• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

কয়েক ভিসিতে লাখো ছি ছি

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২ অক্টোবর ২০১৯  

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোড়ে রাতের আঁধারে পালিয়েছেন ভিসি। তিনি গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভিসি অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। পদত্যাগে দেরি করলে জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকেও অপমানিত হয়ে বিদায় নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। কী দাঁড়াচ্ছে অর্থটা? ঘেরাও, ধাওয়া খাওয়া, আজেবাজে ঘটনায় জড়ানো কী ভিসিদের রূপ-বৈশিষ্ট্যে এসে ঠেকেছে? তা-ও এই ভর্তি মৌসুমে? ভর্তির আগেই কী বার্তা পাচ্ছে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তিপ্রার্থীরা?

ভিসি মানেই আইকন। শিক্ষকদেরও শিক্ষক। শিক্ষাগুরু। পদটা কেবল প্রশাসনিক নয়। বিরল সম্মানের প্রতীক। সবার শ্রদ্ধাস্পদ। কিন্তু, কী হতে যাচ্ছে গত বছর কয়েক ধরে? একের পর এক নানা অনৈতিকতা, কেলেঙ্কারিতে ছি ছি হচ্ছে ভিসিদের নিয়ে। গণমাধ্যমে হাস্যকর ট্রল হচ্ছে তাদের নিয়ে। তা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, গোপালগঞ্জ হয়ে দিনাজপুর পর্যন্ত। তাদের মাঝে সকল সীমা ছাড়িয়ে নতুন মাত্রা যোগ করলেন বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। ভিসি পদটির গৌরব-সৌন্দর্য্যের কোনো তোয়াক্কাই তিনি করেননি। ভাষা, আচরণ, রুচির অচিন্ত্যনীয় কদর্য রূপ দেখিয়ে যেন প্রমাণ করে ছাড়লেন, ভিসি মানে বেলাজ-কলঙ্কিত কিছু।

 একটা সময় উচ্চশিক্ষিত, সজ্জন, প্রশাসনিকভাবে কঠোর অথচ গ্রহণযোগ্য শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেতেন। শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের কাছেও তারা ছিলেন সম্মানিত। মহিমান্বিত। গত কয়েক বছর ধরে ভিন্নচিত্র। সাধারণ নাগরিক তো দূরের কথা, শিক্ষক-ছাত্ররাও সম্মান করতে পারছেন না ভিসিদের। শ্রদ্ধা-সমীহের বদলে আজেবাজে মন্তব্য করেন সরকারের গুণগানে অন্তপ্রাণ দলবাজ ভিসিদের ওপর। 

এর আগে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকেও সরাতে হয়েছে। ঘটনার অনিবার্যতায় আর কোনো উপায় ছিল না সরকারের। কেবল গোপালগঞ্জ বা বরিশালের দু’জন ভিসি নন, কাছাকাছি শান-মানের ভিসি দেশে এখন ভরপুর। সংখ্যায় কমছে কম জনা বিশেক। দেশের মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক সংখ্যকের ভিসি ও তাদের আশপাশের প্রভাবশালী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কারো কারো বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত শুরু হয়েছে গোপালগঞ্জের ভিসি নাসিরউদ্দিনের আগেই। ঘটনার ঘনঘটায় তার তদন্তটি শেষ করতে হয়েছে অন্যদের আগে। তদন্তের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি বাকিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিতে বলে সেটা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়।

ইউজিসি সূত্রের বরাতে জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মু. আবুল কাশেমসহ কয়েক ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ ভয়াবহ পর্যায়ে। এ তালিকায় আরো রয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হারুন অর রশিদ, ঢাকার ইসলামিক আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম. রোস্তম আলী, রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহাম্মদ, জগন্নাথের ড. মিজানুর রহমান। রংপুর বেগম রোকেয়ার ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে নিয়েও গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বিস্তর।

অভিযোগে আক্রান্ত সাবেক ভিসিদের মধ্যে রয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এম ইমামুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম অহিদুজ্জামান। দুর্নীতি, অবৈধভাবে ভর্তি, প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনৈতিক কাণ্ডের অভিযোগ এসব সাবেক-বর্তমানের বিরুদ্ধে। দলীয় আনুগত্যসহ নানা তদ্বিরে নিয়োগ পাওয়া ভিসিদের নিয়ে ছি ছির স্বীকার সরকারও। ভিসি নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয়কে বেশি বিবেচনায় নেওয়ায় তারা সব কিছুকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে বাণিজ্যও এখন ওপেন সিক্রেট।

এছাড়া প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রতিবছর বড় অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ হয়। ভিসিরা সেখানে জড়িয়ে পড়ছেন টার্গেট নিয়ে। নিয়ম-নীতির ধার ধারতে চান না। কয়েকজন তো ক্যাম্পাসে থাকার কথা থাকলেও তা মানছেন না। তাদের অনেকেই রাজধানীতে লিয়াজোঁ অফিস খুলে বিশ্ববিদ্যালয় চালান। ব্যস্ত থাকেন ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে। ভিসি হয়েই যেন তারা কালা হয়ে যান। অন্ধ হয়ে যান। কিছুই শোনেন না, কিছুই দেখেন না। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মিলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে ছাড়েন। জয় বাংলার মধ্যে ‘জয়হিন্দ’ শ্লোগান দিতেও বিবেক বাধে না। এর দায় গিয়ে পড়ে সরকারের ঘাড়ে। অনিবার্যভাবে এর ছাপ পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আজ এক বিশ্ববিদ্যালয়ে, কাল আরেকটিতে তৈরি হচ্ছে সংকট। বাড়ছে অস্থিরতা।

একটা সময় উচ্চশিক্ষিত, সজ্জন, প্রশাসনিকভাবে কঠোর অথচ গ্রহণযোগ্য শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেতেন। শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের কাছেও তারা ছিলেন সম্মানিত। মহিমান্বিত। গত কয়েক বছর ধরে ভিন্নচিত্র। সাধারণ নাগরিক তো দূরের কথা, শিক্ষক-ছাত্ররাও সম্মান করতে পারছেন না ভিসিদের। শ্রদ্ধা-সমীহের বদলে আজেবাজে মন্তব্য করেন সরকারের গুণগানে অন্তপ্রাণ দলবাজ ভিসিদের ওপর।

প্রবীণ শিক্ষাবিদদের মতে, যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় না বসানোর একটা করুণ পরিণতিই ভোগ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর জেরে ছি ছি’র পাত্র হচ্ছেন ভিসিরা। আবার দেশের সামগ্রিক বাস্তবতাও স্বীকার না করে পারা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে নয়। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান। দেশের সার্বিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সঙ্গে শিক্ষার অবক্ষয় জড়িত। শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষাগুরু ভিসিদের মানের অবনমনের জন্য একতরফাভাবে কাউকে দোষারোপ করা যায় না।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা