• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

খোকা থেকে মেনন: আদর্শ থেকে আদর্শহীনতার রাজনীতি

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৭ নভেম্বর ২০১৯  

সাদেক হোসেন খোকার রাজনীতি সমর্থন করি না। করবোও না। কিন্তু ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা খোকাকে কি স্মরণ করা অপরাধ? তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেখানেও বলেছি বাম-রাজনীতি থেকে উঠে আসা মতিয়া চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হবার পরও তার বিচ্যুতি ভালোবাসি না।

তবে এটা মানি- এই দেশ, এই পতাকা, এই মাটির জন্য লড়াই করেছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। যতদিন আমরা এই মাটিকে ভালোবাসবো যতদিন এইদেশের নাম বাংলাদেশ, যতকাল মুক্তিযুদ্ধ অম্লান- ততোকাল সাদেক হোসেন খোকাকে মনে রাখবে ইতিহাস, ব্যস। আমাদের অতি দলান্ধ আর আবেগপ্রবণ মোশতাকদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেল? যখন তার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছাবে আমি বলে দিতে পারি, জানাজায় মানুষের ঢল নামবে। এটা কি বিএনপি নামের অদৃশ্য দলের প্রতি মানুষের সমর্থন? না তাদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা? না, এর পেছনে আছে মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের প্রতি মানুষের আনুগত্য? সাথে কী আবদ্ধ শ্বাসরুদ্ধ মানুষের আকুতিও আছে? আছে কি অচলায়তন থেকে  আকাশে উঁকি মারার প্রয়াস? এসব নিয়ে এরা মাথা ঘামাবো না।

আমি ঠিক করেছি এই লেখাটা আমি লিখবো রাশেদ খান মেননকে নিয়ে। সপ্তাহ খানেক আগে ঢাকার একটি টিভিতে রাতে আমি তার ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে খোলামেলা কিছু কথা বলেছিলাম। তাতে বরাবরের মতো একদল খোশ, তো আরেক দল নাখোশ। এটাই রাজনীতি, দলে দলে ভাগ হবার নামই তো দলাদলি। প্রশ্ন করি, সাদেক হোসেন খোকাকে যেসব কারণে আমরা নিন্দা করি বা অপছন্দ করি মেনন ভাই কি তা থেকে খুব দূরে? না কি সরকারী দলের সাথে থাকলেই সব মাফ? দল না পাল্টালেও মিত্র পাল্টাতে কি ভুল করেছেন রাশেদ খান মেনন? আজ তিনি চৌদ্দ দলে না থাকলে কোথায় থাকতেন?  মেনন এখন যাদের দলে, যে দলে- যে জোটে থাকায় খোকা নিন্দিত সে দল বা জোটের সাথে মেনন সাহেব ছিলেন না? আজ ঘটনাক্রমে এ জোটে না থাকলে তিনি সে জোটের শরিক দল থাকতেন না-  একথা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন তিনি?

টিভিতে বলছিলাম তার সাম্প্রতিক বয়ান নিয়ে। হঠাৎ করে তিনি বলা শুরু করলেন ভোট হয়নি। আর সে ভোট না হবার যদি একজনও সাক্ষী থাকে তিনি তা হতে রাজি। কি ভয়ংকর কথা! যে জোটের হয়ে তার কথায় ‘বিনাভোটে’ তিনি নির্বাচিত হলেন, যিনি এখনো সাংসদ, যিনি বেতন-ভাতা নেন, যিনি পদত্যাগ করেননি তিনি বলছেন- এমন কথা। আবার মজার ব্যাপার এই রাগ করে বা বয়সের কারণে বেফাঁস কথা বলার পরই হুমকি খেয়ে পাল্টে ফেললেন বক্তব্য। এই জায়গাটাতেই আমার আপত্তি। বুঝলাম আপনি তখন বোঝেননি বা মেনে নিয়েছিলেন। মানলাম মন্ত্রী হবার মূলা ঝুলছিল নাকের ডগায়। যখন তা হলো না আপনি রাগ করে বা অভিমানে সত্য বললেন। কদিন পরই মুখ খোলা এমপি জোটের কাছে মাফ চেয়ে কিভাবে বলেন তিনি এমন কোন কথা বলেননি? এটা একমাত্র রাজনীতিতেই সম্ভব। শেষ কথা নাই আর সবকিছু সম্ভবের নামে এখানে মিথ্যা বা কপটতা ও জায়েজ।

ভদ্রলোকও একসময় বাম রাজনীতির পুরোধা ছিলেন। খাঁটি চৈনিক বাম। তাদের চেয়ারম্যান চীনের চেয়ারম্যান, এমন স্লোগানও শুনেছি। তিনি ভোটে দাঁড়াতেন কিন্তু জিততেন না। প্রয়াত এরশাদ সাহেব কিন্তু মাঝে মাঝে কৌতুক করে জব্বর সব সত্য কথা বলে দিতেন। তিনি একবার সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “কোন মেনন? যিনি আমার দলের বাচ্চা ছেলে অভির কাছে ভোটে হারে?” কথাটা মিথ্যা না । হরনাথ বাইনকে প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে যেবার হারালেন আমরা ধরে নিলাম সত্যিকারের জয়। কিছুদিন পর তিনি যখন গুলিবিদ্ধ, তখন রাতের ঘুম হারাম করে ম্যাগাজিন বের করা হলো। জ্বালাময়ী কবিতা লিখলাম আমরা। হরতাল পালন করলাম। তিনি রাষ্ট্রপতি, ভগ্নিপতি ও বোন-ভাইসহ দেশবাসীর কল্যাণে সেরে উঠলেন। এরপর শুনি ভিন্ন কথা। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম স্বাধীনতা-বিরোধী জামাত শিবির করেছিল এই অপকর্ম। পরে শুনি আরে না! অতি বাম সর্বহারারা নাকি ভাগ বাঁটোয়ারার কারণে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিল! কথাটা মিথ্যা হলেই ভালো ।

যে কথা বলছিলাম, রাশেদ খান মেনন বুদ্ধিমান, ঝানু পলিটিসিয়ান। তিনি কি না বুঝেশুনে এমন কোনও মন্তব্য করেছিলেন? তিনি কি একবারও ভাবেননি এর ফলে কী ঘটবে বা ঘটতে পারে? এর আগেও তাকে নিয়ে লিখে বিপদে পড়তে পড়তে বেঁচে যাই। দৈনিক সংবাদে প্রকাশ সে-ই কলামের ওপর রাগ করে তিনি মামলা ঠুকতে পারেন এমন কথা শুনেছিলাম । পরে কীভাবে যেন মত বদলালেন। বহুবছর পর পর্যটনমন্ত্রী থাকাকালীন যখন সিডনি এলেন তখন আড্ডা দেয়ারও সুযোগ হয়েছিল। নি:সন্দেহে সজ্জন ও অমায়িক মানুষ। কতকাল ধরে রাজনীতি করছেন। তাই তো বলি কিসের আভাস পেয়ে তিনি এমন একটা কটূ কথা ছাড়লেন বাজারে? যে সময় রাজনীতি বন্ধ্যা, মানুষ রাজনীতি বিমুখ, দেশ উন্নয়নের রথে মানুষ নিজেদের ভবিষ্যত সামলাতে ব্যস্ত- তখন কেন এমন কথা? নিশ্চয়ই এর পেছনে কারণ আছে। আপাতত পিছপা হলেও তিনি যেমন জানেন, তেমনি জানেন, যারা তাকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। এটাই হলো আমাদের নিয়তি। সত্য বলার সাহস নাই কারো। আছে ছুরিকাঘাতের অপচেষ্টা। সেদিক থেকে রাশেদ খান মেনন বিশ্বাসঘাতকতা করলেন চৌদ্দ দলের সাথে। একটা বাচ্চাও বলে দিতে পারে মন্ত্রী হলে একথাগুলো তিনি বলতেন না। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বা মনের দু:খ বা রাগ প্রকাশের জন্য বালখিল্য আচরণে এটাই প্রমাণিত, রাজনীতি আজ বড় বেহাল আর করুণ দশায় নিমজ্জিত।

রাশেদ খান মেনন আওয়ামী লীগের মিত্র কি না তার জবাব দেবেন তিনি। তবে আমরা সাধারণ চোখে এটুকু দেখি, রাজনীতির মিত্রতা আসলেই খুব নড়বড়ে। অতীত আর রাজনৈতিক কৌশলে তিনি বা তার দল লীগের মিত্র হতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সম্ভব আর কোন আদর্শ রেখা নাই বলে মিত্রতা বা জোট হয়। এখানেও তাই হয়েছে। মনের কথা বলে ফেলেছেন তিনি। কথায় আছে কথা, তেল, গুলি, থুতু একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত নেয়া যায় না। কিভাবে তিনি তা ফিরিয়ে নেবেন? অথচ এসব বলে নির্বাচন ও পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও উলঙ্গ করে দেয়ার পরও তার কিছু হয় নি। হবেও না।

আবারো খোকার কথায় ফিরে আসি। শুধু কি তার দোষ? শুধু কি তিনিই দল বদলে খারাপ দলে গিয়েছিলেন? বা আদর্শহীনতায় নাম লিখিয়েছিলেন এই দেশে? কত বড় বড় মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলাম। মন্ত্রী, নেতা, আওয়ামী লীগের পিলার বা খুঁটি হবার পরও এ কে খন্দকার শেষ বয়সে অন্ধকার দেখলেন। মুক্তিযুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধে’র চাইতে ‘সামরিক যুদ্ধ’ বলে জিয়াউর রহমানকে ক্রেডিট দিলেন। তার বেলায়? কাদের সিদ্দিকীর মত বেসামরিক বীরোত্তম আজ কোন দিকে? কোন দলে? রাশেদ খান মেননরা সাইড পরিবর্তন করলেও বাম থেকে যান, খোকারা পরিবর্তন করলে রাজাকার! এ এক আশ্চর্য সমীকরণ।

শেখ হাসিনাকে আমি সত্যি স্যালুট জানাই। বঙ্গবন্ধু কন্য কিভাবে যে এতসব বিপদ আর ঝামেলা সাথে নিয়ে দেশ চালান তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এই যেমন মেননের কথা জেনে বলেছিলেন- তার কিছু বলার নাই। বা তিনি এনিয়ে ভাবেন না। এই নির্লিপ্ততাই তাকে বড় করে তুলেছে ক্রমাগত। তাই সেখানে ভরসা। রাজনীতির এই নেতা যার নাম ছোট করলে হয় ‘আর কে মেনন’ তার মত এমন স্ববিরোধীদের ক্যারিশমেটিক চরিত্র আর ক’জন আছেন? ‘আর কে’ এর মতো আর কে হতে পারে বলুন!

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা