• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

জীবন যখন মধ্য গগনে!

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০১৯  

আমার বয়স যে বছর ৫০ বছর হলো, সেই সময় আমি একটা লেখায় হাত দিয়েছিলাম। সেই লেখাটার টাইটেল ছিল ‘অর্ধেক জীবন’। লেখাটা শেষ করতে পারিনি। অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিচ্ছাকৃত ঘটনার প্রেক্ষাপটে হারিয়ে যায় লেখার আবেগ। জি আবেগ। আবেগ ছাড়া কোন লেখা হয় বলে আমি মনে করি না। সেটা যেই লেখাই হোক। আমি আবারো সেই লেখাটা লিখতে চাইছি– আবেগের তাড়নায়। আমি কে, কি আমার পরিচয় বা আমার জীবন কেমন সেটা এখানে মুখ্য না। এমনকি এই লেখা ছাপা হবে কিনা বা আমি ছাপতে দিবো কিনা সেটাও মুখ্য না। মুখ্য হলো, আমি লিখতে চাই। এই মধ্য গগণে আমার দেখা- না দেখা জীবন।

আমার মফঃস্বলের জন্ম– বেড়ে ওঠা– শিক্ষাজীবন থেকে আমার দেশের ও দেশের বাইরের শিক্ষা ও কর্মজীবনের বয়ান লিখে লাভ নাই। তার চেয়ে বরং সেই জীবন সায়াহ্নে কি দেখলাম সেটা বলা যায়।

বাবাবিহীন সংসারে এই সমাজে বেড়ে ওঠা যে কতটা কষ্টের সে বুঝি আমার মা’ই কেবল জানতো বলে মনে করতাম। আজ দেখি এবং বুঝি ‘নষ্ট ও দুষ্ট’ বাবার চেয়ে একক মা’ অনেক শান্তির। অনেক মায়েরই আমার মায়ের চেয়ে কঠিন ও বিশ্রী অভিজ্ঞতা আছে।

মা’কে আমি আজো আমার জীবনের সংবিধান মনে করি। আমার জীবন দর্শন আমার মায়ের দেয়া পরামর্শগুলো। ছেলেবেলায় বুঝিনি, যা আজ বুঝি। আমার মা নিজে একজন জ্ঞানী-গুনী-নামি-দামি  মানুষ হবার পরও কীভাবে এত সহজ-সরল জীবন যাপন করেছেন সেটা আজো অবোধ্য ! দুর্লভ ও নির্লোভ বিদূষী এই নারী আমার জন্মদাত্রী ছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন অসংখ্য মানুষের আলোকবর্তিকা– ভালোবাসার মানুষ।

মা চলে যায় ২০০০ সালে। যাবার আগে আমার সাথে অনেক বছর দেখা হয়নি। কেন হয়নি বা কেন করিনি সেই সব আমার কথা এখানে উল্লেখ করার বিষয় নয়। বরং সামনে যাই।

আমি যতবার আমার আদালতের পোশাক পরি– আয়নার সামনে দাঁড়াই ততবার আয়নার স্বচ্ছ কাচে দেখি আমার মায়ের মুখ। হাসছে। তাঁর এই হাসির কারণ আমি জানি। কারণ আমার এই পোশাকই মা’ আমার পরনে দেখতে চেয়েছিলেন। যতবার আদালতে কোন মামলার শুনানি করতে দাঁড়াই ততবার চোখ বন্ধ করে একবার যে পবিত্র মুখটা দেখি সেটা আমার মায়ের মুখ। আমি জেনে যাই এই মামলায় আমি জিতবই।

জীবনের পথ চলতে যেই হোঁচট খাই, তখনই স্পর্শ পাই আমার মায়ের। আমার সমালোচনায় উন্মত্ত জনগণের বলা কথা আমার কানে কখনো প্রবেশ করেনি। কারণ মা’ই তো আমাকে বলেছিল, সমালোচনা তারই হবে যে আলোচনার বস্তু। মা’ই তো আমাকে বলেছিল , ‘সামনে তাকাও। এগিয়ে যাও। পিছনে ফিরবে না। তাহলে হোঁচট খাবে। পড়ে যাবে। কেউ উঠতে সাহায্য করবে না। তুমি পিছিয়ে যাবে।’

আমি ছুটেছি। থামিনি। কেউ-ই কি আমাকে থামাবার চেষ্টা করেনি? নিকট বা দূরাত্মীয়? বন্ধু বা রক্তীয়?

মানুষের জীবন কখনো থেমে থাকার নয়। জীবন বহতা নদীর মত। সে বয়ে চলবেই। তার মাঝে থাকবে অনেক চড়াই-উতরাই। এই সব কিছু মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়ার মাঝেই জীবন। জীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করলে সেটা কেমন জীবন???

সৌভাগ্য সব সময় আমার হাতের মুঠোয় নিজে হেঁটে এসেছে। যে শিশু জন্মাবার পর পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে অপুষ্ট ছিল– যে কিশোরী যশোরের নিক্সন মার্কেটের জোড়া দেয়া ওড়না পরে স্বপ্ন দেখতো একদিন আলমিরা ভর্তি ওড়না হবে– যে তরুণী কাজ করতে গিয়ে মাঝ রাতে টাঙ্গাইলের বাস স্ট্যান্ডে নেমে কখন ভোর হবে এই অপেক্ষায় থাকে সেই মেয়েটি যখন প্রথম শোনে তার একটা নিজস্ব ঠিকানা হয়েছে তাহলে তার যদি আবেগ চোখ ভিজে আসে সেটা কি খুব বেশি দোষের ???

আমার মায়ের বাবার বাড়ি ছিল। শ্বশুর বাড়ি ছিল। স্বামীর বাড়ি ছিল। ছেলের বাড়ি ছিল। কিন্তু মায়ের কোন বাড়ি ছিল কি ???

জন্মের পর থেকে হাসিখুশি এই নারীকে দেখে কেউ বোঝেইনি ভিতরে তাঁর খরস্রোতা নদীর মত কান্নার ধারা বয়ে যাচ্ছে। এক হাতেই তিনি সংসার-সন্তান-তাঁর পেশা-সামাজিক কাজ– রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সাংস্কৃতিক কাজ সব সামলেছেন। যশোর শহরে সুপরিচিত নারী ছিলেন তিনি।

তাঁর কি কোন ঠিকানা ছিল? বাবার বাড়ির কিছুই পাননি। শ্বশুর বা স্বামীর বাড়ির কিছু পাবার সম্ভাবনা আদৌ কোন মেয়েদের থাকে কি ??? ছেলে ? সে তো জন্মেছেই অন্যের মেয়ের জন্য এটাই তো নিয়ম।

তবে পেলো কি সেই মেয়েটি– যে কিনা বাবা মায়ের স্বদিচ্ছায় এই পৃথিবীতে এসেছিল ‘হাসি’ হয়ে???

ঠিকানাবিহীন অবস্থায় চলে গেল সেই মেয়েটি তাঁর নিজস্ব ঠিকানায়। যাবার আগে জেনেও গেলো না তার নামে গড়ে উঠেছে “হাসি আশ্রায়ন”। দেহত্যাগের পর আর কি সত্যিই কোন ঠিকানার প্রয়োজন হয়???

ইহজগতে ঠিকানার কতই না প্রয়োজন। স্কুলে-কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে– কর্মক্ষেত্রে  বা বিয়ে শাদির সময় কতই না প্রয়োজন ঠিকানার !!!

প্রয়োজন বাবা’র পরিচয়। প্রয়োজন গোষ্ঠীর পরিচয়। এই রকম আরো কত কি।

কিন্তু শেষ অব্দি??? ঠিকানা কোথায়? বাড়ি কই এই কথা কি আর কেউ জিজ্ঞাসা করার থাকে???

তারপরও নিশ্চিত হোক মেয়েদের ঠিকানা– প্রতিষ্ঠিত হোক মানুষের অধিকার-অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হোক ‘পিতার সম্পত্তিতে কন্যা শিশুর অধিকার’। পিতার মত ভালো আর কে বাসতে পারে ‘কন্যা সন্তান’ কে???  

কি বিচিত্র মানুষের জীবন- ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতেই শতাব্দীর কাছাকাছি সময় পার হয়ে যায় !!!

লেখক: দিলরুবা শরমিন, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা