• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ইতিহাস নির্মাতা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০১৯  

কে এম টিপু সুলতান : বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবে এসে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম; যিনি দেশের স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থের জন্য নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক-অভিন্ন। কবি-মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের আরেক নাম রেখেছেন ‘মুজিব ল্যান্ড’।

এক অর্থে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের ইতিহাস। তার জীবন ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশেষ সময়ের কথা আমরা জানতে পারি।

কিশোর বয়স থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনও দূরে সরে যাননি। ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন- ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, এক পক্ষে শোষক, আরেক পক্ষে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়।

পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তা অবিস্মরণীয়। সেদিন তাঁর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই অমর আহ্বানেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিপীড়িত কোটি বাঙালি। সেই মন্ত্রপূত ঘোষণায় বাঙালি হয়ে উঠেছিল লড়াকু এক বীরের জাতি।

আবার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেই জাতি শুনেছিল মহান স্বাধীনতার অমর ঘোষণা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এরপর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাকে বন্দি থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারে। তার আহ্বানেই চলে মুক্তিযুদ্ধ।

বন্দিদশায় মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় ঝুললেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করেননি অকুতোভয় এ মহান নেতা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। বীরের বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি দেশের মানুষকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করেন বঙ্গবন্ধু।

মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাষী কয়েকজন সদস্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে হামলা চালায় গভীর রাতে, হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে আবারও বাংলাদেশকে এক কালো অধ্যায়ে পৌঁছে দেয় ষড়যন্ত্রকারীরা।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও প্রবাসী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু পরিষদের ইউরোপীয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানানো হয় টমাস উইলিয়ামসকে। তিনি এ দেশের মানুষের কাছে পরিচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী এবং ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথের আইনজীবী হিসেবে। টমাস উইলিয়ামস সানন্দে সে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি টমাস উইলিয়ামস বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে (বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমন্ত্রণ জানান। ওই সাক্ষাতে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যা তদন্তের জন্য টমাস উইলিয়ামসকে একটি কমিশন গঠনের অনুরোধ জানালে তিনি সম্মতি দেন।

৯ সেপ্টেম্বরে কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্য, ২/৩ নভেম্বর চার রাজনৈতিক নেতার হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যর্থতায় বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ অব্যাহত রয়েছে।

শেখ মুজিব ও অন্যান্য নিহত ব্যক্তির পরিবারের আবেদন এবং ব্রিটেন, ইউরোপ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জনসমাবেশ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশের প্রত্যুত্তরে টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপির সভাপতিত্বে এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সভাপতি সন ম্যাকব্রাইড, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব ও নোবেল বিজয়ী জেফ্রি টমাসের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অব্রে রোজ এই কমিটির সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।

এতে আরও জানানো হয়, কমিশনের সদস্যরা শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আইনজীবী অব্রে রোজ ও জেফ্রি টমাস বাংলাদেশ মিশনে ভিসার জন্য আবেদন করলে তা নামঞ্জুর হয়।

এর আগেই তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার টমাস উইলিয়ামসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এরপর তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ দ্বিতীয় দেশ, যে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করল। প্রথম দেশটি হলো জেনারেল আগুস্তো পিনোশের চিলি। ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনও এই কমিশন সদস্যদের আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল যে, তাঁরা যেন ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে না আসেন।

বাংলাদেশে না আসতে পেরে তদন্ত কমিশন ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ লন্ডনেই প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়: ১. আইন ও বিচারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া হয়নি, ২. আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে না দেওয়ার জন্য সরকারই দায়ী এবং ৩. দায়মুক্তির বিধান তুলে নিয়ে বিচারের পথ উন্মুক্ত করতে হবে।

১৯৮০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে হাউস অব কমন্সের কমিটি রুমে আয়োজিত আলোচনা সভায় টমাস উইলিয়ামস যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে ভালোবাসি এবং বিশ্বাস করি যে, শেখ মুজিব আমার বন্ধু ছিলেন। আমি তাঁকে জানতে পেরে এবং তাঁর জন্য ও তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরে গর্বিত। আমার এই কথা ভাবতে ভালো লাগে যে, আমি যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাম, তখন অনেকের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, যাঁরা সবাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার সহযাত্রী ছিলেন এবং বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, সেটি ছিল তার সূচনা পর্ব।’

সে সময়ের কথা স্মরণ করে উইলিয়ামস আরও বলেন, ‘সেই কতকাল আগে, ১৯৬৮ সালে, আমি ঢাকা গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা লড়তে। তারপর এল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তখনো আমি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম। সে তো প্রায় ১০ বছর আগের কথা। শেখ মুজিবের সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয়, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর আরাধ্য কাজ অসমাপ্ত রেখে তিনি মারা যাবেন, তা তিনি বিশ্বাস করেন না।

তাঁর এ বিশ্বাস হয়তো পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি, কিন্তু এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে যত দিন বাংলাদেশ থাকবে এবং যত দিন বাংলাদেশ বিশ্বের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে, তত দিন তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁর দৈহিক মৃত্যু তাঁর নিজ পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক, তাঁর বন্ধুদের জন্য দুঃখজনক কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি বেদনা ও দুঃখের ছিল বাংলাদেশের জন্য, যে বাংলাদেশ তাঁর মৃত্যুতে গভীর দুঃখ-দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়েছিল।’

তাঁর শেষ মন্তব্য ছিল, ‘আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই, কেননা দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও বাংলাদেশ আবার যখন জেগে উঠবে, জাতিসত্তা পূর্ণতা পাবে, তখন তাঁর আত্মা আমাদের মধ্যে ফিরে এসে বলবে, তোমরা যদি আমার স্মৃতিচিহ্ন চাও, তবে তোমাদের চারদিকে তাকাও। আগামী দিনগুলোয় তাঁর স্মৃতি আমাদের মধ্যে জাগরূক হয়ে থাকবে এবং তা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। আমি আশা করি, যে স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তার মৃত্যু নেই।’

বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে ততদিন অমর তিনি। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী বঙ্গবন্ধুর বন্ধু টমাস উইলিয়ামের বাণী আজ চির সত্যে পরিণত হয়েছে, ইতিহাস নির্মাতা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই। 

লেখক:  গবেষক ও সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তর।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা