• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে করণীয়

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০২০  

এ মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কণ্ঠে একটি শব্দ বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, তা হচ্ছে মরণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। ইতোমধ্যে এটি সারা দুনিয়ার ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে অকাল মৃত্যুতে পর্যবসিত করেছে এবং ছয় লক্ষাধিক মানুষ সংক্রমিত। করোনার আতঙ্ক পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ। কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি এ করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার।

নভেল করোনাভাইরাস বলতে ভাইরাসের একটি শ্রেণিকে বোঝায়, যেগুলো স্তন্যপায়ীপ্রাণী এবং পাখিদের আক্রান্ত করে। মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। এ সংক্রমণের লক্ষণ মৃদু হতে পারে, অনেকসময় যা সাধারণ সর্দিকাশির ন্যায় মনে হয় (এছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে, যেমন রাইনোভাইরাস), কিছু ক্ষেত্রে তা অন্যান্য মারাত্মক ভাইরাসের জন্য হয়ে থাকে, যেমন- সার্স, মার্স এবং কোভিড-১৯। অন্যান্য প্রজাতিতে এ লক্ষণের তারতম্য দেখা যায়। যেমন মুরগির মধ্যে এটা ঊর্ধ্ব শ্বাসনালী সংক্রমণ ঘটায়, আবার গরু ও শূকরে এটি ডায়রিয়া সৃষ্টি করে। মানবদেহে সৃষ্ট করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিকারের মত কোনো টিকা বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

করোনাভাইরাস রাইবোভিরিয়া পর্বের নিদুভাইরাস বর্গের করোনাভিরিডি গোত্রের অর্থোকরোনাভিরিন্যা উপ-গোত্রের সদস্য। তারা পজিটিভ সেন্স একক সূত্রবিশিষ্ট আবরণীবদ্ধ বা এনভেলাপড আরএনএ ভাইরাস। তাদের নিউক্লিওক্যাপসিড সর্পিলাকৃতির। এর জিনোমের আকার সাধারণত ২৭ থেকে ৩৪ কিলো বেস-পেয়ার (kilo base-pair) এর মধ্যে হয়ে থাকে যা এ ধরনের আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ। করোনাভাইরাস শব্দটি লাতিন ভাষার করোনা থেকে নেয়া হয়েছে যার অর্থ ‘মুকুট’। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুকুট বা সৌর করোনার মত দেখায়। ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থা গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে। ভাইরাসটি ডাইমরফিজম রুপ প্রকাশ করে। ধারনা করা হয়, প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতিতে পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে এসএআরএস-সিওভি-২’ পাওয়া যায়(যা বর্তমানে সাধারণত নোভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।

করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত ব্যক্তির প্রাথমিক লক্ষণ
*জ্বর
*অবসাদ
*শুষ্ক কাশি
*বমি হওয়া
*শ্বাসকষ্ট
*গলাব্যথা
*অঙ্গ বিকল হওয়া
*মাথাব্যথা
*পেটের সমস্যা
* খাবারের স্বাদ না পাওয়া
* গন্ধহীনতা উপভোগ হওয়া
* কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপরোক্ত সব উপসর্গ দেখা গেলেও জ্বর থাকে না।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে।  চীনের সাথে ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় যাতে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। নিশ্চিতভাবে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে আরো ৬ লক্ষাধিক জন রোগী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং দেড় লক্ষাধিক জনের বেশি লোক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

উহানে দেখা দেওয়া ভাইরাস প্রজাতিটি ‘এসএআরএস-সিওভি’ প্রজাতির সাথে ~৭০% জিনগত মিল পাওয়া যায়। অনেকেই অনুমান করছেন নতুন এ প্রজাতিটি সাপ থেকে এসেছে যদিও অনেক গবেষক এ মতের বিরোধীতা করেন।

যাইহোক নোভেল করোনা কোভিড-১৯ সংক্রমণ সারা পৃথিবীর প্রত্যেক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। বলা যায় পৃথিবীর মানুষ আজ এই মহামারির কারণে মৃত্যুপুরীতে। কে কখন এই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে, তার যেন কোন নির্দিষ্ট ইয়ত্তা নেই। তাই ৮০০ কোটি মানুষ রীতিমতো আতংকে তাদের সময় অতিবাহিত করছে। নোভেল করোনা ছোঁয়াছে ফ্লু হওয়ার কারণে সামাজিক অবস্থান থেকে বিছিন্ন থাকতে হবে।  কমিউনিটি ট্রান্সমিশনে খুব দ্রুত এ ফ্লু সংক্রমিত করে। বলা যায় জ্যামিতিক হারে সংক্রমিত করে। তবে বিশ্বে বিগত সময়ে যে সমস্ত মহামারি হয়েছে, তন্মধ্যে কোয়ারেন্টাইনে থাকা উত্তম পন্থা। কোয়ারেন্টাইন মহামারি রুখে দেয়ার শত শত বছরের পরীক্ষিত পন্থা। যা অবশ্যই বিজ্ঞান সম্মত। তাই কোয়ারেন্টাইন মানতে কেউ পিছপা হবেন না দয়া করে। 

চিকিৎসা পদ্ধতিতে নভেল করোনার সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ/ভ্যাকসিন না থাকলেও ফ্লুর প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারলেও  ৮০ শতাংশ  সুুুুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বর্তমানে আমাদের দেশ ভাইরাসটির সংক্রমণ এর তৃতীয় পর্যায়ে আছে অর্থাৎ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে। এ রোগটির জীবাণু আমাদের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যায়ে যাদের মাঝে কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে তাদেরকে কঠিনভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন মানতে হবে।

সারাদেশে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের কাজ নিশ্চিত করতে হবে এবং এ উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা নিরুৎসাহিত করতে হবে। তারা ঘরে বসে যেন সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে প্রায় সব উপজেলা হাসপাতালে ৬-৮ জন চিকিৎসক আছে। তাদের ২ জনের মোবাইল নাম্বার প্রতিটা ওয়ার্ডের দৃশ্যমান স্থানে রেখে দিতে হবে।  ইউপি সদস্য দ্বারা স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচন করে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা। প্রশাসনের লোক সবসময় সব পাহারা দিতেও পারবে না। যদি এই ভাইরাসের সংক্রমণের কোন রোগী পাওয়া যায় তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসার প্রয়োজন হলে স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়ে আসবে। 
জেলাভিত্তিক ল্যাব তৈরি করা। আর হাসপাতালের ডাক্তার- নার্সদের আবাসিক করে নিতে হবে অন্তত আগামী এক থেকে দেড় মাস। তারা হাসপাতালে থাকবে, খাবে ঘুমাবে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। চীনের উহানে কিন্তু দুই মাস অবস্থান করেছে। নার্স ডাক্তারদের প্রয়োজন অনুযায়ী তিনভাগে ভাগ করতে হবে। একভাগ ইমার্জেন্সি ডিউটি করবে, একভাগ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের রোগীর ডিউটি করবে এবং বাকী অংশ রিজার্ভ থাকবে। পাশাপাশি সকল ধরনের পিপিই ও সমস্ত চিকিৎসা সামগ্রী দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে রাষ্ট্রকে সময় নিলে চলবে না। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত বেকার ডাক্তার ও নার্সদের জরুরিভাবে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করতে হবে। যদি ইউনিয়ন ভিত্তিক ভাইরাস সংক্রামিত রোগীর মৃত্যু ঘটে, সেক্ষেত্রে দাফনকাজ সম্পন্ন করতে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ ও নির্দিষ্ট যানবাহন রাখতে হবে। তাহলেই এই মহামারি সংক্রান্ত প্রশ্নে রাষ্ট্র উত্তীর্ণ হতে পারবে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা