• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

ফুলতলার উৎপাদিত মধু এখন বিদেশের বাজারে

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১  

আধুনিক প্রযুক্তিতে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদনে স্বাবলম্বী হয়েছেন খুলনার ফুলতলা দামোদরগ্রামের আবুল কালাম সরদার (৫৫)। আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পরিশোধিত দুই থেকে আড়াই মন মধু উৎপাদন করে বার্ষিক প্রায় ৯ লক্ষ টাকা লাভ করছেন তিনি। শুধু নিজে স্বাবলম্বী নয়, অন্যদেরকেও স্বাবলম্বী করতে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন “খুলনা মৌ-চাষি কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে একটি সমিতি। বর্তমানে তার উৎপাদিত মধু দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারত, কুয়েত ও সৌদিতে রফতানি হচ্ছে।

১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দামোদর গ্রামের মৃত. আকাম সরদারের পুত্র আবুল কালাম সরদার বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প) এর আওতায় মৌচাষ (মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন) বিষয়ক ২ মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে মৌমাছিসহ একটি বাক্স প্রদান করা হয়।

এদিকে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পিতার ছোট্ট মুদি দোকানে তাকে সময় দিতে হয়। ফলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ সালে বিসিক থেকে ২৮ হাজার টাকা দিয়ে ১১টি বাক্স অর্থাৎ ৩৩টি ফ্রেম মৌমাছিসহ ক্রয় করেন। প্রথম বছর মধু মৌসুমে ৬০ হাজার টাকা লাভ হয়। পরের বছর আরও ৩৫ বাক্স তৈরি করে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদনে নেমে পড়েন। ওই বছর লাভের পরিমাণ ছিল লক্ষাধিক টাকা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বর্তমানে এসে ২৫০বাক্সে ফ্রেম সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজারে। বার্ষিক মধু উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২শ’মন।

মধুর মৌসুম শুরু হয় ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। বিভিন্ন ফুলের মৌসুম বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে। সরিষা ফুলের মৌসুম ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। এটি পাওয়া যায় সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, জামালপুর ও কুড়িগ্রামে। ধনিয়া ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয় জানুয়ারি ও ফেব্রয়ারি এবং কালো জিরা ফুলের মধু ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে শরিয়তপুর, ফরিদপুর, ও রাজবাড়ি থেকে। লিচু ফুল থেকে মার্চ মাসে ঢাকা, গাজীপুর, পাবনা, নাটোর, দিনাজপুর ও যশোরে মধু চাষ করা হয়। মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত সুন্দরবন সাতক্ষিরা রেঞ্জের শ্যামনগর, বুড়িগোয়ালিনি থেকে গোলাখালি পর্যন্ত খোলপেটুয়া নদীর এপারে মৌমাছির বাক্স রেখে অবস্থান করতে হয়। সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যায়ক্রমে খলিশা ফুল, গরান, কেওড়া ও বাইন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ হয়ে থাকে।

তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সাতক্ষিরা, কলারোয়া এলাকায় বরই ফুল থেকে কিছু মধু সংগৃত হয়। বছরের বাকি ৬মাস মৌমাছিকে তোলা খাবার হিসাবে চিনি ও মিছরির রস খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। গত বছরে ৫০মন চিনি ও মিছরি কিনতে হয়েছিল। এ সময় নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ধনিয়া ফুল থেকে কিছু মধু সংগ্রহ করে। সেটিও মৌমাছির খাদ্য। মৌমাছির বড় শত্রু ফিঙে রাজা, সুইচোরা পাখি ও ভিমরুল । এরা মৌমাছি ধরে খায়। সেক্ষেত্রে গুলতি দিয়ে ফিঙে দমন, জাল পেতে সুইচোরা এবং বাসা পুড়িয়ে দিয়ে ভিমরুল দমন করতে হয়। প্রতি সিঙ্গেল বাক্সে ৮/১০ ফ্রেম মৌচাক, ডবল বাক্সে ১৫-১৬টি ফ্রেম বাক্স প্রতি ১টি রাণী মাছি, এক হাজার থেকে দুই হাজার পুরুষ এবং লক্ষাধিক শ্রমিক মাছি থাকে। বাক্স প্রতি এক মৌসুমে ১ থেকে দেড় মন মধু উৎপাদিত হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে একটি মৌমাছি এক হাজার ফুল পরিভ্রমণ করে এক ফোটা মধু তৈরি করে। আবার ফুল থেকে সংগৃহীত মধুর মাত্র ২০ভাগ মধু উৎপাদিত হয়। চাষের মৌমাছির গড় আয়ু ৪২ দিন। জন্মের প্রথম ২১দিন বাক্সে থেকে কর্মক্ষম হয়। জীবনের বাকি ২১দিনে চা চামচ মধু সংগ্রহ করে।

সফল মৌচাষী আবুল কালাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য দেশের উৎপাদিত মধুর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে অপরিশোধিত মধু থেকে ৮ শতাংশ পানি এবং ৩ শতাংশ অপদ্রব্য বের করে ফেলা হয়। ফলে পরিশোধিত মধু কিছুটা ঘন এবং দীর্ঘদিন গুনগত মান বজায় থাকে। গত বছর ১২ লাখ টাকায় চীন থেকে মধু পরিশোধিত মেশিন আনা হয়েছে। নিজের উৎপাদিত মধু ছাড়াও খুলনা, সাতক্ষিরা বাগেরহাটসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মধু চাষি ও ব্যবসায়ীরা কেজি প্রতি ২০টাকা হারে অপরিশোধিত মধু শোধন করে নিয়ে যাচ্ছে।

নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মধু উৎপাদন মৌসুমে প্রতিদিন গড় ১০মন পরিমাণ মধু পরিশোধিত করা হয়। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফুল থেকে সংগ্রহকৃত মধুর রং, স্বাদে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে দামও ভিন্ন। সলিড মধু নামে তার প্রতিষ্ঠানে সরিষা ফুলের মধুর খুচরা মূল্য কেজি প্রতি ৩০০টাকা, ধনিয়া ফুলের ৩০০ টাকা,লিচু ফুলের ৪০০ টাকা, সুন্দরবনের মধু ৮০০ টাকা, কালো জিরা ৯০০ টাকা।

তবে প্রতি মৌসুমে ২০০ থেকে ২৫০ মন মধু উৎপাদন হয়ে থাকে। উৎপাদন খরচ, যাতায়াত, শ্রমিকের মজুরি, স্পট ভাড়া, সরকারের রাজস্বসহ সকল ব্যয় নির্বাহ কওে বছরে নীট মুনাফা ৮লাখ তার উৎপাদিত মধু দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এখন দেশের বাইরেও রফতানি হচ্ছে। করোনা পূর্ব মৌসুমে ভারত ১০ টন, কুয়েতে ৩ টন, সৌদিতে ২ টন মধু রফতানি করা হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, প্রাচীন কাল থেকে মধু ভেজষ ও উপদেয় খাদ্য তালিকায় রয়েছে। মধুর চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে আধুনিক প্রযুক্তিতে মৌচাষ ও সঠিক প্রক্রিয়ায় মধু উৎপাদনে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

এখানকার মধুর গুনগত মান ভালো হওয়ায় দেশে ও দেশের বাইরে চাহিদা রয়েছে। বিসিকের খুলনা জেলা প্রমোশন অফিসার শেখ ওয়ালিউর রহমান বলেন, বিসিকের প্রশিক্ষণ নিয়েই আবুল কালাম একজন উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতা পেয়েছে। অন্যদের জন্য তিনি এখন অনুকরণীয়।

জামিরা গ্রামের আ. রহিম বলেন, নিয়মিত মধু খাওয়ার অভ্যাস থেকে ৫-৬ যাবত আবুল কালামের মধুর মানসম্মত মধু কিনে আসছি।

ফুলবাড়ি গ্রামের গৃহবধূ মর্জিয়া বেগম জানিয়েছেন, গর্ভধারণের ক্ষেত্রে পোলেন ট্যাবলেটের সরবরাহ না থাকায় নিয়মিত মানসম্মত মধু সেবন করছি এবং তার কার্যকারিতাও পাওয়া গেছে।

মৌ-চাষি আবুল কালাম সরদার নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অন্যদেরকেও স্বাবলম্বী করতে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন “খুলনা মৌ-চাষি কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে রেজিষ্টেশনকৃত একটি সমিতি। নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ৩৫ সদস্যের প্রত্যেকের রয়েছে স্বল্প পরিসরে মৌচাষ। আবুল কালাম নিজেই তাদেরকে মৌমাছি পালন, মধু উৎপাদন ও বাজারজাত করণের সকল কলা কৌশল হাতে কলমে শিখিয়েছেন। তার পুত্র মো. হাসানুল বান্নাও লেখাপড়া শেষ করে মৌচাষে দক্ষতা অর্জন করায় বিসিক, যুব উন্নয়ন ও সমবায় অধিদফতরের প্রশিক্ষক হিসেবে এখন সে বিভিন্ন কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা