• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

কষ্টে আছে বাংলাদেশ, খুশির যেন নেই শেষ

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৩০ জুলাই ২০২২  

‘কী ভাই দেশের কী অবস্থা? বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি খালি? আগামী মাসে দেখবেন বিদ্যুৎ থাকবেই না। হা হা...।’ জরুরি কাজে একটি অফিসে গেছি। অফিসের কর্তা এভাবেই আমাকে স্বাগত জানালেন। তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই বললেন, চা খাবেন? এখন তো কৃচ্ছ্রতা চলছে। চিনি ছাড়া চা খান। বলে, দমকা বাতাসের মতো হা হা করে হাসলেন। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। আওয়ামী লীগের হাইব্রিড মন্ত্রীদের সঙ্গে তার বেশ দহরম মহরম। এখন দেশের সংকট নিয়ে তামাশা করছেন। আওয়ামী লীগের সমালোচক বনে গেছেন। শুধু এই ব্যবসায়ী নন, দেশের কিছু মানুষ এবং গণমাধ্যম এখন যেন খুশিতে আত্মহারা। বাজারে ডলার সংকট। হু হু করে বাড়ছে ডলারের দাম। আহা কী আনন্দ। টকশোতে গিয়ে বাকবাকুম ভঙ্গিতে জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছেন। লোডশেডিং চলছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ যেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞে ভরে গেছে। সবাই পন্ডিত। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কী ধরনের লুটপাট হচ্ছে তার ফিরিস্তি দেখছি সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। টেলিভিশন টকশোতে জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতির ব্যাখ্যা দিতে দিতে ক্লান্ত সুধীজনরা। এর মধ্যে কিছু সুশীল সফেদ-জামাকাপড় পরে জাতির সামনে উপস্থিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। হঠাৎ করেই গণমাধ্যমে তাদের ভিড় রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। আবার যেন তারা জ্যোতিষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। আমাদের সুশীলরা যখন ঘন ঘন দৃশ্যমান হন, তখনই বাংলাদেশে অঘটন ঘটে। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার সময় যে পন্ডিত বলেছিলেন, বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে। ২১ জুলাই সবচেয়ে বড় ২০ প্রকল্পের পরিস্থিতি ও প্রবণতা নিয়ে ভার্চুয়াল আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন, খুশিতে আটখানা এই কথক অর্থনীতিবিদ। প্রায় গদ গদ হয়ে বলছিলেন, ‘মেগা বা বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের চাপে অর্থনীতিতে আগামীতে বড় ধাক্কা আসছে। কিছু বড় উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি ঋণ পরিশোধের গ্রেস পিরিয়ড বা মেয়াদকাল শেষের দিকে। এসব ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে। ঋণ পরিশোধের সময়কাল যত ঘনিয়ে আসছে, অর্থনীতির জন্য তা তত চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তার মতে, ‘আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়বে। এ তো উদ্বেগের কথা। চিন্তার কথা। কিন্তু তিনি উৎফুল্ল হয়ে কথাগুলো বলছিলেন কেন? বাংলাদেশ সংকটে পড়বে এটা কি খুশির খবর? আরেক অর্থনীতিবিদ দেখলাম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে, এই তথ্য দিয়ে থ্রি চিয়ার্স বলার কসরত করছেন। বাংলাদেশের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতো হচ্ছে বলে মন্তব্য করে তিনি ঠোঁটের কোনায় হাসিটা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশের কিছু সংবাদপত্রে যেন আতঙ্ক ছড়ানোর উৎসব চলছে।

‘রপ্তানি ছাড়া কোনো সূচকই ভালো নেই।’ ‘কমছে ক্রয়াদেশ, বাড়ছে খরচ’ ‘ডলার-সংকটে দর বাড়ছেই।’ ‘শিগগিরই কাটছে না অর্থনৈতিক সংকট।’ বাংলাদেশে নতুন করে ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামবে। ইত্যাদি শিরোনাম আমাদের মতো মানুষের জন্য ভয়ংকর দুঃসংবাদ। এসব সংবাদ শুনে আমাদের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। পত্রিকার খবরগুলো আপনি উপেক্ষা করতেই পারেন। কিন্তু পন্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণীকে আপনি উপেক্ষা করবেন কীভাবে? ২৪ জুলাই ওয়ান-ইলেভেনের উপদেষ্টামন্ডলীর বেশ কজন একত্রিত হয়েছিলেন সিপিডির ছাতার নিচে। দেশের অর্থনীতি নিয়ে বিনিদ্র রজনী পার করে তারা সমবেত কণ্ঠে দুর্দশার কোরাস গাইলেন। এদের মধ্যে এক-এগারো সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে কিছুক্ষণ আর্তনাদ করলেন। কিন্তু তার নেতৃত্বে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে দেশ কী ভয়ংকর অর্থনীতির সংকটে পড়েছিল, তা অবলীলায় তিনি ভুলে গেলেন। আরেকজন ওই সরকারের জ্ব¦ালানি উপদেষ্টা ছিলেন। তার আমলে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। তিনি দুই বছরে বিদ্যুৎ সংকটের ন্যূনতম সমাধান দিতে পারেননি। অথচ সেদিন কেতাবি ঢঙে সরকারকে অবলীলায় নসিহত করলেন। আরেক উপদেষ্টা চাল সংকটে দিশাহারা হয়ে ২০০৮ সালে বলেছিলেন, ‘চেয়ারের ওপাশে বসে সমালোচনা করা সহজ। কিন্তু চেয়ারে বসে সংকট সমাধান কঠিন।’ তিনিও ‘লৌহ ত্রিভুজ’ তত্ত্ব দিয়ে হাততালি কুড়ালেন। সংকটের এই গল্পের মধ্যেই এক পত্রিকায় খবর বেরোল পেট্রোল পাম্পে নাকি তেল রেশনিং হচ্ছে। ৪০০ টাকার বেশি মোটরসাইকেলে তেল দেওয়া হচ্ছে না। ৩ হাজার টাকার বেশি ব্যক্তিগত গাড়িতে অকটেন দেওয়া হচ্ছে না। খবরটি খুবই কৌশলে পরিবেশিত। খবরের এক অংশ পড়ে আপনি আতঙ্কিত হবেন। খবরের শেষ অংশে বলা হয়েছে, ‘তবে অন্যান্য পাম্পে স্বাভাবিকভাবে পেট্রোল-অকটেন বিক্রি হচ্ছে।’ একটি পেট্রোল পাম্পে নানা কারণেই তেল বিক্রি সীমিত বা বন্ধ করা হতে পারে। কিন্তু তা জাতীয় সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করে আতঙ্ক ছড়ানোর অর্থ কী? এই দায়িত্বহীন সংবাদের জবাব দিতে হলো বিপিসির চেয়ারম্যানকে সংবাদ সম্মেলন করে। বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, তেমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন অনেকে। সেই দৃশ্যের লাইভ টেলিকাস্টের অপেক্ষায় আওয়ামী লীগ আমলে লাইসেন্স পাওয়া কিছু টেলিভিশন চ্যানেল।

এর অর্থ এই না দেশে সংকট নেই। অর্থনীতিতে শঙ্কা নেই। আছে, অবশ্যই আছে। এসব সংকট এবং শঙ্কা ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। প্রতিদিন লোডশেডিংয়ে কষ্ট পাচ্ছে মানুষ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে দিশাহারা অবস্থা। লাগামহীন ডলার বাজার। ডলার সংকট ব্যবসায়ীদের বিচলিত করছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ কষ্টে আছে। কিন্তু এই সংকট এবং কষ্ট কি শুধু বাংলাদেশে? শুধু বাংলাদেশেই কি মুদ্রাস্ফীতি, বাংলাদেশেই কি রিজার্ভে টান? বাংলাদেশেই কি ডলারের দাম ঊর্ধ্বগতি? না। এটি একটি বৈশি^ক সংকট। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ২৬ জুলাই ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্ব মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে। ওই প্রতিবেদন একটু গভীরভাবে পড়লে দেখা যায়, বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন এবং ভারতের মতো দেশে বিশ্ব পরিস্থিতিতে কীভাবে খারাপ হয়েছে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। আইএমএফ চলতি বছর বৈশি^ক প্রবৃদ্ধি হিসাব করেছে ৩ দশমিক ২। সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ দশমিক ৪। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের এ বছর চীন (৩ দশমিক ৩), কানাডা (৩ দশমিক ৪), যুক্তরাজ্য (৩ দশমিক ২), ইউরোপ (২ দশমিক ৬) এবং যুক্তরাষ্ট্রের (২ দশমিক ৩) চেয়ে ভালো করবে। আগামী বছর প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে। বৈশি^ক সংকটে যদি সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ কৃচ্ছ্রতা সাধন করে তাহলে এত হইচই কেন। বিশ্ব অস্থিরতার জন্য যদি কিছু লোডশেডিং করতে হয়, তাহলে কি দেশের বারোটা বাজে? বিশ্ব বাজারের জন্য দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি হলেই কি বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়ে যায়?
বর্তমান সংকটে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী গত বুধবার জাতিকে আশ্বস্ত করে জানালেন, ‘বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে আগামী ৬ থেকে ৯ মাস খাদ্য আমদানি করা যাবে।’ বর্তমান সরকারের আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গর্ব করার মতো অবস্থানে যায়। রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তি এবং সামর্থ্যরে প্রতীক। বাংলাদেশের রিজার্ভ দুই বছর ধরে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপর ছিল। সম্প্রতি তা ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। কেউ কেউ এটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যে, ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা মানেই বিপদসংকেত। আসলে কি তাই? মোটেও না। অর্থনীতিতে বলে একটি দেশের রিজার্ভ দিয়ে যদি তিন মাসের ব্যয় মেটানো যায় তাহলে তা স্বস্তিদায়ক। বর্তমানে থাকা রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ আগামী পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারে। তাছাড়া বিশ্বে এখন সব দেশের রিজার্ভেই নিম্নমুখী প্রবণতা। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে চীনে। গত সাত মাসে চীনের রিজার্ভ ৩ হাজার ২৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩ হাজার ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। জাপানের রিজার্ভ ১ হাজার ৪০০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের রিজার্ভ ৯৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৮৪০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ভারতের রিজার্ভ গত ২০ বছরের সবচেয়ে কম এখন। গত জানুয়ারিতে ভারতের রিজার্ভ ছিল ৬০০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৫৭২ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে। যা দিয়ে দেশটি তিন মাসের ব্যয় মেটাতে পারবে না। এ জন্যই বলা হচ্ছে পাকিস্তান হতে যাচ্ছে পরবর্তী শ্রীলঙ্কা। অথচ পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার পরও কেউ কেউ বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে বলে উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ এখন ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে।

গত সপ্তাহজুড়ে ডলার নিয়ে হাহাকার। শেষ কর্মদিবসে খোলা বাজারে ডলার ১১২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক। এর  পেছনে অন্য কারণ আছে। গত কয়েক মাস ধরেই ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণেই অনেকে এটাকে লাভজনক বিনিয়োগ মনে করছেন। নগদ টাকায় ডলার কিনছেন বেশি লাভের আশায়। এটি অর্থনীতির একটি খারাপ প্রবণতা। কিন্তু ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কিছুদিন ধরেই দেশে দেশে স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হচ্ছে ডলারের বিপরীতে। সম্প্রতি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ স্টিভ হাঙ্কি ডলারের বিপরীতে দর হারানো মুদ্রা নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। এই গবেষণায় দেখা যায়, দেশে দেশে মুদ্রার দরপতন হচ্ছে। স্টিভ হাঙ্কির মতে, সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে ভেনেজুয়েলার মুদ্রা ‘বলিভার’-এর। গত ৩০ মাসে এই মুদ্রার দাম কমেছে প্রায় ১০০ শতাংশ। ১ ডলারের বিপরীতে জিম্বাবুয়ের ডলার এখন ৯৫০। তৃতীয় দাম কমেছে লেবাননের পাউন্ডের। ১ মার্কিন ডলার দিলে আপনি পাবেন ১৫১০ লেবানিজ পাউন্ড। গত ৩০ মাসে লেবানিজ মুদ্রার দাম কমেছে প্রায় ৯৩ ভাগ। প্রতি ডলারের বিপরীতে সিরিয়ান পাউন্ড এখন ৪০১০। গত ৩০ মাসে উন্নত দেশ তুরস্কও ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। তাদের মুদ্রা লিরার মান কমেছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। এখন ১ ডলারের বিপরীতে ১৭ দশমিক ৮০ লিরা পাওয়া যায়। ১ ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি পাওয়া যায় ২২৯। দরপতনে ভারতীয় রুপিও নিত্যনতুন রেকর্ড করছে।

গত সোমবার ভারতীয় রুপি ডলারের বিপরীতে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। এখন ১ ডলার দিয়ে পাওয়া যায় ৮০ রুপি। ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামনে দরপতন অব্যাহত থাকবে। প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরোর মূল্যমান ডলার নিচে নেমে গেছে। এই দরপতন অব্যাহত থাকবে বলেই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ মাসে ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্যমান কমেছে ১৩ শতাংশ। বাংলাদেশ কি বিশ্ব পরিস্থিতির বাইরে? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা তার চেয়ে আমরা ভালো থাকতে পারতাম। বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। কিছু কিছু ব্যাংকে রীতিমতো লুটপাট হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, ‘ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে।’ সরকারের ভিতরে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। সরকার এসব বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। হয়তো যথেষ্ট নয়। তবে এই সংকট একটা সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ব্যক্তিজীবনেও আমরা দেখি যে, একজন মানুষ যখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন তখন তিনি তার অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেন। খারাপ অভ্যাসগুলো বাদ দেন। সংযমী হন। এই সংকট বাংলাদেশেও অপচয় বন্ধের একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থ পাচার বন্ধে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে। সরকার নিশ্চয়ই এখন চিন্তা করবে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া কতটা যৌক্তিক। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী- সরকারি-বেসরকারি ৯০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরকার গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া দিয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। জনগণকে অন্ধকারে রেখে এখন সরকার কতিপয় ব্যক্তিকে মাখন খাওয়াবে কি না সেটা অবশ্যই দেখার বিষয়। কিন্তু একবার ভাবুন তো কী ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে দেশ ডুবে ছিল ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। এ সময় কুইক রেন্টাল ছিল তাৎক্ষণিক সমাধান। সামনে বড় বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলো চালু করে যে সরকার কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসবে তা বোঝার জন্য পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, রামপালের মতো প্রকল্প আলোর মুখ দেখলে কুইক রেন্টালের দরকার হবে না। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার পড়লেই দেখা যায়, বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ তিনটি কৌশল গ্রহণ করেছিল। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টার লোডশেডিং থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছিল এই সরকারই। এখন জার্মানি জ্বালানি এবং বিদ্যুতের জন্য আবার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফিরে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যখন রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ঘোষণা দেওয়া হলো, তখন এই পন্ডিতরাই মাতম তুলেছিল। সুন্দরবনের সর্বনাশ হবে বলে কেউ কেউ রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলেন। কী মজার ব্যাপার দেখুন। এখন তারাই বলছেন, আমাদের কয়লা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেওয়া দরকার। তখন বললেন, কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবেশ বিপন্ন করবে। এখন বলছেন, কয়লা কেন মাটির নিচে পুঁতে রেখেছেন। সরকার কোনটা শুনবে? জ্বালানি ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় সমালোচনা হলো গ্যাস উত্তোলনে অনীহা। সেদিন দেখলাম একজন সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা বলছেন, ‘প্রাথমিক পণ্য হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়নি। পাঁচটি গ্যাসকূপ খনন করতে ৫০০ কোটি টাকা লাগে। যদি না পাওয়া যায়-এমন শঙ্কায় সরকার ঝুঁকি নিতে চায়নি। এই ঝুঁকি নেওয়ার রাজনৈতিক সাহস কেউ দেখাতে পারেনি।’ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাহস নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করে, তাহলে তার জন্য আমার স্রেফ করুণা হয়। পদ্মা সেতুর পর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাহস নিয়ে প্রশ্ন করা রীতিমতো হাস্যকর। এই পন্ডিতই ২০১৪ সালে যথেচ্ছ কূপ খননের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যথেষ্ট যাচাই-বাছাই না করে গ্যাস অনুসন্ধান এক ধরনের দুর্নীতি।’ দুই বছর জ¦ালানি উপদেষ্টা ছিলেন, কটি কূপ খননের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

একটি রাষ্ট্র, একটি সমাজ, একটি পরিবার হঠাৎ সংকটে পড়তে পারে। সত্যিকারের শুভাকাক্সক্ষীরা তখন পাশে দাঁড়ান। সৎ পরামর্শ দেন। আর কিছু মতলববাজ কষ্ট দেখে হাততালি দেন। সর্বনাশের অপেক্ষায় থাকেন। অন্যের কষ্টে মুখ টিপে হাসেন।

বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি একটি বৈশি^ক সংকটের বাস্তবতা। এ সময় দেখছি কিছু মানুষ যেন মতলববাজ হয়ে উঠেছে। সংকটকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জনগণকে আতঙ্কিত করতে তারা যেন মরিয়া। কারও কারও কথায় মনে হচ্ছে, এত দিনে বাগে পেয়েছি সরকারকে। এক ডজন বুদ্ধিজীবী গত এক মাস ধরে সরকারের সমালোচনা করছেন। সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করছেন। সরকারের ভুল নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছেন। কিন্তু এদের একজনও বলছেন না সরকারকে কী করতে হবে। সরকার যখন কৃচ্ছ্রতার পদক্ষেপ নিল, বলা হলো আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। কী পদক্ষেপ? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। সুশীলরা যে সমবেত সংগীত গাইছেন তাতে বিএনপির নেতাদেরও নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। সুশীলদের শেখানো বুলি এখন বিএনপি নেতাদের মুখে। কৃচ্ছ্রতাকে সরকারের মহাসংকট হিসেবে উপস্থাপনের এক প্রাণান্ত চেষ্টা ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। বাংলাদেশ সত্যি সত্যি যদি সংকটে পড়ে তাহলে এ দেশের জন্য তাদের দুঃখ হবে না। বরং খুশির উৎসব করবেন তারা। সব বুদ্ধিজীবী বলছেন, ২০২৩ কিংবা ২০২৪ সালে সংকট দেখা দেবে। ২০২৩-২৪ সাল বাংলাদেশের নির্বাচনের বছর। তাহলে কি নির্বাচনের আগে সরকারকে কোণঠাসা রাখার জন্য এই আতঙ্ক উৎসব?  বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে জনগণকে অস্থির করে আবার কি সুশীলরা মসনদে বসতে চান?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা