• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

নিরাপদ পারমাণবিক শক্তি কোনও কল্পকাহিনি নয়

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব ৪০০ পিপিএমেরও বেশি। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করবে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ভবিষ্যতে ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার বাড়বে।
বিশ্বের বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে শক্তি উৎপন্ন করে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমাতে হলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। একইসঙ্গে বিকল্প জ্বালানি প্রয়োজন।
সূর্যের আলো ও বায়ুর প্রধান সমস্যা হচ্ছে এগুলো নিরবচ্ছিন্ন শক্তির উৎস নয়। অনেক শহরেই যেমন শীতকালে সূর্যের দেখা মেলাই ভার, তেমনই বছরের বিভিন্ন সময়ে বায়ুপ্রবাহ প্রায় থাকেই না।  সৌর ও বায়ুশক্তি ব্যয়বহুল ব্যাটারি স্টোরেজ ছাড়া আধুনিক শহরগুলোর নিরবচ্ছিন্ন শক্তির চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা কিনতে আগ্রহী নন।
এ কারণে সৌর ও বায়ুশক্তির ওপর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরেও কোনও বড় শহর এই দুটি উৎসের ওপর এককভাবে নির্ভরশীল নয়। সৌর বা বায়ুশক্তিতে বিনিয়োগ করা বেশিরভাগই ব্যাকআপ হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। এ কারণে সৌর ও বায়ুশক্তির পেছনে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করার পরও কার্বন-ডাই অক্সাইডের নির্গমন কমানো যায়নি।

পানিবিদ্যুৎ ‘ক্লিন এনার্জি’র একটি উৎকৃষ্ট উৎস, কিন্তু পানিবিদ্যুতের জন্য বাঁধ নির্মাণ ও বিশাল এলাকা প্লাবিত করা প্রয়োজন, যা ঘনবসতিপূর্ণ দেশের পক্ষে বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পাহাড়ি জনসাধারণকে স্থানচ্যুত করায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়, যা পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়।

প্রকৃতপক্ষে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পারমাণবিক শক্তিকে খুব সহজেই বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে উন্নীত করা যেতে পারে। চেরনোবিল ও ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর বেশিরভাগ মানুষ পারমাণবিক শক্তিকে সহজাতভাবে বিপজ্জনক ধরে নিচ্ছে, যার ফলে এটি এখন বেশ অজনপ্রিয়। ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর জার্মানি ও জাপান অনেক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে।

চেরনোবিল ও ফুকুশিমা পৃথিবীর বেশিরভাগ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো ওয়াটারকুল্ড রিয়েক্টর  ব্যবহার করেছে। উভয় দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল কুল্যান্টের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হওয়া।  এর ফলে রিয়েক্টর কোর অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে কোর মেল্টডাউন হয়।

১৯৫০-এর দিকে ইদাহোতে আরগন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে এক বিশেষ ধরনের রিয়েক্টরের নকশা ও পরীক্ষা করা হয়; ইবিআর-২ (এক্সপেরিমেন্টাল  ব্রিডার রিয়েক্টর-২)। এটি তরল সোডিয়াম দ্বারা ঠান্ডা করা হয়। তরল সোডিয়ামকে কুল্যান্ট হিসেবে ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হলো— এই রিয়েক্টর স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপেই চালানো যায়। অন্যদিকে ওয়াটারকুল্ড রিয়েক্টর উচ্চচাপে চালাতে হয়। এতে পানির অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি উচ্চচাপে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

এ প্রক্রিয়ায় তরল সোডিয়ামকে প্রেসারাইজড করার প্রয়োজন হয় না। রিয়েক্টর ভেসেলকে বেশি চাপ সহ্য করতে হয় না বলে এটি শুধু তাপমাত্রা বাড়লে যে প্রসারণ হয়, তার জন্যই ডিজাইন করা হয়। ইবিআর ২-এর কোর একটি ধাতব রিয়েক্টর ভেসেলের অভ্যন্তরে তরল সোডিয়াম পুলের মধ্যে বসানো থাকে। সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই ডিজাইনের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে আর্গন-এর বিজ্ঞানীরা একটি পরীক্ষা করেন।  তারা ইবিআর-২ রিয়েক্টরকে পূর্ণশক্তিতে রেখে কুল্যান্টের প্রবাহ বন্ধ করে দেন।  এ কারণে যেকোনও ওয়াটারকুল রিয়েক্টরে মেল্টডাউন হতো, কিন্তু ইবিআর ২-এর ডিজাইনের কারণে মেল্টডাউন হওয়া অসম্ভব। কোরের তাপ বৃদ্ধি পেতেই সেই তাপ তরল সোডিয়াম দ্বারা রিয়েক্টর ভেসেলে প্রবাহিত হয়। এর ফলে রিয়েক্টর ভেসেলে তাপীয় প্রসারণ ঘটে। এই তাপীয় প্রসারণ নিউট্রনকে কোর থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে, যার ফলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া বন্ধ এবং কোনও মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কোর ঠান্ডা হয়ে যায়।

এটি এক ধরনের পরোক্ষ সুরক্ষা ব্যবস্থা (যে ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা মানুষের ওপর নির্ভরশীল নয়)।

আইএফআর  (ইন্টিগ্রাল ফাস্ট রিয়েক্টর)-এর ডিজাইনকে যাচাই করার আর্গনে অনেক পরীক্ষা করা হয়েছিল। ইবিআর ২-এর মতো আইএফআর  ছিল একটি সোডিয়াম কুল্ড রিয়েক্টর, কিন্তু আরও উন্নত ডিজাইনের। আইএফআর ডিজাইনের রিয়েক্টরগুলোতে বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হয় না, এতে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকৃত ইউরেনিয়ামকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়— যা এখনকার ওয়াটারকুল্ড রিয়েক্টরগুলোতে সম্ভব নয়। পৃথিবীতে হাজারখানেক টন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রয়েছে, যা আগামী ১০ হাজার বছরের জন্য জমা করে রাখতে হবে।

তথাপি এই বর্জ্য যদি পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে আইএফআর  রিয়েক্টরে ব্যবহার করা যায়, তবে এটি কেবল আগামী কয়েক শতাব্দীর জন্য তেজস্ক্রিয় থাকবে। সেক্ষেত্রে পারমাণবিক চুল্লির পরবর্তী প্রজন্ম তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের ভাণ্ডার কমাবে বৈ বাড়াবে না।

দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্র আইএফআর  প্রযুক্তি ব্যবহার করেনি, তারা পরমাণুবিরোধী আন্দোলনের চাপে পারমাণবিক চুল্লি তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়া বিএন-৬০০ (সূচনাকাল ১৯৮০) এবং বিএন-৮০০ (সূচনাকাল ২০১৫) নামে তরল সোডিয়াম দ্বারা কুলড দুটি পারমাণবিক চুল্লির বাণিজ্যক সূচনা করে। চীন একটি ছোট এবং পরীক্ষাধীন তরল সোডিয়াম কুলড রিয়েক্টর সিইএফআর (সূচনাকাল ২০১২)-এর সূচনা করে এবং স্পষ্টতই বাণিজ্যিক সোডিয়াম কুলড চুল্লি নির্মাণ করতে ইচ্ছুক। রাশিয়া এবং চীন পথ দেখাচ্ছে যে, আগামীতে পারমাণবিক চুল্লি হবে সোডিয়াম কুলড চুল্লি— যা গলে যাবে না এবং ক্রমান্বয়ে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের বিদ্যমান মজুত ব্যবহার করবে।

চেরনোবিল এবং ফুকুশিমা আমাদের বুঝিয়েছে যে, পারমাণবিক শক্তি অনিরাপদ, কিন্তু আসল সত্যিটা হলো— পারমাণবিক চুল্লি জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির চেয়ে নিরাপদ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, আউটডোর বায়ুদূষণে প্রতিবছর ৪২ লাখ মানুষ মারা যায়, যার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য দায়ী হতে পারে। আমাদের গ্রহের বাসযোগ্যতাকে যা অনেকাংশেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। সেক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তি বেশ ভালো বিকল্প।

লেখক: চেয়ারম্যান, টু-এ মিডিয়া লিমিটেড

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা