• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

দেশকে লোভ ও ক্ষমতার আসক্তিমুক্ত করা যাবে কি? আঃ গাফ্ফার চৌধুরী

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৬ ডিসেম্বর ২০১৯  

রোগ, প্রবণতা, আসক্তি ও আকর্ষণের মধ্যে কোনটা বেশি খারাপ? মনস্তাত্ত্বিকরা তা নির্ধারণ করে বলেছেন, আসক্তিটা সবচেয়ে খারাপ। কারণ রোগ হলে ওষুধ প্রয়োগে সারানো যায়। প্রবণতা ও আকর্ষণ থেকেও মানুষ চেষ্টা করলে মুক্ত হতে পারে। কিন্তু আসক্তি বা অ্যাডিকশন থেকে মানুষকে মুক্ত করা কষ্টকর, অনেক সময় অসম্ভব। আসক্তির সঙ্গে থাকে উদগ্র লোভ জড়িত। মদে আসক্তি, টাকার প্রতি আসক্তি, নারী আসক্তি, জুয়ায় আসক্তি অতিরিক্ত হলে মানুষ ধ্বংস হয়। এর হাজারো উদাহরণ আছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রিন্স এন্ড্রুজকে তাঁর নারী আসক্তির দরুন রাজকীয় সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

ক্ষমতার প্রতি আসক্তির জন্য দেশে দেশে এক শ্রেণির সামরিক অফিসার বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেন। পরিণামে তাঁদের বেশির ভাগই ধ্বংস হন। আমাদের দেশে তার উদাহরণ জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ। ক্ষমতার লোভের সঙ্গে অর্থ লোভও জড়িত থাকে। ফিলিপাইনের মার্কেল, চিলির বাতিস্তা, ইরানের শাহ প্রমুখ প্রত্যেক ক্ষমতালোভীকেই দেখা গেছে দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল টাকা ও সম্পত্তির মালিক হতে।

বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছিল ক্লিন জেনারেল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল, তাঁর ছেঁড়া জামা ও ভাঙা স্যুটকেস থেকে অঢেল অর্থ বেরিয়ে তাঁর পুত্রকে হাওয়া ভবনের অধীশ্বর করেছিল। আলাদিনের গুহার অর্থের মতো এই অর্থ ফুরায় না। চিচিং ফাঁক বললেই এই অর্থের গুহামুখ খুলে যায়। সেই অর্থ দিয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিলাসিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিলাতে থাকা যায়। এই উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন খালেদাপুত্র তারেক রহমান।

আর তাঁর কথাই কী বলব, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া ক্যাসিনো, প্লেবয় ক্লাবগুলোতে লাখ লাখ ডলারের বা পাউন্ডের জুয়া খেলতে বেশি আসেন বাংলাদেশের লোক। এটি একটি ক্যাসিনোর রিপোর্ট। এঁরা হলেন—নব্য ব্যবসায়ী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান প্রমুখ শ্রেণির লোক। বাংলাদেশ এখন শেখ হাসিনার কৃপায় আর গরিব দেশ নয়। ব্রিটিশ কলগার্লদের কাছেও তাই আরব ও আমেরিকান ধনীদের সঙ্গে বাংলাদেশি ধনীদের কদরও এখন কম নয়।

মনের অনেক দুঃখেই এ কথাগুলো লিখছি। দীর্ঘকাল ইউরোপে আছি। তাই চোখের দরজার সঙ্গে মনের দরজাটাও খুলে গেছে। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ক্যাপিটাল ফরমেশন হয় দুর্নীতি, চুরি, লুণ্ঠন, শোষণ, প্রতারণার মাধ্যমে। ক্যাপিটালিস্ট সমাজের ভিত্তি এটাই। বাংলাদেশ সম্পর্কেও এ কথাটা নির্মমভাবে সত্য। বঙ্গবন্ধু যে শোষিতের সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন, তাঁকে দুর্নাম দিয়ে ভেঙে ফেলে যে শোষকের সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে, তার ভয়ানক চেহারাই আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

বন্দুকের ক্ষমতায় যিনি মুখ্যত, এই শোষক সমাজ গঠনের নেতা সেই জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, মানি ইজ নো প্রবলেম—‘টাকা কোনো সমস্যাই নয়।’ টাকা যে কোনো সমস্যা নয় এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংকের দরজা খুলে দিয়েছিলেন অসাধু নব্য ব্যবসায়ীদের জন্য। মূলধন নেই—স্যুটকেসধারী ব্যবসায়ী শ্রেণি তৈরি করা হয়েছিল। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা শোধ দিতে হয় না—এমন বিশাল ঋণখেলাপি শ্রেণি তৈরি করেছিলেন। তাদেরই এখন রাজত্ব চলছে ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্পোন্নয়ন সর্বত্র। তারা বিশালসংখ্যায় সংসদেও ঢুকে রাজনীতিকেও কবজা করেছে।

দেশে প্রকৃত রাজনীতিক, ত্যাগী ও আদর্শবান নেতা আজ খুঁজে পাওয়া ভার। তা আওয়ামী লীগ আর বিএনপি হোক, এমনকি বামপন্থী দলগুলো হোক। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আই উইল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ান।’ আমি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কষ্টকর করে ফেলব। কথাটা ভদ্রলোক রেখেছেন। দেশে আজ প্রকৃত রাজনীতিকদের মাথা তোলা কষ্টকর। দেশ আজ অসাধু ও নকল রাজনীতিকদের দ্বারা ভরে গেছে। সৎ ও নীতিবান রাজনীতিকদের আজ কোথাও ঠাঁই নেই। না আওয়ামী লীগে, না বিএনপিতে। তা না হলে ক্যাসিনো অভিযানে প্রথমেই জাতির মেরুদণ্ড যুবসমাজের সংগঠন যুবলীগের শীর্ষ নেতারা ধরা পড়েন! জিয়াউর রহমান ও এরশাদ জাতির এই মেরুদণ্ডটি ভেঙে দিয়ে গেছেন। হাসিনা আর কত শুদ্ধি অভিযান চালাবেন? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।

মনের আবেগে এত কথা লিখে ফেললাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি হচ্ছে একটা ভয়ংকর সাপ। বারবার খোলস বদলায়, কিন্তু মরে না।’ বঙ্গবন্ধুর এ কথাটা যে কত সঠিক, তার প্রমাণ পাই আজ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদি শাসনের পর দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীই বেশি ধরা পড়েছে দেখে। অথচ দুর্নীতির অবাধ বিস্তার ঘটেছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে। এটা থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, ধূর্ত শিয়াল দই খেয়ে গেছে বোকা ছাগলের দাড়িতে হাত মুছে। শেখ হাসিনার এই দাড়ি সাফ করতেই বহুদিন লাগবে।

বাংলাদেশের নব্য ধনীদের উদগ্র অর্থ ও ক্ষমতার আসক্তি সম্পর্কে এ লেখাটির মূল কারণ। গত শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘টাকা বানানো একটা রোগ বা অসুস্থতা। এ রোগে একবার আক্রান্ত হলে শুধু টাকা বানাতেই ইচ্ছা করে।’ তিনি তাঁর দলের নেতাকর্মীদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে সত্ভাবে জীবনযাপন ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী সময়মতো সঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু সমাজদেহে যে কঠিন যক্ষ্মা বাসা বেঁধেছে, তার গুরুত্ব একটু কমিয়ে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে জানাই, এটা রোগ নয়, দারুণ আসক্তি। মনে বাসা বাঁধলে দূর করা খুবই কষ্টকর। ক্যান্সারের মতো রোগও আজকাল সারে; কিন্তু এই আসক্তি সারতে চায় না। এ জন্য দেখা যায়, ড্রাগস আসক্তিতে প্রতিবছর অসংখ্য লোক মারা যায়। অর্থ ও ক্ষমতার আসক্তি ড্রাগ অ্যাডিকশনের চেয়েও ভয়ানক।

এই ভয়ানক অর্থের ও ক্ষমতার লোভ বিশ্বময় ছড়িয়েছে ক্যাপিটালিজম। ক্যাপিটালিজমের গোড়ার দিকে এই আসক্তিটা এত ভয়ানক ছিল না। মানবতার একটা মুখোশ ছিল। ভিক্টোরিয়ান ক্যাপিটালিজম চাইল্ড লেবার, নারী নির্যাতন ও দাস ব্যবসায়ের জন্য কুখ্যাত ছিল; কিন্তু বর্তমান গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের মতো এত নিষ্ঠুর, মনুষ্যত্ববোধহীন ছিল না।

ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার এবং আমেরিকায় রিগানের শাসনামলে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর যে রিগানোমিকস থেকে বাজার অর্থনীতি ও গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের শুরু, তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরাই বলেন, এই তথাকথিত বিশ্বায়ন মানুষের সমাজে সহজাত সব মানবিক গুণ ধ্বংস করে যে উদগ্র লোভ ও ক্ষমতার আসক্তি সৃষ্টি করে গেছে, তা উন্নত-অনুন্নত সব দেশকে গ্রাস করেছে। বেশির ভাগ দেশের মানুষই আজ পাগলের মতো অর্থবিত্তের পেছনে ছুটছে। মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, ভাই-বোনের প্রতি ভালোবাসা, বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বস্ততা—সব কিছু উবে গেছে। বাংলাদেশও এই সর্বনাশা আসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। তার রাজনীতিও নয়। বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগও নয়। তাই এক আধুনিক কবি লিখেছেন—‘পৃথিবীতে সবই পণ্য/প্রেমপ্রীতি আর ভালোবাসা।’

কথাটি রেটোরিক বা আপ্তবাক্যের মতো শোনাবে। তবু বলতে হয়, বাংলাদেশকে এই ভয়ানক লোভ ও ক্ষমতার—এককথায় দুর্নীতির গ্রাস থেকে বাঁচাতে হলে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার আদর্শের দিকে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু চারদিকে উদ্যত থাবা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের বেষ্টনীর মাঝে বাস করে হাসিনা একা একটি ছোট দেশে তা কি সম্ভব করতে পারবেন? কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে শক্তিশালী দেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিদেশি দানব ক্যাপিটালিজমের সহযোগে তাকে আঘাত হানবে। যেমন আঘাত হেনেছিল বঙ্গবন্ধুকে।

অবশ্য ১৯৭৫ সালের এই আঘাত হানার পরিস্থিতি এখন নেই। তবু শেখ হাসিনাকে বর্তমান শুদ্ধি অভিযান চালনাকালে সতর্ক থাকতে হবে। সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি জোরদার করতে হবে। তিনি তাই মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের নেতাদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে সত্ভাবে জীবনযাপন এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এই আহ্বানে আওয়ামী লীগের নিষ্ঠ ও আদর্শবান নেতাকর্মীরা সাড়া দেবেন। নব্য আওয়ামী লীগাররা দেবেন কি না সন্দেহ রয়েছে। শুদ্ধি অভিযান ব্যর্থ করার চেষ্টা তাঁরাই চালাতে পারেন।

বর্তমান ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ বা সমাজ সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। ৭০ বছরের কমিউনিস্ট শাসন রাশিয়ায়, ৫০ বছরের কমিউনিস্ট শাসন চীনে দুর্নীতির উচ্ছেদ ঘটাতে পারেনি। তবে তাকে দানবে পরিণত হতে দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গে ৩০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকার পর মার্ক্সবাদী সিপিএম দলে যে দুর্নীতি দেখা দিয়েছিল তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতি অনুসরণ করলে দুর্নীতির শিশু যে অসুরে পরিণত হয়, তার প্রমাণ বর্তমান রাশিয়া, চীন, এমনকি ভিয়েতনামও।

বাংলাদেশও শেখ মুজিবের মিশ্র অর্থনীতির পথ ত্যাগ করে আসার পর যে অর্থনীতির পথ অনুসরণ করছে, তা পুঁজিবাদের পচনশীল অংশের নীতি অনুসরণ। এই আর্থিক সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতির ষোলো আনা উচ্ছেদ অসম্ভব। বর্তমান শুদ্ধি অভিযানকে এক জায়গায় গিয়ে থামতেই হবে। সেটা হাসিনা সরকারের ব্যর্থতা হবে না। হবে সাফল্যই। বর্তমান দুর্নীতির পাহাড়কে তিনি যদি আয়তনে ছোট করেও আনতে পারেন, সেটাই হবে তাঁর সরকারের বড় সাফল্য।

ব্রিটিশ লেবার পার্টির এককালের নেতা নিল কিনোক (শেখ হাসিনাকে শান্তিপদক প্রদানকারী) একবার বলেছিলেন, লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে টোরি সরকারগুলোর সৃষ্ট দুর্নীতি ও অপশাসনের সব জঞ্জাল দূর করতে পারবে—এমন প্রতিশ্রুতি দিই না। কিন্তু সিকি ভাগ জঞ্জালও যদি সরাতে পারি এবং সমপরিমাণ জনকল্যাণ করতে পারি, সেটাই হবে লেবার গভর্মেন্টের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে বলা যায়, একা তারা বিশ্বের ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভাঙতে পারবে না। কিন্তু নিজ দেশে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে মিলিটারি ও স্বৈরাচারী শাসনের সৃষ্ট দুর্নীতি ও অপশাসনের যে জঞ্জাল আওয়ামী লীগের দুয়ারে এসে জমেছে, তা থেকে দল ও দেশকে যদি সিকি ভাগও মুক্ত করে থাকে, সেটাই হবে বড় সাফল্য।

বাস্তবে শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের পথে দশ আনা এগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বর্তমান শুদ্ধি অভিযানও সিকি ভাগের বেশি তার দল ও দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবে—এটা আমার বিশ্বাস। আরেক টার্ম ক্ষমতায় এলে তাঁর এই সাফল্য আরো বাড়বে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা