেয়ে মূল্যবান সময় গেছে সেখানে। হারিয়েছেন অনেক প্রিয়জনকে।

শত কষ্টের মাঝেও কারাগারেই তার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের ফাঁসি কার্যকরে জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আর এ দায়িত্ব পালন করতে পেরে তিনি গর্ববোধ করেন।

সানোয়ার শেখের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার চাপ্তা গ্রামে। ১৯৮৯ সালে কাশিয়ানীর সাজাইল গ্রামে মুদি দোকানী আইয়ুব হত্যা মামলায় ৩০ বছর ও অস্ত্র মামলায় ১০ বছর কারাদণ্ড হয় সানোয়ার শেখের। ১৯৯২ সালের ১৩ মে সানোয়ারকে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১০ সালে। তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই ছিলেন সানোয়ার শেখ।

বঙ্গবন্ধুর ঘুনিদের ফাঁসি কার্যকরে ডাক এলে নিজ আগ্রহে জল্লাদের খাতায় নাম লেখান তিনি। কথায় কথায় সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করলেন। বললেন, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটি করেছেন কারাগারে।

সানোয়ার বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকরের কথা যখন বলা হলো তখন নিজেই জল্লাদের খাতায় নাম লেখালাম। সাতজনকে ডেকে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে দুইজন পেশাদার জল্লাদ ছিল। এদের মধ্যে একজন ছিল ফ্রিডম পার্টির, আরেকজন ছিল বিএনপির। তাদের সেখান থেকে বাদ দিয়ে নতুন করে দুইজন নেয়া হয়।’

এরপর আইজি, জেল সুপার, ডিআইজি, আইজি প্রিজনস ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাড়ি কোথায়?’ আমি বলি, ‘গোপালগঞ্জে।’ তখন আইজি বলেন, ‘জল্লাদের কাজ করবে।’ বলি, ‘করবো। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আমাদের ট্রেনিং দেয়া হলো।’’

তিনি বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে জল্লাদের কাজে গেলে সুবিধা পাওয়া যায়। ৩ মাস সাজা কমে। সেখানে আমিসহ চারজন সুবিধার জন্য কাজ করিনি। ইচ্চাকৃতভাবে কাজটি করেছি। কোন সুবিধা নেইনি। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। আর যারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি কার্যকর করে সুবিধা নেব কেন? বরং ফাঁসির  কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে নিজের প্রশান্তি লেগেছে।’ পরে তাদের চারজনের ছয় বছর করে সাজার মেয়াদ কমানো হয় বলে জানান তিনি।

সানোয়ার বলেন, ‘সাংবাদিক নিজামউদ্দিনের মেয়ে শারমিন রীমা হত্যার আসামি মনির হোসেনসহ  আরো মানুষদের ফাঁসি কার্যকরের ডাক এসেছিল। কিন্তু যাইনি। যখন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির কথা শুনলাম তখন যে কোন জায়গা থেকে শক্তি এলো তা বুঝতে পারলাম না।’

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকরের ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে সানোয়ার বলেন, ‘‘পাঁচজনের ফাঁসি যেদিন দেয়, সেদিন মহিউদ্দিন অনেক কান্নাকাটি করেছিল। আমি কিছুই করিনি। আমি আর বাংলাদেশে থাকব না, বিদেশে চলে যাব। আমাকে মাফ করে দাও।’

তখন পাশ থেকে বলেছিলাম, ‘ছোট্ট রাসেলও তার মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তোমরা তাকে যেতে দাওনি। তাকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছো। এখনি তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলনো হবে। তুমি অপরাধী, মৃত্যুর ভয়ে এখন বলতেছো, আমি কিছুই করিনি। আর সেদিন ফারুক গোছলও করেনি, নামাজও পড়েনি। নামাজ পড়ার জন্য তাকে অনেকবার বলা হয়েছিল, তাও পড়েনি।’’

সানোয়ার বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তখন অনেক ছোট, বয়স ৮ কী ৯ হবে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রামদিয়ায় একটা মিটিংএ এসেছিলেন। আমার ছোট চাচা শামসের আমাকে সেখানে নিয়ে যান। ছোট চাচার কাঁধে উঠে তাকে দেখেছিলাম।’

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পাশাপাশি ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদেরও ফাঁসি দিয়েছেন সানোয়ার। জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করেছেন সানোয়ার। মীর কাসেম আলী ও মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের সময় অসুস্থ থাকায় যেতে পারেননি সানোয়ার। এজন্য একটু আক্ষেপ করেন । তবে ওই আটজনের ফাঁসি কার্যকর করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন তিনি।

প্রায় ৩০ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান সানোয়ার। ফিরে যান নিজ এলাকায়।  ৫৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে এখন সাত মাসের একটি পুত্র সন্তান।

তবে যে মামলায় তার সাজা হয়েছে, তিনি সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন। এ সম্পর্কে সানোয়ার বলেন, ‘দলীয় কারণে আমাকে মামলায় ফাঁসানো হয়। আইয়ুব যেদিন খুন হয়, সেদিন আমরা কয়েকজন ওড়াকান্দি মেলায় ছিলাম। আইয়ুব খুন হয় সন্ধ্যায় আর আমরা মেলায় যাই বিকেলে। পরদিন সকালে এসে শুনি আইয়ুব খুন হয়েছে। পরে আমাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। তারপরও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর করতে পারায় শত কষ্টের ভেতরও খুশি সানোয়ার।

এলাকাবাসী জানান, সানোয়ার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির কাজ করতে পেরেছে, এজন্য আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত। এতদিন সে কারাগারে ছিল। এখন সে বেকার। সরকার যদি একটু সুদৃষ্টি দেয় তাহলে বাকী জীবনটা সে সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতে পারবে। 

উল্লেখ্য, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৯৮ সালে বিচারিক আদালত ১৫ আসামির ফাঁসির রায় দেন।

২০১০ সালের সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ ও একেএম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হয়। আর সানোয়ার তখন জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেন।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা