• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

আমি কেন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৮ আগস্ট ২০১৯  

গল্পটা প্রথম কে বলেছেন জানি না।  তবে, আমার গুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসকে মাঝে মাঝেই এমন একটি গল্প বলতে শুনেছি। একদিন একটি বাচ্চা তার বাবার সামনে বসে বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে খেলছে। হঠাৎ মানচিত্রটি তার হাত থেকে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তাই দেখে বাবা রেগে আগুন। তিনি সেখান থেকে বের হয়ে যান।

ছেলে মানচিত্রের ভাঙা টুকরোগুলো হাতে নিয়ে জোড়া লাগাতে আরম্ভ করেন এবং সফলও হন। বাবা বাসায় ফিরে মানচিত্র অক্ষত দেখে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে সে মানচিত্র জোড়া লাগালো। বাচ্চাটি উত্তর দিলো, বাবা আমি যখন মানচিত্রটি জোড়া লাগাতে থাকি তখন এর অপর পিঠে একজন মানুষের চেহারা দেখতে পাই। তারপর আমি মানুষটির মাথার জায়গায় মাথা, মুখের জায়গায় মুখ, নাকের জায়গায় নাক, কানের জায়গায় কান এবং চোখের জায়গায় চোখ লাগিয়ে দেই। এরপর মানচিত্রটি উল্টে দেখি ঠিক মতো জোড়া লেগে গেছে।

বাবা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, যে ছবিটা সে মানচিত্রের পেছনে দেখেছে, তাকে সে চেনে কিনা। ছেলে ঘরের দেয়ালে টাঙানো বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখিয়ে দিলেন। সেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি।

আমরা যদি বাংলাদেশের পরিচয় চাই, তাহলে বলবো, বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। আবার যদি বঙ্গবন্ধুর পরিচয় চাই, তাহলে বলতে হবে, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। এ দুটি ভিন্ন সত্ত্বাকে কখনোই আলাদা করা যাবে না।

কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে একবার বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়েছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দি এক্সপেরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’ অর্থাৎ, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের আহ্বানে সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যান। আগত প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষায় বক্তব্য দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার দেশের মানুষ যে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন, আমি সেই ভাষায়ই এই অধিবেশনে বক্তব্য দেবো। তা না হলে আমি বক্তব্য দেবো না। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে সেই ৭৪ সালেই এই বাঙালির চেতনা মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে এসেছেন।

আমি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ দেখিনি।  ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দেখিনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদ সালামবরকতরফিক ও জব্বারকে দেখিনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬'র ছয় দফা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময়ও ছিলাম না। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কাহিনী আমি ইতিহাসে পড়েছি এবং বাবা-মায়ের কাছে শুনেছি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর কারাবরণের ভয়ঙ্কর চিত্র দেখিনি। নব্য স্বাধীন দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া ছিলো এই মহান নেতার গুরু দায়িত্ব। স্বাধীনতার বিরোধীদের গণহারে ক্ষমা করে দেয়া ছিলো তার উদারতা। বাঙালি জাতি যখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো আরম্ভ করলো ঠিক সেই সময় পরিকল্পিতভাবে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। এই হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের মাঝে ক্ষমতা বন্টন করা হয়েছে।

এসব ঘটনার কোনটাই আমি দেখিনি। কেননা, আমার জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার অনেক পরে। আর আমি দেখেছি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন, বর্ণবাদী ও অজ্ঞদের হাতে পড়ে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিতরা যুগে যুগে এই অশুভ শক্তিকে পরাজিত করেছে এবং আগামীতেও করবে।

আমি নিজ চোখে বঙ্গবন্ধুকে না দেখলেও তার জ্বালাময়ী ভাষণ আমাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার শক্তি যোগায়। আমার প্রতিটি ভোরে চোখ মেলে মাতৃভূমিকে দেখলেই বঙ্গবন্ধুকে দেখা হয়ে যায়। বাংলাদেশকে যত দেখি তার অপর পিঠে আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাই। তার হাসি, তার আঙুল তুলে বজ্র কণ্ঠের ভাষণ, তার ইতিহাসের মহানায়ক হওয়ার পরিচয় বহন করে আমার কাছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে সব নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং রাজাকারদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আত্মসম্মান ও লোকলজ্জার ভয়ে অনেক মেয়েকে তার বাবা-মা তাদের নিজেদের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এ কথা শুনে ভীষণ মর্মাহত হন। তিনি বলেছিলেন, যে সব ধর্ষিত মেয়ের বাবা লোকলজ্জার ভয়ে বাবা পরিচয় দিতে নারাজ সেই ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও- শেখ মুজিবুর রহমান।' এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু, এই ছিলো তার বিশালতা।

বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কারাগারে বন্দি। তাকে বলা হলো, তিনি যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা না চান তাহলে তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানানো হবে। আর যদি চান তাহলে তাকে হত্যা করা হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও আমার দেশের মানুষের মুক্তি চাই। তাতে যদি আমার জীবন দিতে হয়, তাই দিবো। কিন্তু একটা অনুরোধ, আমার লাশটা যেনো আমার বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগেই গোয়েন্দারা তাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, স্যার আপনি আপনার ৩২ নম্বর বাসা ছেড়ে সরকারি বাসভবনে আরো নিরাপত্তা জোরদার করে থাকবেন। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, যেই বাঙালি আমার কথায় জীবন দিতে প্রস্তুত, সেই বাঙালি আমাকে মারতে পারে না…।

এই সরল, নিঃস্বার্থ ও নির্ভীক মানুষটিই ছিলেন বঙ্গবন্ধু।  আর আমি এই মানুষটিকেই ভালোবাসি।

লেখক: হাকিম মাহি

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা