• মঙ্গলবার ০৩ অক্টোবর ২০২৩ ||

  • আশ্বিন ১৭ ১৪৩০

  • || ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

অক্সিজেন পৌঁছে দিতে বিরামহীন ছুটছেন তারা

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৯ জুন ২০২১  

নগরীর ট্যাংক রোডের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন গত সপ্তাহে। গত ২৪ জুন রাতে তার তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। শরীরে অক্সিজেন লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছিলো। পরিবারের অন্যরাও করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেওয়ার মানুষ ছিলো না। ফেসবুকে দেখে এক সন্তান ফোন দেয় খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের হটলাইনে। আধাঘণ্টার মধ্যে অক্সিজেন ব্যাংকের সদস্যরা পৌঁছে যায় তার বাসায়।

গত ২৪ জুন রাতে তার বাসায় যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী সাফায়েত সরদার বলেন, আমরা গিয়ে দেখি বাসার ৪ জনই শয্যাশায়ী। নজরুল ইসলামের অক্সিজেন লেভেল ৪০-৪৫ এর মধ্যে ওঠানামা করছে। ওই মুহূর্তে অক্সিজেন দিয়ে আমাদের ইজিবাইকে করে তাকে খুলনা করোনা হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় তাকে গাজী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা এখন উন্নতির দিকে।

গত ২৩ জুন বটিয়াঘাটা উপজেলার বিরাট বাজার এলাকা থেকে বৃদ্ধা খাদিজা বেগমকে নিয়ে খুলনা করোনা হাসপাতালে গিয়েছিলেন নাতী নাজমুল মোল্লা। সেখানে শয্যা ফাঁকা না থাকায় যান জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু শয্যা না থাকায় নিরুপায় হয়ে নিজে যান অক্সিজেন ব্যাংকের কার্যালয়ে। স্বেচ্ছাসেবকরা ইজিবাইকে তাকে অক্সিজেন সংযোগ দেন। শারীরিক থেরাপির পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। এরপর উপজেলার বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন এই নারী।

নাজমুল মোল্লা পূর্বাঞ্চরকে বলেন, ওই দিন কোনো হাসপাতালে শয্যা ছিলো না। হাসপাতাল থেকেই একজন অক্সিজেন ব্যাংকের ঠিকানা দিয়েছিলো। ওই দিন অক্সিজেন না পেলে নানী হয়তো বাঁচতেন না।

শুধু নজরুল ইসলাম বা খাদিজা বেগমই নয়; করোনায় আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিরামহীন ছুটে চলেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘খুলনা অক্সিজেন ব্যাংক’ এর সদস্যরা। হটলাইনে ফোন পেয়ে তারা রোগীর বাসায় অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছেন। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ-তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে সহযোগিতা করছেন। গত ২৬ জুন একদিনেই ২৯ জনের বাড়িতে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়েছে সংগঠনটি। আর গত বছরের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন রোগীকে।

করোনাকালীন অক্সিজেনের তীব্র সংকটে সংগঠনটি খুলনার অসুস্থ রোগীদের অন্যতম ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত সদস্যদের অক্সিজেনের জন্য সংগঠনটির কার্যালয়ে ভিড় করছেন মানুষ।

খুলনা নগরীর শেখপাড়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসা সড়কে খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের কার্যালয়। গত শনিবার দুপুরে কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে হটলাইনে অক্সিজেনের জন্য অনুরোধ আসছে। প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে টিবি ক্রস রোড থেকে রনি নামের এক ব্যক্তি এসে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যান। সিলিন্ডার পৌঁছে দিতে স্বেচ্ছাসেবকদের খাওয়া-ঘুমের সময় নেই। আধপেট খেয়েই সবাই ছুটছেন রোগীদের কাছে।

খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গতবছরের ৭ এপ্রিল থেকে অক্সিজেন ব্যাংক কাজ শুরু করে। প্রথমে ৫টি সিলিন্ডার দিয়ে কার্যক্রম শুরু। বর্তমানে সিলিন্ডারের সংখ্যা ১৪২টি। মোট ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক ২৪ ঘণ্টা পালা করে কাজ করছেন। এদের বেশিরভাগই ছাত্র। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। যিনি ৮ ঘণ্টা অফিসে দায়িত্ব পালন করেন, বাকিটা সময় স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সিলিন্ডার পৌঁছে দেন রোগীদের বাড়িতে।

ফেসবুকে সংগঠনটির তৎপরতা দেখে বিভিন্ন মানুষ সহায়তার হাত বাড়াচ্ছেন। মানুষের আর্থিক সহযোগিতা দিয়েই সিলিন্ডারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কেনা ও সংগঠনের কার্যক্রম চলছে।

অক্সিজেন ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবক নগরীর হাজী মহসীন কলেজের অর্থনীতি প্রথম বর্ষের ছাত্র তুহিন হোসেন জানান, প্রথম দিকে নগরীর ভেতরেই অক্সিজেন সেবা দেওয়া হতো। বর্তমানে পাশের জেলা বাগেরহাট ও যশোর থেকেও অক্সিজেনের জন্য ফোন আসছে। ওই দুটি জেলায় রোগীদের বাড়িতে এখনও তাদের সিলিন্ডার রয়েছে। চাহিদা বেশি থাকায় সাতক্ষীরায় পৃথক অফিস খুলতে হয়েছে।

বিএল কলেজের ¯œাতকোত্তর শেষ করেছেন সাফায়াতে সরদার। করোনার শুরু থেকেই সংগঠনটির হয়ে অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। জানালেন, চলতি জুন মাসে রোগীর চাপ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিনই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সিলিন্ডার নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে সালাউদ্দিন সবুজ ও আসাদ শেখ সারারাত করোনা হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন।

স্বেচ্ছাসেবক জাহিদুর রহমান এবার বিএল কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন। পূর্বাঞ্চলকে জানালেন, গত একবছরের বেশি সময় ধরে কাজ করতে করতে আমাদের করোনার ভয় চলে গেছে। অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ালে এখন মানসিক শান্তি লাগে। কাজে তেমন কষ্ট হয় না, তবে অক্সিজেন দেওয়ার পরও কেউ মারা গেলে খুব কষ্ট হয়। ওই রাতে আর ঘুম আসে না।

আক্রান্ত হচ্ছেন তারাও ॥

করোনা রোগীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। এ পর্যন্ত ৫/৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজে ঝাপিয়ে পড়ছেন।

স্বেচ্ছাসেবক মাসুদ রানা জানান, তার শরীরে করোনা শনাক্ত হয় গত ৫ জুন। ১৫ জুন তার রিপোর্ট তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। দু’দিন পর তিনি আবারও কাজে যোগ দেন। ওই দিন অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিতে ফুলবাড়ি গেটে যাচ্ছিলেন।

অদ্ভুত কিছু সমস্যা ॥

স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন খুলনার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয় নর্থ ওয়েস্টার্ন থেকে বিবিএ শেষ করা শেখ তাহাজ্জাদ ইসলাম। পূর্বাঞ্চলকে তিনি বলেন, গত ১৪ মাসে কাজ করতে গিয়ে অদ্ভুত কিছু সমস্যার মুখোমুখি হই। দেখা যায়, রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও অনেকে সিলিন্ডার ফেরত দিতে চান না। ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়-এই ভেবে। আমাদের তো সিলিন্ডার কম, সুস্থ রোগীদের বাড়িতে সিলিন্ডার রাখলে আমরা এতো সিলিন্ডার কোথায় পাব ? আবার দেখা যায়, ৫/৬ তলায় রোগী রয়েছেন। আমরা স্বজনদের বলি আপনারা একটু নিচে এসে নিয়ে যান। তারা সহযোগিতা করেন না। অনেকটা কর্মচারীর মতো ব্যবহার করেন।

অনেক সময় দেখা যায়, জরুরী ফোন পেয়ে সিলিন্ডার নিয়ে রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখি অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই। অক্সিজেন লেভেল অনেক ভালো। তখন সিলিন্ডার ফিরিয়ে আনতে তারা বাধা দেন। দেখা যাচ্ছে, তার কারণে অসুস্থ অনেক রোগী জরুরী অক্সিজেন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন না করতে রোগীর স্বজনদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। সেই সঙ্গে উচ্চবিত্তরা যারা প্রয়োজনে সিলিন্ডার নেন, খালি সিলিন্ডার ফেরত দেন। আমার ফেরত দেবার সময় সিলিন্ডার রিচার্জ করে দিতে বলি। রিচার্জে ১২০ টাকা খরচ হয়। এই সামান্যটুকু অনেকে দেন না।

আরও সিলিন্ডার প্রয়োজন, সঙ্গে যানবাহন ॥

প্রতিবেদক অক্সিজেন ব্যাংকের কার্যালয়ে বসে থাকতেই থাকতেই সিলিন্ডার ফুরিয়ে যায়। এরপরও বিভিন্ন এলাকা থেকে ফোন আসতে থাকে।

স্বেচ্ছাসেবক সরদার মুনসুর আলী বলেন, ১৪২টি সিলিন্ডার সবগুলো রোগীদের বাসায়। এরপর ফোন আসলে পুরাতন রোগীদের ফোন দিয়ে সিলিন্ডার লাগবে কি-না শুনি। না লাগলে এনে অন্য রোগীকে দেই। এতে অনেক রোগী কষ্ট পায়। আমাদের দৈনিক যে চাহিদা তাতে কমপক্ষে ৫০০ সিলিন্ডার প্রয়োজন।

তিনি বলেন, সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার যানবাহনের সংকটও প্রকট। আমাদের ৩-৪ জনের মোটর সাইকেল আছে। দেখা যায়, ৪ জায়গা থেকে অনুরোধ আসলে-তিন জায়গায় সিলিন্ডার দিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়। মোটর সাইকেলে করে রোগীর বাসায় সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়ে, অক্সিজেন সংযোগ দিয়ে আসতে অনেক সময় লাগে। ততক্ষণে অন্য রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। শুধুমাত্র যানবাহনের অভাবে অনেকের বাসায় অক্সিজেন পৌঁছানো যায় না। বর্তমানে নিউ মটরসের জিয়া ভাই তার ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে সাহায্য করছেন। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

অক্সিজেন ব্যাংকের সভাপতি সালাহ উদ্দিন সবুজ বলেন, আমাদের আরও ৩০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন। আর এগুলো পৌঁছে দিতে যানবাহন। সিলিন্ডারের সঙ্গে ক্যানোলা, ফ্লো মিটার, মাস্ক, অক্সিমিটারও খুব জরুরি।

তিনি বলেন, গুরুতর রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার বিকল্প থাকে না। করোনা রোগীদের সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স নিতে চায় না। আমাদের একটা অ্যাম্বুলেন্স থাকলে কারও মুখাপেক্ষী হওয়া লাগতো না। একটি অ্যাম্বুলেন্স ও সিলিন্ডারের জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা