• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

জান্নাতের সুন্দর দৃশ্যাবলী পর্ব-২

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৫ জুন ২০২০  

আল্লাহ তায়ালার কাছে হজরত মুসা (আ.) জানতে চান- যে সর্বোচ্চ স্তরের জান্নাত লাভ করবে তার অবস্থা কি হবে? উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুসা! যে আমার প্রিয় বান্দা হবে, তার পুরস্কারের জিনিসগুলো আমি নিজ হাতে তৈরি করে তার ভাণ্ডারে মোহর মেরে সংরক্ষিত করে রেখেছি। তাতে এমন জিনিসও আছে,

وَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ, " إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ قَالَ, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لَا عَيْنٌ رَأَتْ، وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ

যা আজ পর্যন্ত কোনো চোখ দেখেনি। কোনো কান যার আলোচনা শোনেনি। কোনো মানুষের দিলে আজ পর্যন্ত যার কল্পনাও জাগেনি। (সহিহ মুসলিম, তিরমিজি শরিফ)।

পুরা পৃথিবীর সমান জান্নাত:

যে সবার শেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে, সে হাদিসে বর্ণিত এই ব্যক্তি। চিন্তা করুন, সবার শেষে যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, সে পৃথিবীর সমান জান্নাত লাভ করবে। সে ক্ষেত্রে উপরের স্তরের জান্নাতিদের অবস্থা কী হবে এবং তাদেরকে কত বড় জান্নাত দেয়া হবে, আমরা যেহেতু চার দেয়ালের মধ্যে বাস করি। তাই আমরা আশ্চর্য হই, এক ব্যক্তি পৃথিবী সমান জান্নাত কীভাবে লাভ করবে? আর যদি লাভ করেও তা হলে এত বড় জান্নাত দিয়ে করবেটা কি?

পরকালের উদাহরণ:

মায়ের গর্ভে বাচ্চা যেরূপ, পারলৌকিক জগতের তুলনায় আমাদের উদাহরণ সেরূপ। গর্ভস্থিত বাচ্চার গায়ে যেরূপ দুনিয়ার আলো-বাতাস লাগে না। তাই বাচ্চা দুনিয়ার ব্যাপ্তি অনুমান করতে পারে না। বাচ্চা মায়ের পেটকেই সবকিছু মনে করে। কিন্তু সে যখন দুনিয়ায় আসে তখন সে বোঝতে পারে, মাতৃগর্ভ এ দুনিয়ার তুলনায় কিছুই না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তার সন্তুষ্টির সঙ্গে যখন পারলৌকিক জগত দেখাবেন তখন বুঝতে পারব, পারলৌকিক জগত কী জিনিস এবং তা কত বড় ও প্রশস্ত। সেই জগত মুমিনদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।

এই জান্নাত তোমার জন্য:

হজরত ডা. আবদুল হাই (রহ.) বলতেন, আলহামদুলিল্লাহ! জান্নাত মুমিনদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। যদি তোমরা আল্লাহর ওপর ইমান রাখ, বিশ্বাস কর তা তোমাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছার জন্য এবং তার পথের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য কিছু কাজ করতে হয়। কাজগুলো করে নাও। ইনশাআল্লাহ! জান্নাত তোমাদের জন্যই। তোমাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে জান্নাত। আল্লাহ তায়ালা তার দয়া ও অনুগ্রহে আমাদের সবাইকে জান্নাত দান করুন। আমিন।

হজরত আবু হুরায়রা (রাদি.) ও তার আখেরাতের ধ্যান:

এক রেওয়ায়েতে আছে, হজরত সায়িদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.) অনেক উঁচু স্তরের তাবেয়ি ছিলেন এবং অনেক বড় আল্লাহর অলি ছিলেন। তিনি হজরত আবু হুরায়রা (রাদি.) এর ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেন, একবার আমি আর আমার উসতাদ হজরত আবু হুরায়রা (রাদি.) এর সঙ্গে জুমার দিন বাজারে গেলাম। তার কোনো কিছু কেনার ছিল। তিনি তা কিনলেন। যখন বাজার থেকে ফিরছিলেন, তিনি আমাকে বলেন, সায়িদ, আমি দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা আমাকে ও তোমাকে জান্নাতের বাজারে একত্র করুন।

হজরত সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা দেখুন, প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে, আখেরাতের কোনো না কোনো কথা সামনে এনে জান্নাতের স্মরণকে তাজা রাখতেন। যাতে দুনিয়াবি ব্যস্ততা মানুষকে এতটা ব্যস্ত করে না ফেলে, যাতে মানুষ আখেরাতকে ভুলে যায়। তাই দুনিয়াবি কাজ করছেন। বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করছেন। তখনো ছাত্রের সামনে এই দোয়া করছেন।

জান্নাতের ভেতরে বাজার:

হজরত সায়িদ ইবনুল মুসায়্যিব (রহ.) বলেন, আমি হজরত আবু হোরায়রা (রাদি.)- কে জিজ্ঞাসা করলাম, জান্নাতেও কি বাজার হবে? আমরা তো শুনেছি জান্নাতের সব জিনিস ফ্রি পাওয়া যাবে অথচ বাজারে লেনদেন হয়। উত্তরে হজরত আবু হুরায়রা (রাদি.) বলেন, হ্যাঁ! সেখানেও বাজার থাকবে। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, জান্নাতে প্রতি শুক্রবার জান্নাতবাসীদের জন্য বাজার বসবে। এর ব্যাখ্যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন জান্নাতবাসীরা জান্নাতে যাবে এবং সবাই নিজ নিজ ঠিকানায় পৌঁছবে, খুব আরাম-আয়েশে সময় অতিবাহিত করবে সেখানে তাদেরকে এত নেয়ামত দেয়া হবে যে, সেখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তাও করবে না। হঠাৎ ঘোষণা হবে, সব জান্নাতবাসীকে আহ্বান করা হচ্ছে যে, তারা নিজ নিজ আবাস থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকে যাবে। তখন জান্নাতিরা নিজ নিজ আবাস থেকে বের হবে এবং বাজারের দিকে যাবে। সেখানে গিয়ে এমন একটি বাজার দেখবে যাতে এমনসব আশ্চর্য জিনিস দৃষ্টিগোচর হবে, যা জান্নাতবাসীরা এরপূর্বে কখনো দেখেনি। সেসব জিনিস দ্বারা দোকানগুলো সাজানো থাকবে। তবে ক্রয়-বিক্রয় হবে না। বরং ঘোষণা হবে, জান্নাতবাসী, যার যেটা পছন্দ হয় দোকান থেকে তুলে নাও। জান্নাতবাসীরা তখন বাজারের একদিক থেকে আরেকদিকে দোকানের আশ্চর্য সব জিনিস দেখতে দেখতে হেঁটে যাবে এবং যা পছন্দ হবে, সেটা দোকান থেকে তুলে নেবে। (তারগিব ও তারহিব, ৪/৪৯)।

জান্নাতের ভেতরে আল্লাহ তায়ালার দরবার:

যখন বাজারের কেনাকাটা শেষ হবে তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা হবে, এখন আল্লাহ তায়ালার দরবারে সবার একটি মিলনমেলা হবে এবং বলা হবে, দুনিয়াতে যখন তোমরা ছিলে, জুমার দিন জুমার নামাজের জন্য তোমরা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে এক স্থানে একত্র হতে। আজ জুমার আদলে জান্নাতের এই মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হবে। সব জান্নাতবাসী আল্লাহর দরবারে পৌঁছবে। সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আসন বিছানো থাকবে। কারো আসন হবে মুক্তার। কারো আসন হবে স্বর্ণের। কারো আসন হবে জহরতের। কারো আসন হবে রূপার। এভাবে আসনের স্তর বিন্যাস থাকবে। যে ব্যক্তির মর্যাদা যত উপরে হবে, তার আসন তত শানদার হবে। জান্নাতবাসীরা সবাই আসন গ্রহণ করবে। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার আসনকে সেরা মনে করবে। কারো কোনো আফসোস থাকবে না যে, আহা! আমি যদি অমুক আসন পেতাম। কারণ জান্নাতে দুঃখ-কষ্ট, পরিতাপ ও আফসোসের কোনো স্থান নেই। তাই জান্নাতবাসীদের মাঝে আরো ভালো পাওয়ার আকাক্সক্ষাই থাকবে না। জান্নাতে সবচেয়ে নিম্ন মর্যাদায় যারা থাকবে, তাদের আসনের চারপাশে মেশক ও আম্বরের স্তুপ থাকবে। যখন জান্নাতবাসী নিজ নিজ আসন গ্রহণ করবে তখন আল্লাহ তায়ালার দরবার শুরু হবে। দরবারের প্রারম্ভে হজরত ইসরাফিল (আ.) আল্লাহ তায়ালার পাক কালাম তেলাওয়াত করবেন। তার সুমধুর ধ্বনির সামনে পৃথিবীর সব সুর ও সঙ্গীতকে বেসুরো মনে হবে।

মেশক ও জাফরানের বৃষ্টি:

পাক কালাম শোনানোর পর আকাশ মেঘমালায় ছেয়ে যাবে। মনে হবে এখন বৃষ্টি হবে। লোকেরা সবাই মেঘমালার দিকে তাকিয়ে দেখবে, একটু পর মেঘমালা থেকে দরবারে উপস্থিত সবার ওপর মেশক ও জাফরান ছিটানো হবে। ফলে পুরা দরবার সুগন্ধিতে মৌ মৌ করবে। আর সুগন্ধিও এমন হবে, পূর্বে এর মতো ঘ্রাণ কেউ পায়নি। কল্পনাও করেনি।

এরপর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে একটি বাতাস প্রবাহিত হবে। বাতাসের পরশে প্রতিটি মানুষ এতটা আনন্দিত হবে ও সুখ অনুভব করবে, এর কারণে তাদের রূপ-সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। তাদের চেহারা ও পুরা শরীর পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে উপস্থিত সবাইকে জান্নাতের পানীয় পান করানো হবে। ওই পানীয়ও হবে এমন, পৃথিবীর কোনো পানীয়ের সঙ্গে যার তুলনা করা যায় না।

জান্নাতের সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো আল্লাহর দিদার:

এরপর আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞাসা করবেন, হে জান্নাতবাসীরা! আমি পৃথিবীতে তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, তোমাদের ঈমান ও নেক আমলের বদলায় তোমাদেরকে এই এই পুরস্কার দেব। তোমরা কি সেসব নেয়ামত পেয়েছ? কিছু কি বাকি আছে? জান্নাতবাসী সবাই সমস্বরে বলবেন, হে আল্লাহ! আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি পুরা করেছেন। আমাদের সবার নেক আমলের বদলা আমরা পেয়েছি। সব নেয়ামত আমাদেরকে দান করা হয়েছে। এরপর আমাদের আর কোনো নেয়ামতের আকাক্সক্ষা নেই। আমরা পরিপূর্ণ সুখ ও আরাম লাভ করেছি, সব স্বাদ আমাদের অর্জন হয়েছে। এরপরও কি আর কোনো নেয়ামত বাকি থাকতে পারে? হাদিসে আছে, ওলামারা তখনো কাজে দেবে। লোকেরা ওলামাদের দিকে ফিরে তাদের উদ্দেশ্যে বলবে, আপনারা বলুন, আমরা পাইনি এমন কোনো নেয়ামত এখনো বাকি আছে? ওলামারা বলবেন, হ্যাঁ! একটি নেয়ামত বাকি আছে। সেটা আল্লাহ তায়ালার কাছে চাও। সেটা হলো আল্লাহ তায়ালার দিদার। তখন সব জান্নাতবাসী সমস্বরে আরজ করবে, হে আল্লাহ! একটি বড় নেয়ামত এখনো বাকি আছে। তা হলো আপনার দিদার। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, হ্যাঁ! তোমাদের এই নেয়ামতটি বাকি আছে। এখন তোমাদেরকে সেই নেয়ামত দান করা হবে। এরপর আল্লাহ তায়ালার দিদার নসিব হবে এবং আল্লাহ তায়ালা সব জান্নাতবাসীকে নিজের তাজাল্লি দেখাবেন। আল্লাহ তায়ালার তাজাল্লি দর্শনে জান্নাতবাসীরা উপলব্ধি করবে এর পূর্বে যত নেয়ামত দেয়া হয়েছে, এ নেয়ামতের কাছে সেগুলো সব তুচ্ছ। অতি তুচ্ছ। এরচেয়ে বড় নেয়ামত আর কিছুই হতে পারে না। এরপর দরবার শেষ হবে এবং সব জান্নাতবাসী নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাবে। (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম)।

রূপ-সৌন্দর্য বৃদ্ধি:

জান্নাতবাসীরা যখন নিজ নিজ আবাসে ফিরে আসবে তখন তাদের স্ত্রী ও হুররা তাদেরকে বলবে, ঘটনা কি, আজ যে দেখছি রূপ-সৌন্দর্য অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আজ তো তোমরা অনেক সুন্দর ও রূপবান হয়ে ফিরেছ। উত্তরে জান্নাতবাসীরা স্ত্রীদেরকে বলবে, আমরা তোমাদেরকে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম, তোমাদেরকেও তো তার চেয়ে বহুগুণ সুন্দরী ও রূপবতী দেখাচ্ছে। হাদিস শরিফে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পুরুষ ও রমণীদের এই সৌন্দর্য বৃদ্ধি আল্লাহ তায়ালার প্রবাহিত সেই আনন্দদায়ক বাতাসের কারণে ঘটবে।

যাহোক, উপরিউক্ত আলোচনায় জান্নাতে জুমার দিনে মিলনমেলা এবং আল্লাহ তায়ালার দরবারের একটি দৃশ্য সংক্ষিপ্তভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে নেক বান্দাদেরকে তা দান করবেন। 

চলবে...

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা