• মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ধর্ষণ প্রমাণে প্রযুক্তির ব্যবহার, ইসলাম কী বলে

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১৮ অক্টোবর ২০১৯  

অপরাধ প্রমাণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। অপরাধী শনাক্তকরণে আঙুলের ছাপ, অডিও রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ, ডিএনএ টেস্টের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। অনেক মুসলিম দেশের আদালত এসব আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে মামলার রায় দিচ্ছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে শরিয়তের অবস্থান কী? শরিয়তের মূলনীতি হিসেবে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে কি কাউকে অপরাধী বলা যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ইসলামিক স্কলারদের অভিমত হলো, অপরাধ প্রমাণে আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতা নেওয়া বৈধ, তবে এসব প্রযুক্তির ওপর শতভাগ নির্ভর করা বা শুধু প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে কাউকে অপরাধী প্রমাণের সুযোগ নেই। কেননা এসব প্রযুক্তি যত উন্নত ও নিখুঁতই হোক না কেন তা মানুষের হস্তক্ষেপ, অন্যায় ব্যবহার ও বিভ্রাটের সম্ভাবনার ঊর্ধ্বে নয়। মানুষ চাইলেই এসব প্রযুক্তির ফলাফলকে প্রভাবিত, এমনকি পাল্টে দিতে পারে।

শরিয়তে ব্যভিচার প্রমাণের পদ্ধতি
ব্যভিচারের অপরাধ প্রমাণের জন্য ইসলাম দুটি সূক্ষ্ম শর্তারোপ করেছে, যার কোনোটি পাওয়া না গেলে অপরাধ প্রমাণিত হবে না। এক. স্বীকারোক্তি। অপরাধী যখন স্বীকার করবে যে আমি এই অপরাধ করেছি। দুই. প্রমাণ। যখন চারজন ন্যায়পরায়ণ পুরুষ সাক্ষ্য দেবে যে তারা এই কাজ সংঘটিত হতে দেখেছে। মহানবী (সা.) অপরাধীর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাকে শাস্তি দিয়েছেন। তিনি স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই গামেদি গোত্রীয় নারীর বিরুদ্ধে শাস্তির রায় দেন। চারজন সাক্ষীর বিষয়টি কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে কেউ যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তবে তোমরা তার বিরুদ্ধে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করো।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৫)

আধুনিক প্রযুক্তি কি সাক্ষীর বিকল্প হতে পারবে?
মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিকহ বিভাগ থেকে প্রকাশিত এক ফতোয়ায় বলা হয়েছে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক মাধ্যম, যেমন—ডিএনএ টেস্ট, অডিও রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ নিশ্চয়তা প্রদানকারী দলিলের সমকক্ষ বিবেচিত হবে না। কেননা এসব মাধ্যম তথা প্রযুক্তিতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইসলাম মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ ও শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। বিশেষত ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত থাকায় এখানে শিথিলতার কোনো সুযোগ নেই।

এ ছাড়া ইসলামী আইনবিজ্ঞানের (ইলমে ফিকহ) মূলনীতি অনুযায়ী, যেখানে কোনো বিষয়ে কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ বিদ্যমান, সেখানে ইজতেহাদের সুযোগ নেই। কেননা কোন প্রমাণের ওপর বিচারক নির্ভর করবেন এবং কোন দলিল কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা নির্ধারণের অধিকার শুধু শরিয়ত প্রণেতাই সংরক্ষণ করেন। তাঁর প্রণীত বিধানে কোনো পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়। এসব কারণে ধর্ষণের শাস্তি প্রমাণে ডিএনএ টেস্টসহ অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাকে সাক্ষীর বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই।

ইসলামী আইনবিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্যভিচারের অপরাধ প্রমাণ ও শাস্তি প্রদানে অন্য কোনো আইনের অনুকরণ বা ছায়া গ্রহণ করা হয়নি; বরং স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে অপরাধ প্রমাণের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বিচারককে বলে দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে কিছু কিছুু ক্ষেত্রে ইসলামী আইন বিচারককে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ দিয়েছে।

আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এই ফতোয়ায় ড. আবদুল ফাত্তাহ ইদরিস, যিনি ফিকহ বিভাগের প্রধান এবং রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর ফিকহবিষয়ক কমিটির সদস্য, তাঁকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই ব্যভিচার একটি জঘন্য অপরাধ। শরিয়ত তার কঠোরতম শাস্তির কথা বলেছে। কোনো সন্দেহ নেই, ডিএনএ টেস্ট ব্যভিচারের অপরাধ প্রমাণে শক্তিশালী উপায় বা মাধ্যম। তবে শুধু এই মাধ্যম (ডিএনএ) ব্যভিচারের শাস্তি প্রমাণে যথেষ্ট নয়। এ জন্য ধর্ষণকারী বা ধর্ষিতার স্বীকারোক্তি প্রয়োজন হবে। এটি শরয়ি সাক্ষ্যের বিকল্পও হতে পারবে না। ডিএনএ একটি অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ হওয়ায় আইনের দৃষ্টিতে তা দুর্বল। বিশেষত ইসলামী দণ্ডবিধিতে যখন বলেছে, ‘সন্দেহ হদ (শাস্তি) প্রয়োগকে বাধা দেয়।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সন্দেহ হলে তোমরা হদ প্রতিহত করো।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৪২৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) দুর্বল প্রমাণের ভিত্তিতে কারো ওপর হদ প্রয়োগ করেননি। তিনি ব্যভিচারী ব্যক্তির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে হদ প্রয়োগ করেছেন।

ডিএনএ বিভ্রান্তির একটি উদাহরণ
ইসলামী আইনজ্ঞ আলেমরা বলেন, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির নসব বা বংশধারা প্রমাণিত হলো। তার পরও এখানে ব্যভিচার প্রমাণিত না-ও হতে পারে। কেননা নারীর জরায়ুতে পুরুষের বীর্য শারীরিক মিলন ছাড়াও প্রবেশ করতে পারে এবং তার মাধ্যমে নারীর গর্ভধারণও সম্ভব। যেমন—পুরুষের বীর্য লেগে আছে এমন কাপড় নারী পরিধান করলে তা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তার জরায়ুতে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তানের সঙ্গে ব্যক্তির ডিএনএর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। অথচ অভিযুক্ত নারীর সঙ্গে তার শারীরিক কোনো মিলন হয়নি। বর্ণিত অবস্থায় নারী বা পুরুষ কেউ শরিয়তের দৃষ্টিতে অপরাধী নয় এবং তাদের বিরুদ্ধে হদ বা দণ্ডবিধিও প্রয়োগ করা যাবে না। এ জন্য ইসলাম ডিএনএকে অপরাধ প্রমাণে সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করলেও চূড়ান্ত প্রমাণ তথা শরয়ি সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেনি।

অপরাধ প্রমাণে প্রযুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য
আইনজ্ঞ আলেমদের অভিমত হলো, চূড়ান্ত সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ না করলেও অপরাধ প্রমাণে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণ করা যাবে। আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণের ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য হলো, প্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে প্রযুক্তির মধ্যে যেহেতু সাক্ষ্যের সব শর্ত ও গুণাবলি পাওয়া যায় না, তাই শুধু প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করা যাবে না। বরং তা অন্য প্রমাণাদিকে শক্তিশালী করবে এবং শরয়ি দলিলের দুর্বলতা দূর করবে। শুধু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নয়, বরং শরয়ি সাক্ষ্যও কোনো কোনো বিবেচনায় গ্রহণযোগ্যতা হারায়। কখনো তা গ্রহণ করা হয়, আবার কখনো গ্রহণ করা হয় না। আবার বিষয়ের বিবেচনায় সাক্ষী হওয়ার শর্তাবলি শিথিল করা হয়। যেমন—ব্যভিচার প্রমাণের জন্য সাক্ষীর যেসব গুণাবলি ও শর্ত প্রয়োজন, আকাশে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য প্রদানে সেসব গুণ ও শর্ত প্রয়োজন হয় না।

প্রযুক্তির ওপর শতভাগ আস্থা রাখা যায় না
শরিয়ত ডিএনএ, অডিও রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজসহ আধুনিক প্রযুক্তির ওপর শতভাগ নির্ভর করতে নিষেধ করেছে। কেননা তাতে সংশয়, সন্দেহ, বিভ্রাট ও বানোয়াট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নিচে এমন কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলো—

১.       প্রযুক্তি প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে সক্ষম নয়। যেমন—কোনো স্থিরচিত্র বা ভিডিওতে এক মানুষের জায়গায় অন্য মানুষকে, একজনের অঙ্গের স্থানে অন্যজনের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। অথচ ব্যক্তি সেখানে উপস্থিতই ছিলেন না। বিকৃতি, রূপান্তর, পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজনের মতো আস্থা নষ্টকারী অনেক বিষয় এখানে রয়েছে।

২.      আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারের অপরাধ প্রমাণের জন্য চারজন সাক্ষী আবশ্যক করেছেন। কেননা এর সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যু ও সম্ভ্রমের প্রশ্ন জড়িত। সুতরাং এ ক্ষেত্রে এমন কোনো বিষয়কে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, যার দ্বারা ব্যভিচারের চেয়ে ছোট অপরাধই প্রমাণিত হয় না।

৩.      আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা মানুষের অপরাধ প্রমাণের পূর্বশর্ত হলো মানুষেরও গুপ্তচরবৃত্তি করা। অর্থাৎ পূর্ব থেকে প্রযুক্তি সেট করে না রাখলে তার দ্বারা অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আর গুপ্তচরবৃত্তি ও মানুষের একান্ত গোপনীয়তা নষ্ট করা ইসলামে হারাম। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা গুপ্তচরবৃত্তি কোরো না।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)

যেসব ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্ট অপরাধ প্রমাণে যথেষ্ট
শরিয়ত কখনো কখনো ডিএনএকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। তা হলো, যখন অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধ প্রায় প্রমাণিত হয়ে যায়। যেমন—দুজনের একজন অপরাধ স্বীকার করে নেয়। ড. ইদরিস বলেন, ‘ব্যভিচারের অপরাধে অভিযুক্ত দুই পক্ষের এক পক্ষ যখন অপরাধ স্বীকার করে নেয় এবং অন্যজন অস্বীকার করে, তখন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে অস্বীকারকারী অপরাধে যুক্ত কি না তা নিশ্চিত হওয়া এবং তার ভিত্তিতে শাস্তি প্রয়োগ বা রেহাই দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে যখন দুজনই অস্বীকার করবে, তখন ডিএনএ অপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হবে না; বরং চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে।’

রাবেতা আল ইসলামীর ফিকহবিষয়ক কমিটি তাদের সপ্তম অধিবেশনে (২০০২ খ্রি.) সিদ্ধান্ত নেয়, ‘যেসব ক্ষেত্রে অপরাধীর ওপর ইসলামী দণ্ডবিধি (হদ ও কিসাস) প্রয়োগের প্রশ্ন নেই, সেসব ক্ষেত্রে ব্যভিচারের অপরাধ তদন্ত ও তার ওপর নির্ভর করলে কোনো সমস্যা নেই।’

আছে ভিন্নমতও
আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মাজমাউল বুহুসিল ইসলামিয়া’র সদস্য শায়খ মাহমুদ আশুরের মতে, ব্যভিচারের অপরাধ প্রমাণে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করার সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এতটাই উন্নত হয়েছে যে আমরা তার মাধ্যমে নিশ্চিত জ্ঞান ও নির্ভুল ফলাফল বের করতে পারি। সুতরাং ব্যভিচারের অপরাধ প্রমাণে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে কোনো বাধা নেই। বিশেষত আমরা যখন শতভাগ নিশ্চিত যে এসব আধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণের ফলাফল নির্ভুল ও বিশ্বাসযোগ্য, তখন শুধু সন্দেহের কারণে তা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে না। বরং আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এসব ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারি। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের বিরোধ নেই।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা