• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ট্রাম্পের অভিশংসন : এরপর কী?

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৩ জানুয়ারি ২০২০  

চূড়ান্তভাবে অভিশংসনের মুখোমুখি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দীর্ঘ সাড়ে ১২ ঘণ্টার তুমুল বিতর্কের পর বাংলাদেশ সময় বুধবার সন্ধ্যায় ট্রাম্পের অভিশংসন বিচার কী কী বিধিমালায় পরিচালিত হবে তার রূপরেখার অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন সিনেট। বিচার না হওয়া অবধি সিনেটে সাক্ষী ও দলিলপত্র জমা দিতে পারবে কিনা এই প্রশ্নে সিদ্ধান্তটি নিতে বিলম্ব হয়। নতুন তথ্যপ্রমাণ হাজিরের চেষ্টায় ডেমোক্রেটদের কয়েকটি প্রস্তাব রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেট খারিজ করে দিয়েছে। ডেমোক্রেটরা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে নথিপত্র জমা দেয়ার জন্য ১১টি সংশোধনী প্রস্তাব করেছিলেন এবং হোয়াইট হাউসের ভারপ্রাপ্ত চিফ অব স্টাফ মিক মুলভানিয়ে এবং প্রাক্তন জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা জন বোল্টনের মতো সাক্ষী রেখেছিলেন। সংশোধনীগুলো প্রায় পুরোটা দলীয়-লাইনে ৫৩-৪৭ ভোটে পরাজিত হয়।

এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভিশংসন বিচারের মুখে পড়লেন এবং কতদিন ধরে এটি চলবে সেটাও অনিশ্চিত। ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদে গত মাসে অভিশংসিত হন ট্রাম্প। নিয়ম অনুয়ায়ী সেটি সিনেটে আসে, যেটি আবার রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এর আগে মাত্র দুবার দুজন প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হয়েছেন। অ্যান্ড্রু জনসন ১৮৬৮ সালে এবং বিল ক্লিনটন ১৯৯৮ সালে। তবে তাদের পদ ছাড়তে হয়নি। সিনেটের বিচার প্রক্রিয়ায় দুজনই খালাস পান। তবে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বিরুদ্ধে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে অভিশংসন প্রস্তাব আনার প্রক্রিয়া চলার সময় তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।

প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বিচার হয়েছিল হোয়াইট হাউসের একজন ইন্টার্নের সঙ্গে ক্লিনটনের ‘জিপার কেলেঙ্কারি’ নিয়ে। কিন্তু যেহেতু তাতে ক্ষমতার অপব্যবহার বা শাসনতন্ত্র লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ ছিল না এবং সিনেটে পাস হয়নি, তাই তা কার্যকর হয়নি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ইমপিচমেন্টের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিম্ন পরিষদে ডেমোক্রেটরা উদ্যোগ নিয়েছিল। ওয়াটারগেট একটা হোটেলের নাম। এই হোটেলে ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে নিক্সনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জর্জ ম্যাকগোভার্ন নির্বাচনী অফিস স্থাপন করেছিলেন।

নিক্সন ষড়যন্ত্র করে ডেমোক্রেট পার্টির সব কৌশল অবগত হওয়ার জন্য তাদের অফিসে গোপনে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি বসিয়ে তথ্য পাচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। নির্বাচনে তিনি জয়ীও হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে পরে মুখ্য অভিযোগ আনা হয়েছিল তথ্য পাচারের। ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার সময় প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। অবশিষ্ট সময় তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। নিক্সন সারাজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছেন। তার নৈতিকতাবোধ ছিল। তথ্য পাচারের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হতো কারণ ডেমোক্রেট প্রার্থীর হাতে প্রচুর তথ্যপ্রমাণ ছিল। সম্ভবত সে কারণেই তিনি ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে পদত্যাগ করেছিলেন।

সাধারণত সিনেটে সভাপতিত্ব করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ইমপিচমেন্টের কার্যক্রম চলাকালে সিনেটে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সভাপতিত্ব করার শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এবারের ইমপিচমেন্ট নিয়ে যে অধিবেশন হচ্ছে তাতে সভাপতিত্ব করছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। শাসনতন্ত্রের ভাষ্যমতে ১০০ জন সিনেটর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ওই ইমপিচমেন্টের শুনানিতে জুরি হিসেবে কাজ করবেন। গত ১৬ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির কাছে এই অভিশংসনের শুনানিতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার কথা বলে ১০০ জন সিনেটর শপথগ্রহণ করেছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। ৪৫ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ট্রাম্পের মতো এত অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি কেউ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। মত পাল্টানো, মিথ্যা কথা বলা প্রায় মজ্জাগত অভ্যাস তার। অভিবাসন নিয়ে দরিদ্র সাদা আমেরিকানদের সন্তুষ্ট করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। আর তার ভাগ্য ভালো যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। গত আড়াইশ বছরের মধ্যে আমেরিকা কখনো কোনো নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেনি। ওবামা ও ক্লিনটন দুজনই দলকে প্রভাবিত করে হিলারির মনোনয়ন ব্যবস্থা করেছিলেন। অথচ বার্নি স্যান্ডার্স মনোনয়ন পেলে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। বার্নি স্যান্ডার্স পাঁচবার সিনেটর নির্বাচিত হয়েছিলেন। হিলারির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল না। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের নামে বহু দুষ্কর্ম করেছেন বলে প্রচারণা রয়েছে।

আমেরিকা বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার। ট্রাম্পের মতো লোক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। কারণ তিনি উগ্র মেজাজের মানুষ। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেন না। এবার ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পর প্রতিনিধি পরিষদ আইন পাস করে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। সোলেইমানিকে হামলা করে হত্যার বিষয়ে ট্রাম্প কংগ্রেসের অনুমোদন নেননি।

প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্প অভিষিক্ত হয়েছেন দুটি অভিযোগের ভিত্তিতে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ দুটি হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কংগ্রেসের কাজে বাধা প্রদান। দুটি অভিযোগই সত্য কিন্তু যদিও বা সিনেটরা প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়েছেন, তারা বলেছেন তারা নিরপেক্ষ থাকবেন কিন্তু কেউই নিরপেক্ষ থাকবেন না। দলীয় ভিত্তিতে ভোট দেবেন। প্রথম দিনেই তার লক্ষণ দেখা গেছে। সে কারণেই ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাস হবে না। কারণ সিনেটে রিপাবলিকান সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ।

আমেরিকার স্থপতিরা পদ্ধতিটি তৈরি করেছিলেন খুবই সুন্দরভাবে। সবাই যদি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকেন তবে আমেরিকার উচ্চপদে আসীন থেকে অন্যায় করা খুবই কঠিন ছিল। সিনেটররা শপথ নিয়েছেন সত্য কিন্তু কাজ করবেন শপথের স্পিরিটে নয়, করবেন দলীয় ভিত্তিতে। যে কারণে ট্রাম্পকে ইমপিচ করা সম্ভব হবে না। দলীয় পদ্ধতিতে ন্যায়-অন্যায় নৈতিকতাবোধ থেকে বিচার করা হয় না, বিচার করা হয় দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

আগামী ৩ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ডেমোক্রেটরা বলছে এই ইমপিচমেন্ট ট্রাম্পের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করবে, যার ফলে ভোটাররা তাকে ভোট দিতে গিয়ে সঙ্কোচের মধ্যে পড়বে। জনজরিপের ফলাফল বলে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের পক্ষে ও বিপক্ষের মতামত ইমপিচমেন্ট সংক্রান্ত গত কয়েক মাসের ঘটনায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বলা যায়, ইমপিচমেন্টের বিতর্ক ওঠার আগে ২০২০ সালের নির্বাচনে যে রকম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সে রকম লড়াই এখনও হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা