• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১  

দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুন্ড ও ফেনীর সোনাগাজীতে বাস্তবায়নাধীন এই শিল্পনগর পুরোপুরি উৎপাদনে গেলে এখান থেকেই রফতানি হবে বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। ক্রমশ দৃশ্যমান এ শিল্পনগরে ১৩টি শিল্প কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। এর মধ্যে এ বছরই উৎপাদনে যাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শুধু কলকারখানাই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর, যেখানে থাকবে কর্ম পরিবেশের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনসহ সকল ধরনের নাগরিক সুবিধা।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য দেশকে দুই দশকের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্তরে নিয়ে যাওয়া। এই ভিশন ও মিশন সামনে রেখে চলছে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কানেক্টিভিটি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। শিল্পায়নের জন্য দেশে যে এক শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। অবস্থানগত কারণে এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপ ছাড়াও পৃথিবীর নামী অনেক প্রতিষ্ঠান এই শিল্পনগরে ভূমি বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান কারখানার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্র জানায়, এ বছরের প্রথমার্ধেই অন্তত ৫টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে বিদেশীরা আটকে পড়ায় তা বিলম্বিত হয়। তবে বছর শেষে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে যাওয়ার প্রস্তুতি একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে ১০ একর জায়গার ওপর প্রায় ২৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে চীনের জুজু জিনইয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল বছরের শুরুতে। কিন্তু উদ্যোক্তারা চীনে গিয়ে আটকে পড়েছেন করোনা মহামারীর কারণে। জাপানের নিপ্পন স্টিল ট্রেডিং ও বাংলাদেশের ম্যাগডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং যৌথভাবে স্থাপন করেছে নিপ্পন এ্যান্ড ম্যাগডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও বিদেশীরা আসতে না পারায় সম্ভব হয়নি। বছর শেষে উৎপাদন শুরু করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এ প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ১৩টি প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে।

বাংলাদেশে শিল্প এলাকা থাকলেও কোন শিল্প শহর নেই। মীরসরাই, সীতাকুন্ড ও সোনাগাজীর সাগর পাড়ে হতে যাচ্ছে প্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি। চরাঞ্চলের ৩৩ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠছে এই শিল্পনগর। দেশের প্রতিষ্ঠিত প্রায় সকল শিল্পগ্রুপ সেখানে ভূমি বরাদ্দ নিয়েছে। দেশে-বিদেশে এতটাই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে জমি নেয়াটা এক ধরনের মর্যাদার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি এমনই যে, মীরসরাইয়ে একটি শিল্প প্লট থাকবে না, তা কেমনে হয়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সংযোগের জন্য প্রস্তুত হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় তাকিয়া থেকে দশ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘শেখ হাসিনা সরণি’। শিল্প নগরের অভ্যন্তরীণ অনেক সড়কের কাজ শেষ। বিশাল এই এলাকায় এখনই কাজে নিয়োজিত রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। এদের কেউ বা কারখানা স্থাপনে, আবার কেউ বা যোগাযোগসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের কাজে নিয়োজিত। করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলোর কাজে গতি বেড়েছে। সেখানে গড়ে উঠছে হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ ছোটখাটো অনেক প্রতিষ্ঠান। শিল্প নগরের আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ, এত শ্রমিকের থাকার জন্য বাসস্থানের প্রয়োজন। বাড়ি নির্মাণ করলেই ভাড়া হয়ে যাবে। চরাঞ্চলের এ জমি একদা ছিল জলের মতো সস্তা। আর এখন সেখানে ভূমির মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে সেখানে কর্মসংস্থান হবে অন্তত ১৫ লাখ মানুষের। এই শিল্পনগর হতে যাচ্ছে দেশের শিল্পের রাজধানী। অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা আশা করছেন, কেবল এই একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি থেকে রফতানি হবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। শিল্পনগরে চলে গেছে বিদ্যুত ও গ্যাসের পাইপ লাইন। ফলে নির্মাণযজ্ঞ পরিচালনায় এখন আর কোন ধরনের সমস্যা নেই। বিশাল এলাকার ভূমি ভরাট কাজ শেষ হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সীমানা চিহ্নিত করে নিয়েছে। এর মধ্যেই ৮ হাজার একরের বেশি ভূমি বরাদ্দ দিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বিনিয়োগ প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। সেখানে হবে পোশাক, ইন্টিগ্রেটেড টেক্সটাইল, ওষুধ, ইলেকট্রনিকস, চামড়াজাত শিল্প, গাড়ি, মোটরবাইক, খাদ্য ও পানীয়, পেইন্ট, সোলার পার্ক, বিদ্যুত উৎপাদনসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান। এখনও উৎপাদনে না গেলেও বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর ক্রমেই একটি শহরের দিকে রূপ নিচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ১শ’ একর জমিতে হচ্ছে শেখ হাসিনা সরোবর। সেখানে থাকবে দুটি বিশাল জলাধার। এ পাশেই ১১২ একর জায়গায় হবে দুটি ৫ তারকা মানের হোটেল, রিসোর্ট, শপিং কমপ্লেক্স এবং সরোবরে থাকবে বিনোদনের ব্যবস্থা। প্রায় সাড়ে ৩শ’ ফুট উচ্চতার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মিত হবে সেখানে। পুরো ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি হবে সবুজের সমারোহে নান্দনিক। একটি ইকো শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনায় এগোচ্ছে সামগ্রিক কার্যক্রম।

বাস্তবায়নাধীন এ শিল্প নগরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে এর অবস্থান। সবই চলছে আধুনিক নগর বিনির্মাণের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী। সেখানে থাকবে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রেল ও সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুত কেন্দ্র, ট্যুরিজম পার্ক, মেরিন ড্রাইভ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আধুনিক হাসপাতাল এবং পরিকল্পিত আবাসিক অঞ্চল। মীরসরাইয়ের সাধুরচর, শীলচর, পীরেরচর ও চর মোশাররফ এলাকা নিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে এর কর্মযজ্ঞ প্রথমে শুরু হয়েছিল ‘মীরসরাই ইকোনমিক জোন’ হিসেবে। পরে সীতাকুন্ড ও সোনাগাজী ইকোনমিক জোন নিয়ে এর নামকরণ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, যা সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে বেজার।

ব্যবসায়ীদের অন্যতম শীর্ষ সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরেই ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সরকার ব্যাপক শিল্পায়নের লক্ষ্যে দেশে যে ১শ’টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে এই শিল্পনগরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ দেশী এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। করোনায় স্থবিরতা এসেছিল। এখন গতি বাড়াতে হবে, যাতে অবকাঠামোগত কাজগুলো দ্রুত শেষ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিদ্যুত ও গ্যাস লাইন গেলেও পানির ব্যবস্থা এখনও হয়নি। এ কাজটি দ্রুততার সঙ্গে পড়তে হবে। কারণ, শিল্পের স্থাপনা গড়ে সুফল পাওয়া যাবে না, যদি পানির সরবরাহ না থাকে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের জনসংখ্যা বেশি, যা বোঝা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু এর সুবিধাজনক দিক হলো শিল্প কারখানার জন্য আমাদের জনশক্তির অভাব নেই। পৃথিবীর অনেক দেশই এখন জনশক্তি সঙ্কটে ভুগছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এবং অন্যান্য ইকোনমিক জোনগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ভালভাবেই শিল্পের দিকে ঝুঁকছে, যা খুবই ইতিবাচক। কারণ এতটা বিপুল শ্রমশক্তিকে ধারণ করা কৃষির পক্ষের সম্ভব নয়।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা