• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ফিরে আসুক আমার বাংলাদেশ

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯  

লেখাটা শুরু করলাম একটি সুসংবাদ দিয়ে। বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ভাবে ১০,৭৮৯ জন রাজাকারের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। বিজয়ের ৪৯ তম বর্ষের প্রাক্কালে যখন এমন একটি সংবাদ পাই তখন স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত হই। হোকনা দেরি তাওতো শুরু হলো। তালিকার এখানেই শেষ নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। আমরাও বিশ্বাস করি তালিকার কাজ এখানেই থেমে যাবে না।

যদিও ইতিমধ্যেই তালিকা নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে প্রচুর। এতবছর পরে হলেও যে কাজটি করা হলো সেটির গুণগত মান যেন হয় একদম নিখুঁত ও প্রশ্নাতীত এমনটাই চাওয়া আমাদের। অস্বীকারে সমাধান আসে না বরং ভুল যদি হয়েই থাকে তাহলে সেটা স্বীকার করে যথাযথ শক্ত পদক্ষেপ নিয়ে সেটিকে সংশোধনের উদ্যোগ নিলেই বরং আমাদের মনে আস্থা আসবে। নিঃসন্দেহে রাজাকার, আলবদর, আলশামস এর তালিকা প্রকাশ একটি মহৎ উদ্যোগ যাকে আমরা কোনভাবেই কলুষিত হতে দিতে পারি না। তাই আশা করছি এই ইস্যুতে অন্তত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

 আমরা চাই, ফিরিয়ে আনা হোক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতিগুলোকে, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শপথ বাক্যের মত পড়ানো হোক সংবিধানে উল্লেখিত প্রস্তাবনাগুলোকে। প্রতিটা স্কুলে, মাদ্রাসায় যেমন করে এসেম্বলি করানো হয়, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হয় ঠিক তেমন করে মুখস্থ করানো হোক বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বাণীকে। মগজে থাকবে কেবলই বাংলাদেশ। আর কিছু নয়। তবে মুক্তি মিলবে জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা থেকে। ফিরিয়ে আনা সম্ভব সোনার স্বপ্নের বাংলাকে 

আর সেই শুদ্ধ তালিকাকে ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সবার মাঝে। সকলের হাতে হাতে, মুখে মুখে পৌঁছে দেবার এই দায়িত্বটি সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকেই নিতে হবে। জানি এ কাজ সহজ নয় আবার কঠিনও নয়। যে যুদ্ধাপরাধীরা একদিন বিচরণ করেছে এই বাংলার বুকে যারা বিশ্বাস করতো তাদের বিচার করবার মত সাহস কারও নেই সেই তাদেরকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে যে শেখ হাসিনা দিনশেষে আমরা তাঁর উপরেই আবারও ভরসা রাখতে চাই তিনি এই বাংলার মাটিকে ঘাতকমুক্ত করেই ছাড়বেন আর তিনিই পারবেন এই কাজটি করতে।

আমি প্রজন্মকে চিনতে চাই সবসময় কারণ আজকে যারা শিশু, তরুণ, যুবক সামনের দিনে তারাই নেতা, কাণ্ডারী বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সেজন্যই এই প্রজন্মের বাহকদেরকে অবহেলার কোন সুযোগ নেই। প্রজন্মের রক্ত চলাচলের রাস্তা চিনাটা খুব জরুরি। দুটি টিন এজ সন্তানের জননী হিসাবে আমি চেষ্টা করি তাদের কাছ থেকে পালস বুঝতে। এই বয়সী তরুণেরা যখন গান বাজনা আড্ডা হৈ চৈ নিয়ে মেতে থাকবে সেই তরুণেরা এখন ভাবে বিশ্ব নিয়ে, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, জীবনাচরণ ইত্যাদি নিয়ে। এর ইতিবাচক, নেতিবাচক দুটি দিকই রয়ে যায়। বর্তমান যুগ যেহেতু ইন্টারনেটের যুগ তাই এসব ভাবনা চিন্তায় পিতামাতা বা পরিবারের চেয়েও বড় ভূমিকা রাখে এই অন্তর্জালের দুনিয়া। কোথায় কী ঘটছে, কেন ঘটছে এবং তার প্রেক্ষিতেই সবার প্রতিক্রিয়া গড়ে উঠছে সহজেই। বিচার বিবেচনাও যেন আটকে গেছে সেই অন্তর্জালের দুনিয়াতেই।

ফেসবুক আসার পর থেকে এর মাত্রা ছাড়িয়েছে অনেকগুণ। এখন আমাদেরকে সরকারী উদ্যোগে সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের উপরও প্রচারণা চালাতে হয়। এবারের ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসের প্রতিপাদ্যই রাখা হয়েছিলো “সত্য মিথ্যা যাচাই আগে, ইন্টারনেটে শেয়ার পরে” আমার জানা নাই আর কোন দেশে সরকারকে এক ইস্যুতে এতটা পরিকল্পনা রাখতে হয় কি না। শিক্ষিত ও সচেতন মানুষজন নিজের বিবেক ও বুদ্ধি দিয়েই যাচাই বাছাইয়ের কাজটি করবে। বাস্তবে তা হচ্ছে না।

সকল উদ্যোগের পিছনেই কারণ হচ্ছে তরুণ সমাজকে সঠিক পথ চিনতে সাহায্য করা। এই সাহায্যের একটি অন্যতম রাস্তা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে ধারণ করে এমন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা। পাঠ্যবইয়ে সংবিধানে উল্লেখিত মুক্তিযুদ্ধের যে চার মূলনীতি আছে সেই মূলনীতিগুলোকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন ও অবশ্য পঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই কাজটি করতে হবে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত।

জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এর আলোকেই শিক্ষিত করতে হবে এই জাতিকে। আমাদের মূল চালিকাশক্তি তরুণ সমাজ। যাদের উপর ভিত্তি করে সামনের বাংলাদেশের ছবি অংকিত, সেই তরুণদের বাঁচাতে হবে আমাদেরকেই। চারপাশের অশুভ শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করে আনতে হবে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের পথে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এই পরিবর্তন আপাতত অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমাদের সংবিধানের প্রথমেই কিছু প্রস্তাবনা দেয়া আছে। কী আছে সেগুলোতে? সেই বিষয়গুলো কি আমরা কেউ পড়েছি, জেনেছি বা বুঝেছি? আমি নিজেও আগে সেভাবে পড়িনি। কেবল জানতাম মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির আলোকে গড়ে উঠেছিলো আমাদের সংবিধান।

অতি সম্প্রতি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের একজন অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম তাঁর এক আলোচনায় বলেছেন এই প্রস্তাবনার কথা। কোন ভাবনা থেকে তাঁরা সেদিন সেগুলো লিখেছিলেন দিয়েছেন বিস্তারিত ব্যাখ্যা। আজকের দিনকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই কমিটি সেদিন প্রস্তাবনাকে সব জায়গায় অবশ্য পাঠ্য করতে বলেছিলেন। নিজ আগ্রহেই আমি গুগল ঘেটে পড়েছি কী আছে ওতে। বুঝলাম কতটা দূরদর্শিতার ছাপ রয়েছে প্রতিটা অক্ষরের মাঝে। অথচ আমরা সেগুলোকেই অবহেলা করে যাচ্ছি দিনের পর দিন।

প্রস্তাবনার প্রতিটি বাক্যের মাঝে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাণী। বাংলাদেশের সৃষ্টির ইতিহাস ও আকাঙ্খার কথা। কোন বাংলাদেশ চাই, কেমন চাই এবং কেন চাই প্রস্তাবনাগুলো পড়লেই বুঝা যাবে। আমাদের জাতিসত্ত্বার স্তম্ভ সেগুলো। আজকের যে বিভ্রান্ত প্রজন্ম গড়ে উঠেছে এর পিছনের কারণ আমরা প্রতিটি ক্ষণে কেবল অবহেলাই করে এসেছি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একদিকে বাংলাদেশের কথাগুলোকে জানতে দেয়া হয়নি, রাজাকার আলবদরদের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো আবার অন্যদিকে জনতার মাঝে গড়ে দেয়া হয়েছে একধরনের উন্নাসিক মানসিকতাকে।

আমরা চাই, ফিরিয়ে আনা হোক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতিগুলোকে, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শপথ বাক্যের মত পড়ানো হোক সংবিধানে উল্লেখিত প্রস্তাবনাগুলোকে। প্রতিটা স্কুলে, মাদ্রাসায় যেমন করে এসেম্বলি করানো হয়, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হয় ঠিক তেমন করে মুখস্থ করানো হোক বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বাণীকে। মগজে থাকবে কেবলই বাংলাদেশ। আর কিছু নয়। তবে মুক্তি মিলবে জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা থেকে। ফিরিয়ে আনা সম্ভব সোনার স্বপ্নের বাংলাকে।

লেখক : কলামিস্ট

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা