• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

আজকের খুলনা

সাধনায় মেলে বানরের দেখা

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১১ আগস্ট ২০১৯  

নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তীর ঢাকা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকার দীননাথ সেন রোডের সাধনা ঔষধালয়ের কারখানা ও এর পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে ১৯১৪ সাল থেকে বানরের আবাস শুরু হয়। কিন্তু পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বানর কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। বানরের জন্য নেই কোনো খাবারের ব্যবস্থা, আবাস কিংবা কোনো ধরনের পরিচর্যা। বিশেষ করে পরিবেশ এবং খাবারের অভাবে দিন দিন বিলুপ্তির পথে পুরান ঢাকার বানর।

দীননাথ সেন রোডে সাধনা ঔষধালয়ে গিয়েছিলাম বানর দেখতে। দেখা পেলাম বটে, কিন্তু বানরগুলোর বেশির ভাগেরই শারীরিক অবস্থা কঙ্কালসার। অপরিচিত দেখলেই তাকিয়ে থাকে খাবারের আশায়। সামান্য একটু রুটি হাতে দেখলেই ছুটে আসে। জানা গেল বানরগুলো এখন খাবার পানির জন্য মানুষের বাড়ির ছাদের পানির ট্যাঙ্ক, নালা-নর্দমা ও বিভিন্ন দূষিত পানির উৎসের ওপর নির্ভরশীল। ফলে পুরান ঢাকার দূষিত ও বিষাক্ত পানি পান করে বানরগুলো আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে অসুস্থতার কারণে মারাও যাচ্ছে।

সাধনা ঔষধালয় এলাকা ছাড়াও সূত্রাপুর, ফরাশগঞ্জ, কাগজীটোলা, তাঁতীবাজার, লালবাগ, গেন্ডারিয়া, মিল ব্যারাক, মুহসেন্দী, জনসন রোড, নবাবপুরের রথখোলা, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা ও স্বামীবাগ এলাকায় এক দালান থেকে আরেক দালানে বানরের লাফিয়ে চলার দৃশ্য এখনও চোখে পড়ে। তবে এসব এলাকায় তাদের যাতায়াত অনিয়মিত। মাঝেমধ্যে দল বেঁধে এরা এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। কিছুক্ষণ অবস্থান করে আবার সাধনায় ফিরে আসে। বানরগুলোর দুর্দশার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, গাছপালা উজাড় হয়ে যাওয়া অন্যতম কারণ। নগরায়নের ফলে নানা প্রতিকূলতায় তাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। গেন্ডারিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা সোহান সরদার বলেন, প্রাণীদের প্রতি হীন মনোভাবের কারণে প্রায় প্রতিদিনই বানর হারিয়ে যাচ্ছে। বানরগুলোর যত্ন নেয়া আসলে কঠিন কাজ নয়। যার যার জায়গা থেকে একটু সচেতন থাকলেই আমরা ওদের রক্ষা করতে পারি।

সাধনা ঔষধালয়ের পাশেই প্রবীণ চা দোকানদার রইস উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর আগেও অনেক বানর ছিল। এখন তার অর্ধেকেরও কম আছে। খাবার না পেয়ে বানর বাসায় ঢুকে পড়ে। তখন অনেকে তাদের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয় কিংবা জালে আটকে রাখে। এতে বিরক্ত হয়ে বানরগুলো ভাগাড়ের বা ডাস্টবিনের নোংরা খাবার খাচ্ছে।  ডিস্ট্রিলারী রোডের স্থায়ী প্রবীণ বাসিন্দা হেলালুজ্জামান বলেন, দু’হাজার সালেও গেন্ডারিয়া ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই হাজার বানর ছিল। মানুষের অবহেলা, সরকার এবং সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক খাবার বন্ধ করে দেয়ার ফলে বানরগুলো ক্রমে বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বর্তমানে সাধনা ছাড়া অন্য কোথাও বানর দেখা যায় না। অর্থাৎ অনেক সাধনায় এখন পুরান ঢাকায় বানরের দেখা পাওয়া যায়।  

দীর্ঘ ৪১ বছর সাধনায় কর্মরত নারায়ণচন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বানরের খাবার দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত এক দিনের জন্যও তা বন্ধ করা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাধনার একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, বানরের খাবারের জন্য সকালে ছোলা দেয়া হয়। খাবার সংকটের কারণেই মূলত বানরের সংখ্যা কমছে। খাবারের সন্ধানে সাধনা ছেড়ে অন্য বাসাবাড়িতে চলে যাচ্ছে। কলা, রুটি কিংবা ভাতের হাঁড়ি ছাদে তুলে নিচ্ছে। অনেক সময় খাবার না পেয়ে মানুষকে কামড় দিচ্ছে। এতে বিরক্ত হয়ে স্থানীয়রা বানরকে মারতেও উদ্যত হন।

এদিকে পুরান ঢাকার বিলুপ্তপ্রায় বানর রক্ষা, নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র নিশ্চিতকরণ ও সিটি করপোরেশন কর্তৃক ফের খাবার সরবরাহের জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছে ঢাকা ইয়ুথ ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সোহাগ মহাজন বলেন, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে এখন সরকারীভাবে বানর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে শহরের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাকী বলেন, পুরান ঢাকায় বানরের যে প্রজাতি আছে তা হলো ‘রেসাস মেকাক বানর’। এদের সংরক্ষণের বিষয়ে বন বিভাগের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। খাবারের অভাবে বানরগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে, যার কারণে মানুষ ও বানর উভয়েরই নানা রকমের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের জরিপ বলছে, শুধু রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে দুই শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত একশ প্রজাতির প্রাণী। যেগুলো এখনও টিকে আছে সেগুলোও হুমকির সম্মুখীন।

নানামুখী প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পুরান ঢাকায় প্রায় তিনশ বানর আজও টিকে আছে। একটি শহর রক্ষা করতে হলে এর ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। এরই অংশ হিসেবে বানরের খাবারের জন্য বার্ষিক বাজেট বরাদ্দের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব শীঘ্রই কাজ শুরু করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিল্লাল। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাধনা ঔষধালয়ের কারখানা ও এর পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে ১৯১৪ সাল থেকে বানরের আবাস শুরু হয়। এর মূল কারণ ছিল সাধনা ঔষধালয়ের গুড়। পরে সাধনার চত্বরে বানরের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অধ্যক্ষ ডা. যোগেশচন্দ্র ঘোষ। তিনি নিজস্ব ছাপাখানার ওপরের একটি কক্ষ বানরের বিশ্রামখানা হিসেবে ছেড়ে দেন। সেই সঙ্গে সকাল-বিকাল খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তার ছেলে নরেশচন্দ্র ঘোষ ও নাতি প্রদীপচন্দ্র ঘোষ পূর্বপুরুষের এই ধারা বজায় রেখেছেন।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা