• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতার দায় কার

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২২  

রোহিঙ্গা শুধু বাংলাদেশের ইস্যু নয়, এটি এখন বৈশ্বিক ইস্যু। বাংলাদেশ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক দেশগুলোর সহযোগিতা চেয়ে আসছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও আশানুরূপ কোনো ফল মেলেনি। ফলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাসংকট নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রত্যাবাসন যত বিলম্বিত হবে, বাংলাদেশ তত সংকটের মুখে পড়বে। এ সংকট চলমান থাকলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাদক, মানব পাচার, যৌন অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, হত্যা, কট্টরপন্থা ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। আশিয়ান সদস্যদেশ ও এশীয় অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ চীন ও জাপানের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। চীনের কাছ থেকে এখনো আশানুরূপ কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে গত ২৪ জুলাই জাপানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় প্রতিমন্ত্রী হোন্ডা তারো বাংলাদেশ সফরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছেন।

এর আগে গত ১৮ জুলাই জাকার্তায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইন্দোনেশিয়া ও আশিয়ানের সমর্থন চাওয়া হয়। সবশেষ ২৮ জুলাই ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে ‘বন্ধু’রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকায় চরম হতাশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের পর মিয়ানমারে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ ও ব্যবসা বেড়েছে।

মোমেন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে সমর্থন জুগিয়ে আসছে যুক্তরাজ্য। কিন্তু এই পাঁচ দশকে বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত পাঁচ বছরে মিয়ানমারে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

তিনি বলেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধন অভিযানের পর থেকে মিয়ানমারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিনিয়োগ ১৫ গুণ বেড়েছে। অথচ রোহিঙ্গাদের দমনপীড়নের ঘটনায় পশ্চিমারা মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন জেনারেলেরও ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।

শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর নয়, ভূ-রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত-চীনেরও বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। মিয়ানমারের অর্থনীতি সচল রাখতে আশিয়ান দেশগুলোও বিনিয়োগ করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। চলতি জুনে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সংস্থাটির কার্যক্রমের দুর্বলতা ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।

এটি সত্য যে, বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বই করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ বাংলাদেশের জন্য বাড়তি ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করা আরও কঠিন। মিয়ানমার সরকারই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী। কারণ, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে উৎসাহিত করতে মিয়ানমার সরকারের কোনো আগ্রহই নেই।

রাখাইনে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করছে মিয়ানমার সরকার। যার ফলে প্রত্যাবাসনের দ্বিপক্ষীয় (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) উদ্যোগও ব্যর্থ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে পাঠানো যায়নি। কারণ, মানবিক নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব ছাড়া কোনো শরণার্থীকে ফেরত পাঠানো যায় না। কেউ চায় না, নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে শরণার্থী হয়ে থাকতে। রোহিঙ্গারাও বিশ্বাস করে, প্রত্যাবাসন হলে তাদের যন্ত্রণার অবসান ঘটবে।

বিস্ময়কর হলো, বাংলাদেশ প্রায় ৮ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নিবন্ধন করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ৩৫ হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় মিয়ানমার সরকার নিশ্চিত করেছে। আর বাকিদের বাংলাদেশের (চট্টগ্রাম) বাসিন্দা বলে দাবি করা হয়েছে।

কোনো দেশ শরণার্থী সংকটে পড়লে এটি শুধু আশ্রয়দাতা দেশের দায়িত্ব নয়। এটি পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের মতে, বাংলাদেশ মানবিক দিক থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এত বছর পরও বিশ্বনেতারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

দুঃখজনক হলো, আঞ্চলিক, বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না। যেসব দেশ ও নেতা এ ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করবে, তারাই মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে জড়িয়েছে। কাজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা তাদের জন্য কঠিন। তারা মনে করছে, রোহিঙ্গা সমস্যায় কিছু ত্রাণসহায়তা ও তহবিল ঘোষণা করলেই চলে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি বিষয়ে নিজেকেই ভাবতে হবে।

ইউরোপীয় দেশগুলোর মনোযোগ এখন ইউক্রেন যুদ্ধে। দেশগুলো দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার দিকেও ঠিকমতো দৃষ্টি রাখছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যেতে হবে। এশীয় অঞ্চলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট। সংকট সমাধানে ইউরোপ ও আমেরিকার দিকে চেয়ে না থেকে এশিয়াকেই সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। বিশেষ করে চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারত ও আশিয়ান দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, ব্যবসায়িক স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে।

অনেক আগে থেকেই নিজ দেশের জনগণকে বিতাড়িত করার প্রবণতা মিয়ানমারের রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৮০, ১৯৯০ ও সবশেষ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে ওই দেশের সরকার। এর ফলে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের মধ্যে রোহিঙ্গা বিষয়ে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে। রোহিঙ্গারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। সে দেশে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের প্রতি সহনীয় মনোভাব ফিরিয়ে আনা কষ্টকর। তবে বৌদ্ধ সংগঠন দেশগুলো (শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম) মিয়ানমারের বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর মনোভাব নমনীয় করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা