• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

নিসর্গপ্রেমী সাজাহান সরদার

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০১৯  

পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা প্রচলিত আধুনিকতাবোধ, চলমান সভ্যতার ধ্যান-ধারণা বিমুখ। এরা হলেন স্বপ্নলোকের বাসিন্দা। এদের বিষয়ে অবশ্য জগত নির্লিপ্ত, কারণ এদের অনেকটা পাগল এবং অসামাজিক বলেই ধরে নিয়েছে। এরা অবশ্য নিজেরাই মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলেন। সাধারণত পৃথিবীর চিন্তাধারার সঙ্গে এদের চিন্তাধারার পার্থক্যও অনেক। একটু ফাঁক পেলেই এরা দৌড়ায় আপন সাম্রাজ্যে- জঙ্গল-পাহাড় অথবা দূরের কোন নির্জন দ্বীপে। শহরের নিওন আলোর তলায় নাটক, সিনেমা আর নাচ-গানের আসরে এরা যেন বেমানান। এই অদ্ভুত গ্রাম্য ( নিজেকে অর্ধশিক্ষিত মনে করেন)  মানুষদের একজন সাজাহান সরদার।

তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক, গবেষক ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সামাজিক আন্দোলনের নেতা। নৃবিজ্ঞান, সমাজতত্ব, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলায় তার সমান উৎসাহ। তবে তার খ্যাতি আর পরিচিতি নিরলস পাখি গবেষক ও নিসর্গ লেখক হিসেবে। তিনি শুধু নিজেই পাখি চর্চা করেন না, পাখি চর্চা ও সংরক্ষণে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করেন। প্রকৃতি ও পাখি চর্চাকে জনপ্রিয় করে তুলতে  তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নেচার কনজারভেশন কমিটি (এনসিসি) এবং বাংলাদেশ বার্ডওয়াচার্স সোসাইটি। এই সংগঠনগুলো পরিচালনা করে তিনি পাখি, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা অন্যমাত্রায় তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশের বন, জলাবূমি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সামজিক আন্দোলনের তিনি অন্যতম পথিকৃত। শুধু গবেষণা এবং আন্দোলন করে নয়, ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরী করতে তিনি একজন কলম সৈনিক। তার লেখা প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে অনবদ্য অবদান রাখছে। দেশের প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলোতে তার লেখা নিসর্গ ও পরিবেশ বিষয়ক কলাম, ফিচার ও প্রতিবেদন পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তার নিরলস কর্ম প্রচেষ্টা আর একাগ্রতার ফলে সহকর্মী, সতীর্থ, বন্ধু ও ভক্ত মহলে তিনি ‘বিহঙ্গমানব’ রূপে পরিচিত।

প্রকাশবিমুখ এই মানুষটি জীবনকে উপভোগ করেন চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে। নিজের শৈশব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার শৈশব-কৈশরের মধুর দিনগুলো কেটেছে জন্মভূমি প্রিয় বিক্রমপুরের রূপ দেখে। রতনপুর, বৈখর, রনছ, জিয়সতরা, রামপাল, পঞ্চসার, সরদার পাড়া, চাঠাতি পাড়ার ঝোপ-জঙ্গল, খাল-বিল বেড়িয়ে। সেখানেই আমার প্রকৃতি পাঠের হাতেখড়ি।’

তিনি আরো বলেন, ‘শৈশবে স্বরূপকাঠির কাঠের মহাজন হাশেম বেপারীর মুখে বাঘ ও সুন্দরবনের গল্প শুনে আর কৈশোরে জিম করবেটের রচনা পড়ে বাঘ আমাকে পেয়ে বসে। আমি দিবা-নিশি বাঘ খোয়াব দেখি।’

জিম করবেট, শেলেকটন, এন্ডারসন, হিলারি এরা সবাই ছিল তরুণ সাজাহান সরদারের স্বপ্নলোকের রাজপুত্র। তাঁর এভারেস্ট জয়ের স্বপ্নপূরণ না হলেও তিনি হিমালয়ের আঠারো হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত মিরান হিমবাহ পর্যন্ত ট্রেকিং করেছেন। জেলে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের সহস্র মাইলব্যাপী সাগর উপকূল, কালাপানির দেশ আন্দামান, নিকোবর, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দুর্গম অরণ্য, নির্জন সাগর দ্বীপ এবং পশ্চিমে মরুভূমি।

নিসর্গের দুর্বার আকর্ষণে বারবার সীমান্ত অতিক্রম করলেও আবার ঘরে ফিরেন প্রিয় জন্মভূমির টানে। জন্মভূমির প্রতি তিনি নিরঙ্কুশ দায়বদ্ধ। এই ঋণ শোধ দেন দেশের প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীদের কথা বলে। গবেষণা, অভিযান, সংগঠন, আন্দোলন ইত্যাদির মধ্যে থেকেও মননে তিনি শিল্পদ্রষ্টা। তার ‘হারিয়ে যাচ্ছে পাখি ও সবুজের খোঁজে’, ‘অরণ্যের কাব্য’ ইত্যাদি শিরোনামের লিখিত সংবাদপত্র সিরিজগুলো শরীর কাব্য ও গল্পের ঘ্রাণ মাখা। আবার তৃণমূল অধিকার বঞ্চিত মানুষের প্রতিভার অকৃত্রিম দরদ ফুটে উঠেছে ‘নিঝুম দ্বীপের উপাখ্যান’ এবং ‘ভাটির পাখি ভাটির মানুষ’ আখ্যানে। কিন্তু প্রচলিত নৈতিকতা বিবর্জিত রাজনীতিতে তার আস্থা নেই, আস্থা নেই দলবাজ বুদ্ধিবৃত্তিতে।

তারও মান অভিমান আছে আর দশটি মানুষেরই মত। এ কারণে তার অতি প্রিয় এবং সারা জীবনের সাধনার জায়গা পাখি এবং বন্যপ্রাণীর স্বার্থ সংরক্ষনে তার ভূমিকা প্রকাশ্যে আনা থেকে নিজেকে  বিরত রাখেন। তবে তার গবেষণা কিন্তু থেমে ছিল না।  কিছু উদ্যোগী এবং নতুন প্রজন্মের পাখি নিসর্গপ্রেমী তাকে দীর্ঘদিন নিরলস প্রচেষ্টায় আবার ফিরে এনেছেন এ জগতে। একজন সাজাহান সরদার প্রকৃতির আহ্বানে আবার ফিরে এসেছেন এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা