• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

অসুস্থতা এবং পেরেশানিও একটি নেয়ামত

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৪ জুলাই ২০২০  

যে ব্যক্তি বিভিন্ন পেরেশানি ও সমস্যায় জর্জড়িত থাকা সত্তেও আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে তার সম্পর্ক অটুট আছে, দোয়ার মাধ্যমে যিনি নিজের কষ্ট ও পেরেশানি দূর করার ফিকির করেন, হাদিসে তার জন্য সুসংবাদ রয়েছে। 

সুসংবাদটি হলো, আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালবেসে, দয়া ও অনুগ্রহ করে বিপদ-মসিবত দান করেছেন। এর পেছনে আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টি নেই।

পেরেশানি দুই প্রকার: মানুষ যখন কোনো পেরেশানিতে পড়ে, অসুস্থ হয়, বিপদগ্রস্ত হয়, অর্থসংকটে পড়ে, ঋণগ্রস্ত হয় কিংবা আয়-উপার্জনের পেরেশানিতে পড়ে অথবা পারিবারিক সমস্যায় পড়ে এ ধরনের আর যেসব সমস্যা ও সংকট তৈরি হয়, সেগুলো দুইপ্রকার। প্রথম প্রকার হলো, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আজাব ও শাস্তি হিসেবে পেরেশানি ও সমস্যা আসে। গুনাহর আসল শাস্তি তো পরকালে পাবে। কিন্তু অনেক সময় আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দুনিয়ায় শাস্তি দিয়ে দেন। কোরআন শরিফে আছে,

وَلَنُذِيقَنَّهُم مِّنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَىٰ دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘পরকালে দীর্ঘ আজাব আসার আগে আমি দুনিয়ায় সামান্য শাস্তি ভোগ করাই, যাতে লোকজন বদআমল থেকে ফিরে আসে।’ (সূরা: সিজদা, আয়াত: ২১)।

দ্বিতীয় প্রকার পেরেশানি ও মসিবত হলো, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং তাকে সাওয়াব ও প্রতিদান দেয়ার জন্য তাকে বিপদ-মসিবত দেন।

কষ্ট ও মসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি: এ দুই প্রকার মসিবতের মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করা হবে? উভয় প্রকার মসিবতের ভিন্ন ভিন্ন আলামত আছে। তা হলো যদি মানুষ মসিবতে পড়ে আল্লাহমুখিতা ছেড়ে দেয়। ধৈর্যহারা হয়ে আল্লাহ তায়ালার তাকদিরের ওপর অভিযোগ করে। উদাহরণত, বলতে লাগল (নাউযুবিল্লাহ) এসব বিপদ-মসিবতের জন্য আমাকেই পাওয়া গেল। আমার ওপরই কেন এসব বিপদ-মসিবত আসে ইত্যাদি। এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া বিধানাবলী পালন করা ছেড়ে দিল। উদাহরণত, আগে নামাজ পড়ত, এখন মসিবত আসার কারণে নামাজ পড়া ছেড়ে দিল। আগে জিকির-আজকারের পাবন্দি করত, এখন ছেড়ে দিল। মসিবত দূর করার জন্য দুনিয়াবি উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে লাগল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওবা ও ইসতেগফার করে না। দোয়া করে না। এগুলো এই কথার আলামত, যে মসিবত তার ওপর এসেছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিরূপেই এসেছে।

কষ্ট ও মসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত: যদি বিপদ-মসিবত সত্তেও মানুষ আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে দোয়া করতে থাকে, হে আল্লাহ, আমি দুর্বল। এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। হে আল্লাহ, আপনি আপনার রহমতে আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিন। এই কষ্টের কারণে যেন মনে কোনো অভিযোগ না থাকে। কষ্ট অনুভব করছে। কাঁদছেও। দুঃখ ও কষ্টের প্রকাশও করছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার তাকদিরের ওপর কোনো অভিযোগ করছে না। বরং বিপদে পড়ার পর আল্লাহর প্রতি ধ্যান-খেয়াল ও মনোযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের চেয়ে বেশি নামাজ পড়ছে, আগের চেয়ে বেশি দোয়া করছে। তা হলে বুঝতে তার ওপর এসব বিপদ-মসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং সাওয়াব ও প্রতিদান দেয়ার জন্য এসেছে। এ বিপদ-মসিবতও তার জন্য রহমত এবং তার প্রতি আল্লাহ তায়ালার মহব্বত থাকার দলিল ও আলামত।

পেরেশানি মুক্ত কেউ নেই: প্রশ্ন হলো যখন একলোক কাউকে মহব্বত করে। মহব্বতের দাবি হলো তাকে আরাম ও শান্তি দেয়া। তাই আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে মহব্বত করেন, তাকে আরাম ও শান্তি দেয়া উচিত। তাহলে আলাহ তায়ালা কেন তাকে কষ্ট দেন? এর উত্তর হলো দুনিয়ায় এমন কোনো মানুষ নেই, যার কখনো কোনো কষ্ট হয়নি। কখনো কোনো দুঃখ ও পেরেশানি হয়নি। যত বড় নবী-রাসূল হোন, যত বড় অলি-আউলিয়া, সুফি-দরবেশ, বাদশা যে-ই হোন, দুনিয়ায় দুঃখ-কষ্ট ছাড়া জীবনযাপন করা সম্ভব না। কারণ পার্থিব এই জগতকে আল্লাহ তায়ালা এভাবেই বানিয়েছেন। এখানে আনন্দ-বেদনা, আরাম ও কষ্ট সবই পাশাপাশি চলতে থাকে। নির্মল আনন্দ ও সুখের স্থান দুনিয়া না। সেটা হলো জান্নাত। যার সম্পর্কে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে,

وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

‘সেখানে কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুঃখ নেই। (সূরা বাকারা, আয়াত: ৩৮)।

প্রকৃত আনন্দ ও আরামের স্থান সেটি। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে বানিয়েছেন আনন্দ-বেদনার জায়গা হিসেবে। এখানে কখনো ঠাণ্ডা। কখনো গরম। কখনো রোদ। কখনও বৃষ্টি। কখনও এই অবস্থা। কখনও ওই অবস্থা। তাই দুনিয়ায় কষ্ট ছাড়া কেউ থাকবে এটা সম্ভব নয়।

একটি শিক্ষণীয় ঘটনা: হজরত হাকিমুল উম্মত থানবি (রহ.) একটি ঘটনা লিখেছেন। হজরত খিজির (আ.) এর সঙ্গে একব্যক্তির দেখা হলো। লোকটি হজরত খিজির (আ.)-কে বলল, আমার জন্য দোয়া করুন, যাতে পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট আমাকে স্পর্শ না করে। আমি যাতে দুঃখহীন জীবনযাপন করতে পারি।

হজরত খিজির (আ.) বললেন, আমি এই দোয়া করতে পারব না। কারণ দুনিয়ায় দুঃখ-কষ্ট আসবেই। হ্যাঁ! একটি কাজ করতে পারি। তুমি দুনিয়ায় খুঁজে দেখ, যাকে সবচেয়ে বেশি দুঃখ-কষ্টহীন সুখী মনে হবে তুমি আমাকে ওই ব্যক্তির কথা বলো। আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করব, আল্লাহ তায়ালা যেন তোমাকে ওই ব্যক্তির মতো বানিয়ে দেন।

লোকটি অনেক খুশি হলো। ভাবল, এ রকম লোক তো নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, যারা অনেক আরাম ও শান্তিতে আছে। আমি তাদের মতো হওয়ার দোয়া করিয়ে নেব। এরপর সেই ব্যক্তি তালাশে বের হলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজনকে সে বের করে। আমি তার মতো হওয়ার জন্য দোয়া করাব। এরপর অন্যজনকে তার চেয়েও বেশি সম্পদশালী ও সুখী মনে হয়। তিনি স্থির করেন, আমি এর মতো হওয়ার দোয়া করাব। এভাবে দীর্ঘদিন তালাশ করার পর সে একব্যক্তিকে খুঁজে বের করল। যে সোনা-রুপা, মণি-মুক্তাসহ অন্যান্য মূল্যবান পাথরের ব্যবসায় করত। তার দোকান ছিল অনেক বড় ও সুসজ্জিত। সে বিশাল বিশাল মহলের মালিক ছিল। তার অনেক মূল্যবান ও দামি বাহনজন্তু ছিল। চাকরবাকর ও কর্মচারিরা সেবা-যত্নে ছিল সদা ব্যস্ত। তার ছেলেরা ছিল, খুবই নাদুস-নুদুস ও সুন্দর। বাহ্যিক অবস্থা থেকে তার ধারণা হয়, এই লোকটি বড় আরাম ও শান্তিতে আছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, হজরত খিজির (আ.)-কে দিয়ে এই লোকের মতো হওয়ার দোয়া করাবে। যখন ফিরে যাচ্ছিল, ভাবল, বাহ্যিক অবস্থায় তো লোকটিকে অনেক ভালো মনে হচ্ছে। কিন্তু ভিতরগত অবস্থা কেমন কে জানে। আমার অবস্থা না আরো খারাপ হয়ে যায়। তাই ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করে দেখা দরকার, তার অবস্থা কেমন যাচ্ছে?

সুতরাং সে ব্যবসায়ীর কাছে এগিয়ে গেল। তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি তো বড় শান্তি-সুখেই জীবনযাপন করছেন। ধন-সম্পদের ছড়াছড়ি। চাকর-কর্মচারীরা সদা তৎপর। আমি আপনার মতো হতে চাই। আপনার অভ্যন্তরীণ কোনো পেরেশানি নেই তো। আপনি কোনো রোগ বা বিপদে আক্রান্ত নন তো?

ব্যবসায়ী তাকে একটি নির্জন জায়গায় ডেকে নিল। তারপর তাকে বলল, তোমার ধারণা হয়েছে আমি অনেক সুখে আছি। আমার অনেক সম্পদ, অনেক চাকরবাকর। কিন্তু দুনিয়ায় আমার চেয়ে বেশি দুঃখ-কষ্টে আর কেউ নেই। এরপর সে তার নিজের স্ত্রীর চারিত্রিক অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বলল, তুমি যে সুন্দর ও নাদুস-নুদুস ছেলে-মেয়ে দেখছ। এরা মূলত আমার সন্তান না। এদেরকে দেখে আমি প্রতিটি মুহূর্তে দুঃখ ও বেদনায় নীল হচ্ছি। আমার ভেতরে দুঃখ ও বেদনার যে আগুন জ্বলছে তুমি তার কিছুই জান না। তাই আমার মতো হওয়ার কখনোই আকাক্সক্ষা কর না। ব্যবসায়ীর কথা শুনে সে বুঝল, ওপর থেকে দেখে যাদেরকে আরাম-আয়েশ ও সুখ-শান্তিতে আছে বলে মনে হয় প্রকৃতপক্ষে এদের কেউ সুখী না।

দ্বিতীয়বার হজরত খিজির (আ.) এর সঙ্গে তার সাক্ষাত হলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হে, বল তুমি কার মতো হতে চাও? সে উত্তর করল, আমি দুঃখ ও পেরেশানিমুক্ত এমন কাউকে পাইনি, যার মতো হওয়ার জন্য আমি আপনাকে দোয়া করতে বলব।

জরত খিজির (আ.) বলেন, আমি তো পূর্বেই তোমাকে বলেছি যে, দুনিয়ায় কাউকে দুঃখ-কষ্ট ছাড়া পাবে না। তবে আমি তোমার জন্য এই দোয়া করি যে, আলাহ তায়ালা তোমাকে নিরাপদ জীবন দান করুন।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা