• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

আজকের খুলনা

কী হচ্ছে পাকিস্তানে!

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৭ নভেম্বর ২০১৯  

২০১৪ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পদত্যাগের দাবিতে ‘আজাদী মার্চ’ এর আয়োজন করেছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ এবং মুহাম্মদ তারিরুল কাদরির দল আওয়ামী তেহরিক। ইসলামাবাদে টানা ১২৬ দিন ‘ধর্ণা’ দিয়েছেন তারা রাস্তা দখল করে। নির্বাচনে কারচুপি করে জিতেছেন এই দাবিতে নওয়াজের পদত্যাগ এবং নতুন নির্বাচন ছিল তাদের প্রধান দাবি। কিন্তু সমাপ্তি টানতে হয়েছে পেশোয়ারে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে।

ইমরানের পথ ধরে তারই স্টাইলে গত ১ নভেম্বর থেকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (জেইউআই-এফ) দলের নেতা ফজলুর রেহমানের নেতৃত্বে হাজার হাজার সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী পাকিস্তানের রাজধানীর একটি মহাসড়কে শিবির স্থাপন করেছে। তাদের প্রধান দাবি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগ এবং নতুন নির্বাচন ঘোষণা। অভিযোগও একই- কারচুপি করে জিতেছেন ইমরান। ইমরান পদত্যাগ ছাড়া তাদের সংবিধানসম্মত সব দাবি মানতে রাজি, কিন্তু আন্দোলনকারীরা অনঢ়। আন্দোলনের অধিকার তাদের আছে মন্তব্য করে ইমরান খান এটাও বলেছেন, আইন ভঙ্গ করলে বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

ইমরান খান পাঠান বংশোদ্ভূত লোক। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান ক্রিকেটার। ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে। ১৯৯৬ সালে নিজে দল গঠন করেছেন, নাম দিয়েছেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। দল গঠন করে নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। শুরু থেকেই দেখা গেছে তিনি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রীতি মিনতির পথ ধরে চলেছেন।

নওয়াজ শরীফ যদিওবা সামরিক বাহিনীর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন কিন্তু সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকেনি। কারণ নওয়াজ শরীফ, বেনজির ভুট্টো বা বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ মেনে চলার পক্ষে ছিলেন না। নওয়াজ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ রাখার পক্ষেও ছিলেন না। ব্যাপকভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিরোধ সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

কিন্তু সামরিক বাহিনী তার উদ্যোগের পক্ষে ছিল না। তারা কারগিলে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল নওয়াজ শরীফকে অবহিত না করেই। শেষ পর্যন্ত নওয়াজকে বিতাড়িত করে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন ১৯৯৯ সালে। ৭২ বছরের পাকিস্তানের অর্ধেক সময় সামরিক বাহিনীর লোকেরাই শাসন করেছে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানের সর্বশেষ সামরিক স্বৈরশাসক ছিলেন।

এর আগে ইস্কান্দার মির্জার হাত ধরে জেনারেল আইয়ুব খান, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের সময় পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল নিয়াজী, যিনি মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ইমরান খানকে নিয়াজীর আত্মীয় মনে করা হয়, যদিও এই তথ্য সঠিক নয়। তবে তারা এক গোত্রের লোক।

ইমরান খান ১৮ মাস আগে ২০১৮ সালের আগস্টে সাধারণ নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেন। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ না করলে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো না। তবে পর্যবেক্ষক দল নির্বাচনে কোনো কারচুপির প্রমাণ পায়নি কিন্তু বলেছে নির্বাচনে অংশ নেয়া সব দলের ‘সমান সুযোগ ছিল না’। পাকিস্তানে মুসলিম লীগ (নেওয়াজ), পাকিস্তান পিপলস পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং ইমরান খানের পিটিআই প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল। পারভেজ মোশাররফ তার সময়ে নওয়াজ শরীফকে পাকিস্তান থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তখন তিনি দীর্ঘদিন সৌদি আরবে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। বেনজিরকেও দীর্ঘদিন দেশছাড়া করেছিলেন মোশাররফ।

নওয়াজের প্রতি সৌদি রাজপরিবারের মমত্ববোধ রয়েছে। সৌদিরা ইমরান খানের প্রতি প্রসন্ন নয় বলে মনে হয়। তবু সৌদি সরকার গত আগস্ট মাসে পাকিস্তানকে দুই হাজার কোটি ডলার ঋণ প্রদান করেছে। পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। দেশ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ইমরানের সরকার পূর্বসূরীদের কাছ থেকেই পেয়েছে। তার সরকার দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং আমদানিকে নিরাশ করার মাধ্যমে চলতি অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে, তবে স্থিতিশীলতার জন্য দরকার সরকারের ব্যয় কমানো আর রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বাড়ানো।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, পাকিস্তানের এই বছর মাত্র ৩.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে, পরের বছর আরও কমে গিয়ে ২.৪ শতাংশ হতে পারে। এই সংকট নিম্ন ও মধ্য-আয়ের পাকিস্তানিদের ওপর চরম প্রভাব ফেলছে। মুদ্রাস্ফীতি ১১.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চাকরিতে স্থবিরতা এসেছে। ইমরানের প্রতি সাধারণ মানুষ খুবই বিরূপ হয়েছে সে কারণে। তার পদত্যাগের দাবির আন্দোলনে যারা শরিক হয়েছে তারা বেশিরভাগই নিম্ম আয়ের লোক।

আগেই বলেছি আন্দোলনের ময়দানে আছে মাওলানা ফজলুর রেহমানের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। পিপলস পার্টি বা মুসলিম লীগ এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে যোগদান করেনি। ওই দুই দলের রয়েছে প্রোগেসিভ ভোটার। তারা মোল্লাদের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে শরিক হয়ে সেই ভোটার হারাতে চায় না। তারা যোগদান করলে ইমরানের টিকে থাকা মুশকিল হবে। তবে যোগদান না করলেও আন্দোলন দুর্বল হবে- এটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

মোল্লাদের এই আন্দোলনে একটা লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে কোনো নারী যোগদান করেনি। তারাও আহ্বান জানায়নি। বলেছে, নারীরা ঘরে বসে দোয়া করবে, আন্দোলনের সফলতার জন্য। শুধু তাই নয়, নারী সাংবাদিকদের এই আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে আয়োজক মোল্লারা। অনেক নারী সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলেও তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। অনেকে আবার অভিযোগ করেছেন যে, তারা এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন যে ঘটনাস্থল ত্যাগ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।

আমাদের ঢাকায় ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম যে আন্দোলন করেছে, বলতে পারেন এটা অনেকটাই সেই আঙ্গিকের। অংশগ্রহণকারীরাও সেই তরিকার। আমাদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল কওমি মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্ররা। সেখানেও তাই। রাস্তার যারা আছে তারা দেওবন্দপন্থী। করাচি থেকে খাইবার পর্যন্ত অসংখ্য দেওবন্দপন্থী মাদরাসা রয়েছে। মাওলানা ফজলুর রেহমানের শক্তির ভিত্তি হলো এই মাদরাসাগুলো।

পাকিস্তানে মোল্লা আর মিলিটারি সবসময় গণনার মধ্যে পড়ে। মিলিটারি শাসনের কথাতো আগেই বললাম। অর্ধেক সময় তারা পাকিস্তানকে সরাসরি শাসন করেছে, বাকি সময়ও তারা প্রধান শক্তির উৎস। মোল্লাদের আন্দোলনে প্রয়াত জুলফিকার আলী ভুটোকেও গদি ছাড়তে হয়েছিল। মুফতি মাহমুদ কারচুপির অভিযোগ তুলে ভুট্টোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত ভুট্টোকে বিদায় নিতে হয়েছিল। তখনো আন্দোলন করেছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, তদানীন্তন সভাপতি মুফতি মাহমুদের নেতৃত্বে। মুফতি মাহমুদ শক্তিশালী নেতা ছিলেন। একবার তিনি সীমান্ত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন।

মাওলানা আব্দুল্লাহ দরখাস্তি, মুফতি মাহমুদ, মাওলানা এহতেশামুল হক থানভি, মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা ফজলুর রেহমান, ফাদার অব তালেবান খ্যাত মাওলানা সামিউল হক- মূলত এরাই ছিলেন পাকিস্তানের নামকরা আলেম ও রাজনীতিবিদ। তৃণমূল পর্যায়েও এরা খুব জনপ্রিয়।

এবারের আন্দোলনের প্রধান মাওলানা ফজলুর রেহমান ‘মাওলানা ডিজেল’ নামে খ্যাত। সদা কমলা রঙ্গের পাগড়ি পরা মাওলানা ফজলুর রেহমান একবার ডিজেল স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে এই খেতাবের মালিক হয়েছেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে খুব সুবিধাবাদী হিসেবে তার নাম সবার আগে আসে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিক্ষোভের পেছনে রেহমানের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। একজন চতুর রাজনৈতিক নেতা, গত বছর নিজের আসন হারানোর আগ পর্যন্ত যিনি বছরের পর বছর ধরে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এবার সে ইমরানের পিটিআই প্রার্থীর কাছে হারলেও তার ছেলে এবং ভাই নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছে। মাওলানা ডিজেলের এবারের আন্দোলনের পেছনেও রয়েছে সরকার থেকে সুবিধা আদায়।

ইমরান খান এর মধ্যে মাওলানা ফজলুর রেহমানকে মাওলানা ডিজেল বলে বিদ্রুপ করেছেন। মাওলানা পাল্টা ইমরানের প্রথম স্ত্রীর জেমিমা গোল্ডস্মিথের কথা ইঙ্গিত করে তাকে গালি দিয়েছে ‘ইহুদি’ বলে।

রাজনীতিতে এসব গালি-বিদ্রুপ অবশ্য শোভন নয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে ‘শো-বয় অব কংগ্রেস’ বলে বিদ্রুপ করতেন। বড়লাটের সঙ্গে কোনো বৈঠক হলে সব কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে জিন্নাহ হ্যান্ডশেক করতেন কিন্তু মাওলানা আজাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বললেও হ্যান্ডশেক করতেন না। একদিন মাওলানা বলেছিলেন তোমার পাকিস্তান ২৩ বছরের ওপরে টিকবে না। ঠিক ২৩ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেঙে গেছে। মাওলানা আজাদ আরও বলেছিলেন, জিন্নাহ ভারতীয় মুসলমানদের কয়েদ করে গেল। তার সে কথাও মিথ্যা হয়নি। আজ মোদির সময়ে এসে ভারতের ২০ কোটি মুসলমান কয়েদির মতো আচরণ পাচ্ছে শাসকদের থেকে।

পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। ভারতের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ। না হয় মোদি পাকিস্তান আক্রমণ করত এই সময়ে। যাই হোক, ইমরান খানের প্রতি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমর্থন রয়েছে। এ জন্য হয়তো তার পতন বিলম্বিত হবে। তবে সব সেক্টরের লোকদের হতাশ করে ইমরান বেশিদিন পতন এড়াতে পারবেন না। সম্ভবত সৌদি বাদশাহরাও চান না যে পাকিস্তানের ক্ষমতায় ইমরান থাকুক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা