• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

খুলবে দুয়ার পর্যটনে

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০  

পদ্মা সেতু খুলে দিয়েছে হাজারো সম্ভাবনার দুয়ার। সেতুটি চালু হলে যেমন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হবে, তেমনই দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।
শিল্প-বাণিজ্য, আবাসন, মৎস্য, কৃষি-অর্থনীতির এসব উপকরণের পাশাপাশি পদ্মা সেতুর কারণে পদ্মার দুই পারে পর্যটন শিল্পেরও বিপ্লব ঘটবে। পদ্মার বুকে যেসব চর জেগেছে সেগুলোকে মালদ্বীপের মতো পরিকল্পিত পর্যটন স্পট বানানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া নদীর ক‚ল ঘেঁষে দুধারেই হোটেল-মোটেল, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।
ফলে এক দিকে যেমন বিকাশ ঘটবে পর্যটন শিল্পের, তেমনই কর্মসংস্থান হবে লাখো বেকার-যুবকের। ইতোমধ্যেই এ সম্ভাবনাকে সামনে রেখে পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা পদ্মার দুই পারে জমি কেনা শুরু করেছেন। তা ছাড়া সরকারি উদ্যোগেও পদ্মাপারে পর্যটন শিল্পের বিকাশে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এক লাফে ডাবল
ডিজিট বা ১০
শতাংশে উন্নীত হবে। আর এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে পদ্মাপারের আগামীর পর্যটন শিল্প। এ খাতের বিনিয়োগে সঞ্চারিত হবে নতুন গতি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মাপারে পর্যটন শিল্পের যে অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেটিকে যথাযতভাবে কাজে লাগাতে হলে এখন থেকেই পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যেতে হবে।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতির জন্য একটি আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেবে আগামীতে। এর ছোঁয়া লাগবে অর্থনীতির সব খাতে। বিশেষ করে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে। তবে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দরকার সঠিক পরিকল্পনা। আমাদের দেশে যেটি দেখা যায়, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনেক সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটনের সম্ভাবনাগুলোর যেন মৃত্যু না ঘটে তার জন্য সরকারের পদক্ষেপ বেশি নিতে হবে। উদ্যোক্তারা যাতে নির্বিঘেœ ও স্বাচ্ছন্দ্যে বিনিয়োগ করতে পারেন তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে সরকারকে।
তিনি বলেন, যেকোনো বিনিয়োগে ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন এলে সেটিকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এ সেতু চালু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে। পদ্মাপারকে কেন্দ্র করে পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। যার কারণে দুই পারে অনেক আধুনিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠবে। সবমিলে ২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি তার পেছনে পদ্মা সেতু এক বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
সরেজমিন পদ্মার দুই পারে ঘুরে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতুর নির্মাণকে ঘিরেই মূল কর্মযজ্ঞ চলছে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া এলাকার বিশাল এলাকাজুড়ে সেতুর স্প্যান তৈরিসহ নানা উপকরণ তৈরির কাজ চলছে বিরামহীনভাবে। শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে বেশি কাজ চলছে রেল সেতুর। মূল সেতুর কাজ চললেও পর্যটনকেন্দ্রিক কাজ যে থেমে আছে তেমনটি নয়।
দুই পারের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদারীপুরের শিবচরে সাংস্কৃতিক বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য মাস কয়েক আগে সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ জায়গা পরিদর্শন করেছেন। এখানে বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য জমির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। তা ছাড়া এ এলাকায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হাইটেক পার্ক ও শিশুপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান স্থানীয় ব্যক্তিরা। তা ছাড়া শিল্পকলা একাডেমির আঞ্চলিক কার্যালয়, মুক্তমঞ্চ, বিশ^মানের অলিম্পিক ভিলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এবং এখানে একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনেরও কথা রয়েছে।
শিবচরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, পদ্মা সেতুকে আমরা এখন আমাদের জীবনের জন্য বড় এক আশীর্বাদ হিসেবে মনে করি। কারণ এ সেতুকে ঘিরে আমাদের এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চ কর্মকর্তারা প্রতিদিনই আমাদের এলাকায় আসেন। তারা ঘুরে ঘুরে দেখেন, কোথায় কী শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাবে। অনেক উদ্যোক্তা ইতোমধ্যেই কয়েকশ বিঘা জমি কিনেছেন। এখানে বড় হোটেল-মোটেল করা হবে, পার্ক করা হবে এবং পর্যটন স্পট করা হবে। ফলে আমাদের এলাকার শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার-যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। বদলে যাবে আমাদের জীবনযাত্রা।
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য জমি হারাতে হয়েছে আমাকে। হারাতে হয়েছে দীর্ঘদিনের বসতভিটাও। তবে অধিগ্রহণকৃত জমির জন্য সরকার অর্থ দিয়েছে। তারপরও এই পদ্মা সেতুকে ঘিরে আমার মনে ভিন্ন এক আবেগ কাজ করে। আমি মনে করি পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবাসহ পদ্মার চরাঞ্চল রূপ নেবে আধুনিক নগরীতে।
ইতোমধ্যেই পদ্মা সেতুর প্রাণী জাদুঘর করা হয়েছে পদ্মা সেতুর দোগাছি সার্ভিস এরিয়ায়। দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে জাদুঘরটি। ৫ হাজার প্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ জাদুঘরে। জাদুঘরে কাচের বোতলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এর মধ্যে রয়েছে বিষধর গোখরাসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ, কুনোব্যাঙ, টিয়া, হুতুমপ্যাঁচা, কাক ও বালিহাঁসসহ কয়েক প্রজাতির পাখি। অচিরেই এটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।
সেতুর উত্তর প্রান্তে লৌহজংয়ে মাওয়া ও এর আশপাশের মানুষের পাশাপাশি সেতুর অদূরের চরাঞ্চলের মানুষজনও আশায় বুক বাঁধছেন। চরবাসী এতদিন ফসল ও শাকসবজির আবাদ করে ভালোই ছিল। এ প্রসঙ্গে ঝাউটিয়া চরের বাসিন্দা জয়নুল আবেদীন বলেন, সেতু থেকে এক দেড় কিলোমিটার দূরত্বের চরকে রক্ষায় বাঁধ দিলে একদিকে চরের বাসিন্দারা যেমন রক্ষা পেত, তেমনই এখানে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
অন্যদিকে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলায় দুই পারের বাসিন্দারা নতুন নগরায়ণ গড়ে তুলছেন। তাদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হচ্ছে। সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পারের বাসিন্দারা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। নগরায়ণের বাতায়নে পদ্মার দুই পারে গড়ে উঠছে নতুন হাটবাজার। নতুন বসতি গড়ে উঠছে দুই পারেই। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়ার বাসিন্দা আহসান হাবিব জানান, পদ্মা সেতু তাদের জীবনে নতুন স্বপ্ন জাগ্রত করেছে। নতুন করে জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখছেন তারা। পদ্মা সেতু নির্মাণে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পটও তৈরি হচ্ছে এ এলাকায়।
পদ্মা সেতুর জাজিরা পয়েন্টে বেশ কয়েক মিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়েছে। এ বেড়িবাঁধে সারি সারি ¯øাব বসানো হয়েছে। এখনও সবকিছুই অগোছালো হলেও আশাপাশের জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন পদ্মা সেতু দেখতে মানুষ আসে জাজিরা পয়েন্টে।
এ এলাকার অটোরিকশাচালক রাজা মিয়া বলেন, কাঁঠালবাড়িয়া ঘাট থেকে অনেক মানুষ পদ্মা সেতুর নিচে বেড়ানোর জন্য এখানে আসেন। আমি সকাল থেকে রাত অবধি এ এলাকায় অটো চালাই। প্রতিদিন শতাধিক যাত্রী আমি নিয়ে আসি এখানে। কারণ আর কোন দিক দিয়ে সেতুর এত কাছে যাওয়া যায় না, আর্মি ক্যাম্প থাকায় সেতুর কাছে অন্য দিকে দিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। এখানে যাওয়া যায় বলে প্রতিদিন অনেক মানুষ বেড়াতে আসেন এখানে। এতে আমাদের আয় বাড়ছে আগের চেয়ে অনেক।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে আমাদের এলাকায় পর্যটক আসা শুরু হয়ে গেছে। আশা করি সামনের দিনগুলোয় আরও পর্যটক বাড়বে।
 

 

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা