• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

চলনবিল জুড়ে চলছে ‘পলো উৎসব’

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০১৯  

চলনবিলসহ পাবনার ভাঙ্গুড়া ও চাটমাহরের বিভিন্ন বিলে এখন চলছে বাউতদের ‘পলো উৎসব।’ গত কয়েকদিন ধরেই সৌখিন মৎস্য শিকারিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে বিলপাড়। এক সময়ের মৎস্যভাণ্ডার খ্যাত চলনবিলে এখন মাছের আকাল থাকলেও বাউতদের (সৌখিন মৎস্য শিকারি) আনন্দের কমতি নেই। ‘চলো পলো নামি’ বলে দলে দলে বাউত নামছে বিভিন্ন বিলে খালে। তাদের পলোতে কমবেশি বাহারি জাতের সব মাছ ধরা পড়ছে। তবে গনহারে মৎস্য নিধনের ফলে মৎস্যভাণ্ডার ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

চলনবিল এলাকার বিলকুড়ালিয়া, খলিশাগাড়ি, বড়বিলা, জিয়লগাড়ি, সানকিভাঙ্গা বিল, গুমানী, চিকনাই নদীতে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে শ’ শ’ বাউত প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামছেন। এ যেন হারিয় যাওয়া উৎসব নতুন করে ফিরে পাওয়া। এলাকায় রীতিমত মাইকিং করে খাল-বিলের পাড়ে ভোর না হতেই বিভিন্ন রকম ‘ধ্বনি’ দিয়ে পলো হাতে বাউতদের নামতে দেখা যাচ্ছে। হাঁটু পানি, কোথাও বা গলা পানিতে মাছ ধরছেন সৌখিন মৎস শিকারিরা। কিছু সৌখিন মানুষ চলনবিলপাড়ে নিকট আত্মীয়ের বাড়ি থাকছেন। সব মিলিয়ে এখন বিল পাড়ে এক ধরনের উৎসবের আমেজ চলছে।

শনিবার (৭ ডিসেম্বর) ভাঙ্গুড়া উপজেলার মন্ডুতোষ ইউনিয়নের রুহুল বিলে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় অনেকটাই পানিশূন্য বিল বুক চিতিয়ে দিয়েছে। মূল বিল, খালে কিছু পানি অবশিষ্ট রয়েছে। এ সময়ই এ এলাকার সৌখিন মানুষেরা যোগ দিয়েছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘পলো উৎসবে।’ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিল অভিমুখে মানুষের ঢল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে এক স্থানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সববয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। এরপর দল বেঁধে বিলের পানিতে নেমে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে ওঠেন তারা।। এ উৎসবে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসছেন। এদের হাতে পলো, চাক পলো, নেট পলো, ঠেলা জাল, বাদাই জাল, লাঠি জালসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম চোখে পড়ে। বিলপাড়ে সমবেত হওয়ার পর একসাথে বিলে নেমে মাছ ধরার আনন্দ উৎসবে মেতে উঠছেন শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ।

মাছ পাওয়া না পাওয়া তাদের কাছে বড় কথা নয়, ব্যতিক্রমী এ উৎসবে যোগ দিয়ে আনন্দ উপভোগই যেন তাদের কাছে মুখ্য। তবে অনেকেই বোয়াল, রুই-কাতলা, শোল মাছ শিকার করে বাড়ি ফিরেছেন আনন্দের সাথে।

এ উৎসবে যোগ দিতে আসা ঈশ্বরদীর পঞ্চান্ন বছর বয়সী ময়েজ উদ্দীন জানান, পলো দিয়ে মাছ ধরা তার দীর্ঘদিনের শখ। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি বছর চলনবিলের রুহুল বিলে চলে আসেন তিনি। তবে আগেকার তুলনায় দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নাটোর জেলা থেকে আগত মৎস শিকারী আবু বক্কার বলেন, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাউতদের সাথে যোগাযোগ রেখেই প্রতি বছর মাছ শিকার করতে আসি। মাছ পাই আর না পাই এটি বড় নয়, বড় হল শখ।

বড়াইগ্রামের আফসার আলী মাছ না পেয়ে হতাশার সুরে বলেন, এখানকার লোকজন আগের রাতে জাল দিয়ে মাছ মেরে নিয়েছে। তাই এখন আর তেমন মাছ নেই এই বিলে।

পাবনা সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের মোজাহার আলী, চাটমোহরের দাঁথিয়া গ্রামের এনামুল হক, বোয়ালমারী গ্রামের আনিসুর রহমান ও বেলাল হোসেনসহ অন্যান্য বাউতরা জানান, হাজার হাজার মানুষ একসাথে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছ সবাই পায় না। একজন পেলে আনন্দ ভাগাভাগি করেন সবাই। কে মাছ পেল আর কে পেলো না তা নিয়ে কোন দুঃখ নেই কারো।

তিনি জানান, প্রতি বছর আনন্দের জন্য, মাছ ধরার জন্য এই সময়টার অপেক্ষায় থাকেন তারা।

ছাইকোলা ডিগ্রিী কলেজের জীববিদ্যার সহকারী অধ্যাপক কাজী মান্নাফ জানান, চলনবিলের মাছধরার এই পলো উৎসব ছোটবেলায় আমি অনেক দেখেছি। এখন অনেকটাই বদলে গেছে। পানিশূন্য বিলে মাছ নেই বললেই চলে। আর প্রায় সব বিলই তো এখন প্রভাবশালী অমৎসজীবীদের দখলে। সেখানে পলো ফেলানো মুশকিল।

এ ব্যাপারে পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুর রউফ জানান, বাউত বা পলো উৎসব গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। দেশের অন্যান্য এলাকায় এ উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এ এলাকায় ঐতিহ্যটি এখনো টিকে আছে। বড় বিল, ডেঙ্গার বিল, খলিশাগাড়ি বিল, রহুল বিল, ডিকশীবিলসহ অন্যান্য বিলে বাউতরা মাছ ধরছে। তবে বাউত উৎসবের ফলে দেশি প্রজাতির ছোট মাছ, শ্যাওলাজাতীয় প্রাকৃতিক মৎস খাদ্য, পানির উপকারী অনুজীব নষ্ট হয়ে যায়। এতে জীববৈচিত্র নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা