• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

‘একটি আত্মহত্যা পঁচিশজনকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে’

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে ব্রাইটার টুমোরো ফাউন্ডেশন (বিটিএফ)। আর একটি প্রাণও যেন অভিমানে, দুঃখে, হতাশায়, অবহেলায় ঝরে না যায়- এজন্য কাজ করছে সংগঠনটি। পেশায় সাংবাদিক জয়শ্রী জামান বিটিএফ-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। আত্মহত্যা সচেতনে সমাজের কিশোর- কিশোরীদের কথা ভেবে তিনি গড়ে তুলেছেন এই সংগঠন। সংগঠনটির কার্যক্রম নিয়ে ফারজিব সালমান কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে। 

ইটার টুমোরো ফাউন্ডেশনের (বিটিএফ) যাত্রা শুরু কবে থেকে? আত্মহত্যা প্রতিরোধে সংগঠনটি কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে?

জয়শ্রী জামান: ২০১৫ সালের ২৮ মে ব্রাইটার টুমোরো ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করে। আমাদের মূল লক্ষ্য কিশোর-তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে বের করে আনা। দুটি সন্তানকে আমি হারিয়েছি। আমি চাই না কারো সন্তান আত্মহত্যা করুক। গত বছর ‘হতাশা ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাউন্সেলিং’ শীর্ষক এক কর্মশালা আয়োজন করেছিলো ব্রাইটার টুমোরো ফাউন্ডেশন। এছাড়া  দ্য গ্রেট বাংলাদেশ রান (টিজিবিআর)-এর সাথে যৌথভাবে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপরাজেয় বাংলা প্রাঙ্গণ থেকে ‘জীবন বাঁচাতে দৌড়’ শীর্ষক একটি সচেতনতামূলক দৌড়ের  আয়োজন করা হয়। ধানমণ্ডির গ্যালারি চিত্রকে বরেণ্য শিল্পীদের নিয়ে আর্ট ক্যাম্প ও চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনও করা হয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সম্ভবনার মৃত্যু-প্রতিকার কীভাবে’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা আমরা করেছি। এছাড়া রাজধানীর স্কুল, কলেজে নিয়মিত আমাদের উদ্দ্যোগে সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে।

পত্রিকা খুললেই আত্মহত্যার খবর চোখে পড়ে। দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা যত, সে তুলনায় প্রতিরোধের চেষ্টা কেমন বলে মনে করেন?

জয়শ্রী জামান: আত্মহত্যা প্রতিরোধে সেরকম কাজ দেখতে পাই না। আত্মহত্যা প্রতিরোধে ‘কান পেতে রই’ নামে একটি হটলাইন আছে। এরা ভালো কাজ করছে। বর্তমানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে জাতীয় মানসিক হাসপাতাল গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু আত্মহত্যা প্রতিরোধে যতটা গুরুত্ব দেয়া দরকার সেরকমটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

মানুষ কোন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে?

জয়শ্রী জামান: যাঁরা বিষণ্ণতায় ভোগেন, যাঁদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা আছে, যাঁরা মাদকে আসক্ত, যাঁদের জীবনে ঘটে গেছে বড় কোনো দুর্ঘটনা, যাঁরা নিয়ত সামাজিক চাপের মধ্যে রয়েছেন, তাঁরা আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। হতাশা, একাকিত্ব আর গ্লানি মানুষকে আত্মহত্যার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে  প্ররোচিত করে। অকালে হারিয়ে যায় সম্ভাবনাময় অনেক জীবন। মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট যখন প্রবল মাত্রা ধারণ করে তখন মানুষ নিজের জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। মানুষ বেঁচে থাকার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। অনুপ্রেরণা দেয়ার মত যখন কেউ থাকে না, এমন পর্যায়ে মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে।

এখানে বয়স কতটা ভূমিকা রাখে?

জয়শ্রী জামান: বিশ্বে ৭০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই বয়সে গিয়ে মানুষ বেশি একাকীত্ব অনুভব করে। ফলে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। পৃথিবীতে কিশোর-কিশোরী এবং যাদের বয়স ১৪-২৯ বছর তাদের মৃত্যুর ২য় বৃহত্তম কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। এ বয়সের মানুষ আবেগ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়।

ছেলে না কি মেয়ে- আত্মহত্যার প্রবণতা কাদের মধ্যে বেশি?

জয়শ্রী জামান: পৃথিবীতে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ। কিন্তু আমাদের দেশে মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। প্রেমঘটিত বিষয়, পারিবারিক কলহ, যৌতুক, বিবাহবহির্ভূত সন্তান গর্ভধারণ, ইভটিজিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার স্বীকার হওয়া এসব কারণে মেয়েরা বাংলাদেশে বেশি আত্মহত্যা করে।

কারো আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়টি যদি আগাম ধারণা করা যায়, তাহলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত?

জয়শ্রী জামান: আগাম ধারণা পেলে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে আত্মহত্যাবিমুখ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদের স্বাস্থ্য সেবা এবং সামাজিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, বিষ, বিষাক্ত পদার্থ ইত্যাদি দূরে রাখতে হবে। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে।

‘আত্মহত্যা’ শব্দটিও কি মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়?

জয়শ্রী জামান: একটি আত্মহত্যা পঁচিশজনকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে। আত্মহত্যা বিষয়টি ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ছে। কারো কাছের মানুষ আগে আত্মহত্যা করেছে এমন ব্যক্তিকে পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করতে দেখা গেছে। মা-বাবার আত্মহত্যা সন্তানকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেয়।

আত্মহত্যা রোধে পরিবার কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?

জয়শ্রী জামান: মানসিকভাবে অসুস্থতায় শতকরা ৭০ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেন।আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবারকেই এগিয়ে আসা উচিত। পরিবার হচ্ছে একজন ব্যক্তির সবচেয়ে কাছের জায়গা। পরিবারের সদস্য বাবা মা ভাই বোন একে অপরকে সময় দেয়া উচিত৷ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হলে পরিবারের সদস্যদের সব ধরনের সাহায্য করা উচিত। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিটির পাশে তাদের সবসময় থাকতে হবে৷ তার যেন কখনো একাকীত্ব বোধ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারের সবার মধ্যে শেয়ারিং এবং কেয়ারিং-এর সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে আত্মহত্যা প্রবণতা কমানো যায়। পরিবারের মধ্যে সংবেদনশীল একটা পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে।

গণমাধ্যমের কী ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করেন?

জয়শ্রী জামান: প্রতিবেদন পড়ে অন্য কেউ যেন আত্মহত্যায় প্ররোচিত না হয় কিংবা আত্মহত্যার নতুন কোনো পরিকল্পনার পথ খুঁজে না পায় এ বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আত্মহত্যার কৌশল ও মাধ্যম নিয়ে ফলাও করে পত্রিকায় বা টিভিতে সংবাদ প্রচার হলে ওই কৌশলে আত্মহত্যা করার হার বেড়ে যেতে পারে। আত্মহত্যার খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। যখন আত্মহত্যার সংবাদকে পুনরাবৃত্তিমূলক কভারেজ দেয়া হয়, আত্মহত্যার ঘটনাটিকে প্রশংসা করে বা রোমান্টিসাইজ করে তুলে ধরা হয় তখন মানুষের উপর আত্মহত্যার বিবরণটির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আত্মহত্যার সংবাদ মিডিয়ায় কীভাবে প্রকাশিত হবে সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি নীতিমালা রয়েছে, যা মেনে চলা সব প্রচারমাধ্যমের জন্য জরুরি। এছাড়া গণমাধ্যমে আত্মহত্যাবিরোধী প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।

আমাদের দেশে মানসিক সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার চিকিৎসার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন কি না?

জয়শ্রী জামান: আমাদের দেশে পর্যাপ্ত ভালো মানের মানসিক ডাক্তার নেই। আর যারা ভালো মানের ডাক্তার আছেন তারা ব্যয়বহুল। তাদের সেবা পাওয়া সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আর মানসিক সমস্যার সমাধান পাওয়া একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হওয়ায় অনেকের পক্ষে তা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এবং সমাজের বেশিরভাগ মানুষ অন্যান্য অসুস্থতাকে যে গুরুত্ব প্রদান করে সে তুলনায় মানসিক চিকিৎসাকে অতটা গুরুত্ব প্রদান করে না। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে আরো বেশিসংখ্যক মানসিক চিকিৎসক যেমন দরকার তেমনি মানসিক চিকিৎসা সহজলভ্য ও হাতের নাগালে নিয়ে আসা উচিত।

আপনারা দীর্ঘদিন বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন, কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?

জয়শ্রী জামান: আমাদের দেশে আত্মহত্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করার মত পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। ফলে আমরা আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাতে পারছি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভা-সেমিনার করার অনুমতি পেতে এখনো বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়া মানুষ আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান না করায় আমরা স্বেচ্ছাসেবক এবং পৃষ্ঠপোষকতা সে রকম পাই না। যা আমাদের সংগঠনটির কাজের গতি কমিয়ে দেয়।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আরো কী ধরনের উদ্যোগ (যেমন প্রযুক্তিগত কোনো সেবা চালু করা, সরকারি হটলাইন চালু করা) গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?

জয়শ্রী জামান: আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি ২৪/৭ হটলাইন সেবা চালু করা দরকার। সরকার নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব দিয়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে পারে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাজে লাগিয়ে সরকার দেশব্যাপী জনসচেতনতামূলক কাজ করতে পারে। সরকার চাইলে আমাদের মতো যারা আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছে সবাই আমরা একসাথে কাজ করতে পারি।

আজ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটিতে বিটিএফ কী ধরনের কর্মসূচি পালন করবে?

জয়শ্রী জামান: আমাদের এবারের বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘আত্মহত্যা ও অন্যহত্যায় ফারাক নেই’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ব্রাইটার টুমোরো ফাউন্ডেশন তরুণ প্রজন্মের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, এবং দেশের সকল নাগরিকের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে আজ সকাল ৫:৪৫ মিনিটে হাতিরঝিলে সাইক্লিং রাইড-এর আয়োজন করেছে। ‘সাইক্লিং এরাউন্ড ঢাকা’ শীর্ষক ১৫ কিমি দূরত্বের এ আয়োজনটি হাতিরঝিলের এফডিসি প্রান্তের বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে হাতিরঝিল দুই রাউন্ড সম্পন্ন করে আবার বাসস্ট্যান্ড প্রান্তে শেষ হবে। ইউনিভার্সেল মেডিকেল, জয়েন্ট টুগেদার নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এবছর আমাদের অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করছে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা